বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ।। ২৯ মাঘ ১৪৩১ ।। ১৪ শাবান ১৪৪৬

শিরোনাম :
কুমিল্লার চান্দিনায় আন্তর্জাতিক তাহফীজুল কুরআন মাদরাসায় বার্ষিক অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত আমিরাতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা কিশোরগঞ্জে বর্ণাঢ্য আয়োজনে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার ৪৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত চবি অধ্যাপকের ওপর ছাত্রীর হামলা: বিচারের দাবীতে মানববন্ধন খুলনা পুলিশ কমিশনার সাথে ইসলামী আন্দোলন নগর নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় ফরহাদ মজহার ও আমি : তর্কটা কোথায়? মুক্তির রজনী পবিত্র লাইলাতুল বরাত : হাফিজ মাছুম সিলেটের শাহপুর দক্ষিণপাড়ায় বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল সম্পন্ন ‘নতুন বাংলাদেশে’ বিশ্ববাসীকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ইসলামী ব্যাংকের কুমিল্লা জোনের এজেন্ট ব্যাংকিং সম্মেলন অনুষ্ঠিত

৫২’র ভাষা আন্দোলন ও মওলানা ভাসানী


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

---- এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ----

০১. উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রথম কাতারে। যদিও শাসকগোষ্টি সেই ইতিহাসটাকেও বার বার মুছে দিতে চেয়েছে। গত ফ্যাসীবাদী শাসনামলে দেশের একজন মহামান্য রাষ্ট্রপতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন “৫২র ভাষা আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর কোন অবদান নেই--, তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন ??? হায়রে জাতি ! মহামান্য রাষ্ট্রপতির মত একজন প্রবীণ রাজনীতিকের মুখ থেকে শুনতে হয়েছিল এমনই একটি অসত্য বক্তব্য।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, ১৯৩৭ সালে আসাম ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবেও মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক পরিষদ সভায় বাংলায় বকৃতা করেছেন। স্বাধীন ভারতের আসাম বিধানসভায় বাংলা ভাষা যে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করে, এর প্রাপ্তির পথ তৈরি করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর দম্ভোক্তির পর বেশ কিছুদিন স্থিতিশীল থাকলেও নতুন করে রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক উসকে দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। তার এই ঘোষণার পর ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার বার লাইব্রেরিতে তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ সভা থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে চেয়ারম্যান ও গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে বলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাবে ওই দিনটিকেই ‘ভাষা দিবস’ ঘোষণা করে ওই দিন সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও জনসভা আহ্বান করা হয়।

০২. ১৯৪৭ সালে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার পূর্বেই পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে দেশের শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যে নিরব প্রশ্নের সম্মুক্ষিন হন তারই বহি:প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮সালে ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে। পাকিস্তানের ৫৬% মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তৎকালিন পাকিস্তানের  শাসকগোষ্টির প্রস্তাবে প্রতিবাদ করে উঠে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র-যুব সমাজ। এ বিষয়ে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আবদুল মতিন যিনি ভাষা মতিন হিসাবে খ্যাত তিনি বলেন, “১৯৪৭ সালের শেষের দিক থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তার উদ্দোক্তা ছিলেন পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকের অখ্যাত সাধারণ সেক্রেটারীয়েট কর্মচারীবৃন্দ। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নতুন মুদ্রা ও মনিঅর্ডার ফর্ম এবং খাম ও পোষ্টকার্ডে বাংলা না থাকায় বা অতি মামুলি ভাবে থাকায় তারা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র প্রতিবাদ মিছিল বের করেন এবং বাংলাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানান এবং এসব ঘটে ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসে। তখন ছাত্র ও জনতার এক মিছিল সেক্রেটারী ভবন গিয়ে তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। শিক্ষামন্ত্রী জনাব মফিজউদ্দীন তাদের দাবীতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন। শিক্ষামন্ত্রীকে দস্তক্ষত দেয়ার জন্য যে কলম দেওয়া হয়েছিল তা ছিলো আমার। এর পর মিছিল তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে তিনি আগেই নিজ কক্ষ ত্যাগ করে গাড়ীতে চরে পালিয়ে যান।”( ধানসিড়ি সংকলন, ৪র্থ প্রকাশনা, ঢাকা-১৯৮০,পৃঃ-৫৮)

