শাব্বির আহমাদ খান
রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। দুপুরের আগ মুহূর্তে একটি ট্রেনে এসে নামলেন পাঁচ মাদরাসা শিক্ষার্থী। তারা উত্তরবঙ্গে একটি জেলা শহর থেকে এসেছেন। সেখানে একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করতেন। এবার তারা ঢাকায় পড়বেন। সেই উদ্দেশেই ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় চলে এসেছেন। রাজধানীর কয়েকটি মাদরাসা তাদের টার্গেট। এর মধ্যে দুইজন মিশকাত জামাত এবং তিনজন দাওরায়ে হাদিস পড়বেন।
আগে এক দুইবার ঢাকা এলেও শিক্ষার্থীদের কেউই ঢাকার পথঘাট খুব একটা চিনেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিশকাত-দাওরা ঢাকায় পড়বেন এমন স্বপ্ন তারা অনেক দিন ধরেই লালন করেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই এবার ঢাকায় এসেছেন। কয়েকটি মাদরাসা রয়েছে তাদের পছন্দের তালিকায়। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যেখানে সুবিধা হয় সেখানেই তারা ভর্তি হবেন।
শুধু এই কয়েকজন নয়, এবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখী স্রোত লক্ষ্য করা গেছে। ঈদুল ফিতরের তিন চার দিন পর থেকেই ঢাকায় আসতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই ভর্তি হয়ে গেছেন। বাকিরাও ভর্তি হওয়ার পথে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চান কোনো একটি নামকরা মাদরাসা থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে। কারণ এটি তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি হবে। সারা জীবন অনেকটা গর্ব করে বলা যাবে- আমি অমুক মাদরাসার ফারেগ।
কুমিল্লার একটি মাদরাসায় জালালাইন জামাতে পড়েছেন হাফিজুর রহমান। তিনি এবার ঢাকার একটি মাদরাসায় মিশকাত শরিফে ভর্তি হতে এসেছেন। তিনি বলেন, আমি যে মাদরাসায় পড়েছি সেখানে দাওরায়ে হাদিস নেই। মিশকাত থাকলেও সেখানে পড়বো না বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ ঢাকার মাদরাসাগুলোর শিক্ষার মান অনেক ভালো। এ কারণেই আমি ঢাকায় চলে এসেছি।
কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও চান তাদের সন্তান একটি নামিদামি মাদরাসা থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে আলেম হোক। কারণ সাধারণত বড় মাদরাসায় পড়াশোনা ভালো হয়। এছাড়া ঢাকার মাদরাসাগুলো পড়াশোনার মান ধরে রাখার চেষ্টা করে। পড়াশোনার বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঢাকার মাদরাসাগুলো যতটা যত্নশীল ততটা ঢাকার বাইরের মাদরাসাগুলো নয়।
ময়মনসিংহের একটি মাদরাসার দরসি বিভাগের শিক্ষক মাওলানা আবুল হোসেন অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলেন, আমরা ছাত্রদের নিচের জামাত থেকে যত্ন করে গড়ে তুলি। আর তারা উপরের জামাতে উঠে চলে যায় ঢাকার মাদরাসাগুলো। যেহেতু আমাদের হাতেগড়া ভালো ছাত্ররা সেখানে ভর্তি হয় এজন্য তাদের ভালো ফলাফল হয়। আমাদের হাতে গড়া ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে থাকলে আমরাও ভালো ফলাফল করে দেখাতে পারতাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকামুখী মাদরাসা ছাত্রদের এই স্রোত নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই শিক্ষার্থীরা ঢাকায় পড়াশোনার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। এমনকি মফস্বলের কোনো কোনো মাদরাসায় অনেক ভালো পড়াশোনা হলেও তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে ঢাকার মাদরাসা। অনেকের ধারণা, ঢাকার মাদরাসা হলেই ভালো হবে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও আছে। ঢাকার অনেক মাদরাসায়ও আশানুরূপ পড়াশোনা হয় না। আবার মফস্বলের অনেক মাদরাসায়ও ভালো লেখাপড়া হয়। মূলত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকামুখিতার যে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে সেটা দূর করা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখিতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন। গত পনের বছর যে একটা ভয়ের সংস্কৃতি ছিল সেটা এবার নেই। অনেকটা মুক্ত স্বাধীনভাবে দিন কাটাচ্ছেন আলেম-উলামারা। মূলত সেই কারণেই এবার অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের ঢাকায় পড়াশোনা করতে বাধা দিচ্ছেন না।
অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখিতার প্রবণতা কমাতে হলে মফস্বলের মাদরাসাগুলোর পড়াশোনাসহ সার্বিক মান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর ঢাকার মাদরাসাগুলোরও ছাত্র টানার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তারা। কেউ কেউ মনে করেন, পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তি করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে বেফাকসহ অপরাপর বোর্ডগুলো একটি নীতিমালা ঠিক করতে পারে বলে জানান তারা।
এসএকে/