বিশেষ প্রতিনিধি
দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলা সদরে অবস্থিত কওমি মাদরাসাটিতে সর্বোচ্চ জামাত শরহে বেকায়া। সেই জামাতে সর্বসাকুল্যে ভর্তি হয়েছেন তিনজন। ভর্তির সময়সীমা শেষ হওয়ার পথে। আরও এক-দুজন ভর্তি হতে পারেন- এমন আশা করছেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। অথচ এর আগের জামাত শরহে জামিতে ছাত্র সংখ্যা ছিল ৯ জন। তিন ভাগের দুই ভাগ ছাত্রই এবার আর ভর্তি হয়নি। তাদের কেউ জেলা সদরে, আবার কেউ চলে গেছেন রাজধানী ঢাকায়।
মফস্বলের একটি কওমি মাদরাসার চিত্রই এটি নয়। বেশির ভাগ মাদরাসা এ ধরনের ছাত্র খরায় ভুগছে। নিচের জামাতে ছাত্রসংখ্যা মোটামুটি থাকলেও উপরের ক্লাস যত বাড়তে থাকে তত ছাত্রসংখ্যা কমতে থাকে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের জন্য খুবই বিব্রতকর। নিজেদের হাতেগড়া ছাত্রদের এভাবে চলে যাওয়ায় আক্ষেপের শেষ নেই তাদের।
সিরাজগঞ্জের একটি মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা ফজলুর রহমান বলছিলেন, যেসব ছাত্রকে তারা অতিরিক্ত যত্ন নিয়ে পড়াশোনা করান, প্রত্যাশা থাকে তাদের দ্বারা ভালো ফলাফল হবে, তারা প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জ্বল করবে, তাদের বেশির ভাগকেই আর ধরে রাখা যায় না। ‘কেউ চলে গেলে আমরা কী করতে পারি’ অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলছিলেন তিনি।
কিন্তু মফস্বলের কওমি মাদরাসাগুলোতে এভাবে দিন দিন ছাত্র খরা প্রকট হচ্ছে কেন? এর পেছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, মফস্বলের মাদরাসাগুলোর পড়াশোনার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। ছাত্ররা উপযুক্ত খোরাক না পেয়ে সেখানে আর থাকছে না। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ মাদরাসা পুরো বছর ছাত্রদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে পড়াশোনার টেবিলে ধরে রাখতে পারে না। ভালো শিক্ষক থাকলেও তাদের অন্যান্য ব্যস্ততা থাকায় ছাত্র গড়ার প্রতি সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেন না।
তাছাড়া মফস্বলের মাদরাসাগুলোর একটি বড় অংশ ছাত্রদের পুরোপুরি আবাসিকের ব্যবস্থা করতে পারে না। অনেকে বাড়ি থেকে এসে পড়াশোনা করেন। কেউ কেউ লজিং থেকে পড়েন। এতে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ছাত্ররা পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
মাওলানা আতিকুল্লাহ আগে মফস্বলের একটি মাদরাসায় কিছুদিন খেদমত করলেও এখন ঢাকার একটি প্রাইভেট মাদরাসায় পড়ান। তিনি মফস্বলের মাদরাসাগুলোর সমস্যার কথা তুলে ধরে বলছিলেন, সেখানে উস্তাদদের বেশির ভাগই বাইরে ব্যস্ত থাকেন। কেউ মসজিদে ইমামতি করেন, কেউ অন্য কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত। পুরো সময়টা মাদরাসায় থেকে ছাত্রদের পেছনে সময় দেওয়ার মতো উস্তাদের সংখ্যা কম। তাছাড়া যোগ্য উস্তাদেরও সংকট রয়েছে মাদরাসাগুলোতে। সবচেয়ে বড় হলো, ছাত্ররা ফাঁকিবাজি করে, সেটা ধরার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা মফস্বলের মাদরাসাগুলোতে নেই।
তবে কেউ কেউ মনে করেন, এখনকার ছাত্রদের মধ্যে ঢাকা বা শহরমুখিতা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। প্রতিটি ছাত্রই এক পর্যায়ে শহরমুখি হয়ে পড়ে। ফলে ভালো পড়াশোনা হলেও তাদের মন আর গ্রামে টিকে না। এই প্রবণতা বন্ধ না করলে মফস্বলের মাদরাসাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
তবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতরা মনে করেন, মফস্বলের মাদরাসাগুলোর কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের আপডেট হতে হবে। তারা যদি ২০/৪০ বছর আগের ধারায় এখনও চলতে চায় তাহলে সংকটে পড়বে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এখনকার ছাত্ররা অনেক আপডেট। তাদের হাতে হাতে মোবাইল-ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে গোটা দুনিয়াই তাদের সামনে থাকে। তারা গ্রামের মাদরাসাগুলোতে নিজেদের খোরাক না পেয়ে শহরমুখি হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, মফস্বলের মাদরাসাগুলোকে পড়াশোনার মানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। ছাত্রদের সার্বক্ষণিক নেগরানির আওতায় এনে, মানসম্মত পড়াশোনা নিশ্চিত করতে হবে। পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করতে পারে সেই টিপসও তাদের দিতে হবে। প্রয়োজনীয় কিছু টিপসের অভাবে মফস্বলের মাদরাসাগুলোতে অনেক ভালো পড়াশোনার পরও অনেক ছাত্র ভালো ফলাফল করতে পারে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত উপরের জামাত ছাত্ররা মফস্বলের মাদরাসায় পড়তে চায় না। এজন্য উপরের জামাত খোলা রাখলে সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নামকাওয়াস্তে ক্লাস খুলে রাখলে চলবে না। প্রয়োজনে ছাত্র না পেলে ক্লাস কমিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য হলো, যথাযথ খোরাক দিতে না পারলে ছাত্র ধরে রাখা যাবে না।
তবে অনেকে উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ভালো পড়াশোনা হলে গ্রাম পর্যায়ের মাদরাসাতেও ছাত্রদের ভিড় লাগে। চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ কিংবা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে অজপাড়া গাঁয়েও অনেক মাদরাসা এমন আছে, দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্রদের ভিড় লেগে যায়। এজন্য যেসব মাদরাসা মফস্বলে থেকেও ভালো করছে, তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যদেরও সেভাবেই মাদরাসা পরিচালনা করা উচিত।
এসএকে/