অনেক রাজনৈতিক নেতা ভাষা আন্দোলনের শুরুতে জড়িত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক জনাব গাজীউল হক লিখেছেন, “মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২জন নেতা এই আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রীত্ব এবং রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।”

ভাষা আন্দোলনে করণীয় নির্ধারনে ৫২-র ৩১ জানুয়ারী ঢাকা বার লাইব্রেরীতে সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সাধারণ সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সভায় যে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় সেখানে ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল হক, আবুল কাশেম, আবদুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, সৈয়দ আবদুর রহিম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দ। সেই সভাতেই ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি‘র পূর্ব ঘোষিত ৪ ফেব্রুয়ারীর ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট এবং ঐ দিনের সভা ও শোভা যাত্রার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক অলি আহাদ লিখেছেন ঃ-“৬ই ফেব্রুয়ারী পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবির অফিস ১৫০নং মোগলটুলিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ........ সরকার যদি ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা জারী করে তাহা হইলে আইন ভঙ্গ করা হইবে কি হইবে না তাহাও আলোচিত হয়। বেশীরভাগ উপস্থিত সদস্যই আইনভঙ্গের বিপক্ষে মত জ্ঞাপন করেন। কিন্তু, আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দৃঢ়মত প্রকাশ করি। বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সভাপতির আসন হইতে আমার বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো ভাষায় ঘোষনা করিয়া বলেন যে সরকার আমাদের নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ন গণআন্দোলনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বানচাল করিবার জন্য অন্যায়ভাবে আইনের আশ্রয় গ্রহন করে। সে সরকার কর্তৃক জারীকৃত নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করিয়া গ্রহন করিবার অর্থ স্বেরাচারের নিকট আত্মসমর্পন। যা হোক, কোনরুপ সিদ্ধান্ত গ্রহন করা ব্যতিতই সেইদিনকার সভা মুলতবী করা হয়।” ( জাতীয় রাজনীতি ৪৭-৭৫)

০৩. ২১ ফেব্রুয়ারীর হরতালকে সফল করার জন্য ৪ ফেব্রæয়ারী থেকেই প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ২০ফেব্রæয়ারী রাতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্টি ১মাসের জন্য ঢাকার সর্বত্র ১৪৪ধারা জারি করে। সর্বমহলেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঐ রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময়টা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী মফস্বল সফরে ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় সরকারের জারিকৃত ১৪৪ধারা ভঙ্গের ব্যপারে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মাঝে তুমুল বাকবিতন্ডা সৃষ্টি হয়। জনাব অলি আহাদ পরিস্থিতি ব্যপক ও সুস্পষ্ট বিশ্লেষন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনের অগ্রসর না হলে ভাষা আন্দোলনের এখানেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে। আর সরবকারী দমননীতির নিকট বশ্যতা স্বীকার করা হবে ও জনগনের স্বতঃস্ফুর্ত সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করা হবে। পরিমেষে সভায় ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন জনাব অলি আহাদ, জনাব আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), জনাব শামসুল হক ও জনাব গোলাম মাওলা। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ১৫০ নম্বও মোঘলটুলিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে সেটা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না প্রশ্নে দীর্ঘ বিতর্ক চলে। উল্লে যোগ্যদের মধ্যে অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাকে সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, “যে সরকার গণআন্দোলনকে বানচাল করার জন্য অন্যায়ভাবে আইন প্রয়োগ করে সে সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করে মেনে নেয়ার অর্থ স্বৈরাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করা।” মওলানা ভাসানীর এই দৃঢ় অবস্থানের ফলে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুযারি ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার পর পূর্ব বাংলায় যখন সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার উঠেছিল এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন যখন আরো দুর্বার হচ্ছিল তেমন এক পরিস্থিতির মধ্যেও ২৪ ফেব্রæয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদ থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, “... ঘটনা বর্তমানে ঘটিলেও বহু পূর্বেই পূর্ব বংঙ্গে ভাষা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিয়াছে। আমি সেই সময় একটি জনসভায়ও এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলাম, যে-আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদনুসারে উর্দুই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । বাংলার বুকে অবশ্য উর্দুকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে না, তবে বিদ্যালয় আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষারূপে ইহা পড়ানো হইবে এবং যথাসময়ে এই প্রদেশবাসীগণ এই ভাষার সহিত পরিচিত হইয়া উঠিলে প্রদেশের শিক্ষিত সমাজ ও সরকারী কর্মচারীগণ আপনা হইতেই ইহা পড়িতে ও লিখিতে শুরু করিবে। তখন উর্দু তাহাদের নিকট গৌরবজনক মর্যাদাই লাভ করিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরাও দুই ভাষাভাষী হইবে ।...' (দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)”

সেই সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সোহরাওয়ার্দীর ববিবৃতির বিরোধীতা কবওে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “সংবাদপত্রে জনাব সোহরাওয়ার্দীর এক বিবৃতি দেখিয়া আমরা অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। উহাতে তিনি পরোক্ষভাবে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য ওকালতী করিয়াছেন। উহাতে তাহার ব্যক্তিগত অভিমতই প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া বুঝিতে হইবে এবং আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিতেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহিত না হওয়া পর্যন্ত এবং সরকার কর্তৃক কার্যকরী না করা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইবে। আওয়ামী লীগের ঘােষণাপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার দাবী করা হইয়াছে এবং এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার পর হইতেই আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার জন্য আন্দোলন করিয়া আসিতেছি। (দৈনিক আজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)” দলের পাশাপাশি মওলানা ভাসানী নিজেও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেই ভূমিকা পালন করেছিলেন।

০৪. যাই হোক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দোদুল্যমানতা সত্তে¡ও ছাত্র-যুব সমাজের আপোষহীন প্রচেষ্টায় ৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারী রচিত হলো এদেশের সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৪৪ ধরা ভঙ্গের মাধ্যমেই সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের চুড়ান্ত অধ্যায়। যে অধ্যায়ে সালাম, বরকত, রফিক-সহ বহু শহীদের রক্তে লেখা হয় ইতিহাস। ব্যাপক রক্ত পাতের কথা শুনেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছুটে আসেন ঢাকায়। সরকার এতোটা হিংস্র হতে পারে সে আশংকা আগে কেউ করেনি। পরদিন ভাষা শহীদদের স্মরণে যে গায়েবানা জানাজা হয় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে মওলানা ভাসানী তাতে উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কে ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, “মওলানা ভাসানী গায়েবী জানাজা পরিচালনা করেন।”

ভাষা সৈনিক গাজীউল হক বলেন, “শহীদদের গায়েবী জানাজা হলো। মোনাজাত করলেন মওলানা ভাসানী।”

ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক লিখেছে-“মেডিকেল কলেজের সম্মুখে তিনি (মওলানা ভাসানী) লক্ষ লোকের একটি গায়েবী জানাজার নেতৃত্ব করেন।”

২১ফেব্রুয়ারীর ভয়াবহ ও বর্বরোচিত ঘটনা সম্পর্কে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, “ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে নিন্দা করার ভাষা আমার নাই। কোন সভ্য সরকার এরুপ বর্বরোচিত কান্ড করিতে পারে আমি দুনিয়ার ইতিহাসে তার নজির খুজিয়া পাই না। ......... পেশী কথা বলার সময় এটা নয়। আমি দাবী করি অবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হউক। পুলিশী গুলির তদন্ত করার জন্য হাইকোর্ট জজ ও জনপ্রতিনিধি নিয়া গঠিত কমিশন নিযুক্ত করা হউক। আমি অপরাধিদের প্রকাশ্যে বিচার দাবি করিতেছি। এই ব্যপারে যাদের গ্রেফতার করা হইয়াছে তাদের মুক্তি দেওয়া এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হইয়াছে অবিলম্বে তাহা প্রত্যাহার করা হউক। সর্বোপরী শহীদদের পরিবার পরিজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা করা হউক।”

০৫. আন্দোলনকে স্থমিত করতে শাসকগোষ্টি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সংস্কৃতি কর্মীসহ অসংখ্য ব্যক্তিকে সরকার গ্রেফতার করেছিল সরকার। যাদের মধ্যে অন্যতম  হলেন-মওলানা ভাসানী, আবুল হাসিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, অজিত গুহ, খালেক নেওয়াজ খান, মির্জা গোলাম হাফিজ, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ।

সেই বন্দী জীবন সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার জনাব অলি আহাদ লিখেছেন, “৫নং ওয়ার্ডে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাসিম, শামসুল হক..... ও আমি একত্রে বাস করিতাম। সর্বপ্রকার আশানিরাশার আলোছায়ার খেরায় বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সকলের নিকট পিতৃতুল্য স্নেহ, মায়ামমতা এবং সাহস, উৎসাহ ও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও ঔষধ-পত্রের যাহাতে অসুবিধা না হয় তাহার জন্য তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে সুকৌশলে জয় করিয়া রাখিতেন। মোদ্দা কথা তাহার অপত্যস্নেহ ও নির্ভীক মন সেই সময়ে দুর্লভ প্রেরনার উৎস ছিল।” (জাতীয় রাজনীতি-১৯৪৫-৭৫)

সেই সময় ভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী কমিউনিস্ট নেতা ও বামপন্থী কর্মীদের মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। এ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সিপাহসালার জনাব অলি আহাদ তাঁর জাতীয় রাজনীনিত ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে লিখেছেন, “ রাজবন্দীর মুক্তির ও অন্যান্য দাবিতে মওলানা ভাসানী লেবুরস পানে রোজা রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। আমরাও বন্দীমুক্তি ও কতিপয় দাবির ভিত্তিতে পূর্ন অনশন ধর্ম ঘটের পরিবর্তে মওলানা ভাসানী পরামর্শ মতো ৩৫দিন অনুরুপ রোজা রাখি।”

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ৫৩-র ১৮এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আর রোজারমত নয় সম্পূর্ন ‘আমরন অনশন ধর্মঘট’ শুরু করেন, তাতে সরকার বিচলিত হয়, কারন তাঁর অনশনের সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এমনিতেই কারাবরনের সময় মওলানা ভাসানীর শাররিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটতে থাকে। ৫৩-র ফেব্রুয়ারীতে তাকে চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন ঢাকা মেডিকেলে রাখা হয়েছিল। সেই সময় ২১ফেব্রুয়ারীর প্রথম বর্ষপূর্তিতে মজলুম জননেতা মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জেলখানায় একদিনের অনশন করেন। সেদিন তিনি এক ফোটা পানিও মুখে দেননি। অনশন ধর্মঘট শুরুর পর তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে এবং ব্যপক জনমতের চাপে পাকিস্তানের শাসকগোষ্টি ১৯৫৩-র ২১ এপ্রিল কারাগার থেকে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

০৬. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে মওলানা ভাসানী ছিলেন সামনের সারিতে। শুধু ঢাকাতেই নয়, তিনি নিজের জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ এবং সাংগঠনিক সফরে বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশে বাংলার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। সিরাজগঞ্জে মওলানা ভাসানীর ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফী সাধক হযরত মওলানা শাহসূফী শাহ মোহাম্মদ ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহ.)। সে সময় সিরাজগঞ্জে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠন ছিল না। মুসলিম লীগও ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরোধী। তাই সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি নতুন সংগঠন সৃষ্টি করা হয়। সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। এনায়েতপুরের পীর হযরত খাজা ইউনুস আলী নকশাবন্দি মোজাদ্দেদী (রহ.) তার সমর্থকদের নিয়ে ভাষা আন্দোলনে সমর্থন দেন। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে সিরাজগঞ্জের অনেকেই নির্যাতনের শিকার হন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক জয়লাভের পর ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ (১) অনুচ্ছেদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। এরপর ১৯৬২ সালের সংবিধানে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ২০০০ সালের  ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

০৭. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাষা আন্দোলনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪৮ সাল থেকে বিকশিত ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল বিবৃতিতে বা জনসভার ভাষণে নয়, পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পার্লামেন্ট ‘ব্যবস্থাপক সভায়’ও তিনি বাংলা ব্যবহারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। যেমন প্রাদেশিক ১৯৪৮ সালেরু ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার দাবি জানিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টের ভেতরে তিনি অবশ্য আর কথা বলার বা দাবি জানানোর সুযোগ পাননি। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার মিথ্যা অভিযোগে ব্যবস্থাপক সভায় তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে মওলানা ভাসানী এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, তাকে ছাড়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তার পরও কেন মওলানা ভাসানীকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র ছিল ? যারা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে মুছে ফেলতে চেয়েছে তারা আসলেই জাতীয় বিশ্বাস ঘাতক। এই সকল বিশ্বাস ঘাতকদের বিচার হচ্ছে ইতিহাসের নিয়মেই।

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