|| মুনীরুল ইসলাম ||
অফিস-আদালত, দোকান-পাট, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাইনবোর্ড-ব্যানারেও বানান ভুল চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে ‘রেস্তোরাঁ’ এক মজলুম শব্দ। প্রতিনিয়তই নির্যাতিত হচ্ছে আমাদের ক্ষুধা নিবারণের ঠিকানা ‘রেস্তোরাঁ’। এর মানে মোটামুটি সবাই জানি, সহজ বাংলায় খাবার হোটেল। ইংরেজিতে রেস্টুরেন্ট।
শব্দটাকে মজলুম বললাম এজন্য যে, আমাদের দেশে রেস্তোরাঁরও অভাব নেই, এর বানানের রকমফেরেরও শেষ নেই। রেস্তোরাঁর মাথার উপর চন্দ্রবিন্দুটা দৌড়াদৌড়ি করে। কোনো দোকানে ‘রেঁস্তোরা’, কোথাও রেস্তোঁরা, আবার কোথাও শুদ্ধ বানানে রেস্তোরাঁ, চন্দ্রবিন্দু হাওয়াও হয়ে যায় কোথাও। আমাদের সচেতন হয়ে রেস্তোরাঁর চন্দ্রবিন্দুর দৌড়াদৌড়ি বন্ধ করে একে বিশ্রাম দেওয়া উচিত।
এই রেস্টুরেন্ট, স্টোর, স্টেশন ইত্যাদি শব্দগুলোকে মূর্ধন্য-ষ দিয়ে রেষ্টুরেন্ট, ষ্টোর, ষ্টেশন ইত্যাদি লিখতে দেখা যায়। এগুলো দন্ত্য-স দিয়ে লিখতে হবে। কারণ, বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না।
ফেসবুকের মাধ্যমে সেদিন দেশের একটি রাজনৈতিক দলের নাম ও লোগোযুক্ত একটি সাইনবোর্ড দেখলাম। সাইনবোর্ডের উপরে দলীয় প্রতীকও ভাসছে। সাইনবোর্ডে লেখা-
‘আমরা এমন এক গর্বের বাংলাদেশ গড়বো
বিশ্বের সর্বচেয়ে দামী পাসর্পোট হবে
বাংলাদেশের পাসর্পোট’
লেখাটার ভুলগুলো আগে দেখি- সর্বচেয়ে নয়, সবচেয়ে। দামী নয়, দামি। পাসর্পোট নয়, পাসপোর্ট। দুইবার পাসপোর্ট লেখা হয়েছে, দুইবারই ভুল হয়েছে। এর মানে ভুলটা ‘স্লিপ অব পেন’ বা অসতর্কতার কারণে হয়নি, অজ্ঞতার কারণে হয়েছে। আচ্ছা, এইটুকু লেখায় যদি এতগুলো বানান ভুল থাকে, তাহলে কীভাবে সম্ভব হবে গর্বের বাংলাদেশ গড়া? ভাষার প্রতি আমাদের এমন আচরণে রফিক, সালাম, বরকতের আত্মারা কষ্ট পাবে তো!
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাসে ইসলামি বইমেলার আয়োজন করে থাকে। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। এতে দেশের বিভিন্ন প্রকাশনী অংশ নেয়। প্রকাশনীর নামে ব্যানারগুলো মেলা কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে লিখে সরবরাহ করেন। এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু এই ব্যানারগুলোতে প্রকাশনীর নামের বানানে প্রচুর ভুল চোখে পড়ে। গত মেলায় তারা একটি ‘লেখক ও প্রকাশক কর্ণার’ করেছিলেন। তথ্য প্রচার কেন্দ্রও সেটা। বলা যায়, একের ভেতর তিন। সেখানে তারা ‘কর্নার’ বানানটিও ভুল লিখেছেন। এবার অবশ্য বানানটি শুদ্ধ হয়েছে। বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য-ষ’র মতো মূর্ধন্য-ণও হয় না। আর তারা এখনও ‘ইসলামী বইমেলা’ লিখেন। এটা নিয়ে না-ই বললাম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের জন্য অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে এমন ভুলত্রুটি কাম্য নয়।
এবার এপার বাংলা ছাড়িয়ে ওপার বাংলার কথা বলি। মানে দাদাবাবুদের কোলকাতার কথা বলছি। পশ্চিমবঙ্গ বলেও পরিচিত এই জায়গাটি। কোলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো দেখা যায়।
সেখানে লেখা রয়েছে-
‘বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবর রহমান
জন্ম: ১৭ই মার্চ ১৯২০ মৃত্যু: ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫’
এর নিচে ইংরেজিতেও লেখা রয়েছে কথাগুলো। বাংলাদেশের স্থপতিকে এই সম্মানটুকু জানানোর জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। অনেক শব্দই তাদের সঙ্গে আমাদের উচ্চারণে ও লেখায় মিলে না। বিশেষত তারা দন্ত্য-স আর তালব্য-শয়ের উচ্চারণ নরম করে করেন। তবে লিখেন শুদ্ধ করেই। তারা উচ্চারণ করেন- ছবাই, ছুভেচ্ছা, ছম্পাদক, ছাংবাদিক ইত্যাদি। সেটা ভিন্ন কথা। তাই বলে কি দাদারা বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটাও বিকৃত বানানে লিখবেন? তারা ‘শেখ’কে লিখেছেন ‘সেখ’, ‘মুজিবুর’কে লিখেছেন ‘মুজিবর’। না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এমন একজন বিশ্ববিখ্যাত মহান মানুষের নাম তারা ভুল বানানে লিখতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু যেভাবে লিখতেন, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে লিখছেন সেভাবেই লেখা উচিত ছিল। বিখ্যাত মানুষের নাম আর প্রতিষ্ঠানের নামের বেলায় এটাই নিয়ম। এই নিয়মটা ভঙ্গ করলেন দাদাবাবুরা।
এখানে কিছু ভুল বানানের নমুনা সাইনবোর্ড দেখানো হলো। আপনাদের মাঝে তিনটি সাইনবোর্ডের লেখা হুবহু তুলে ধরে বিদায় নিচ্ছি। আপনারাই এগুলোর বানান শুদ্ধ করে মর্ম উদ্ধার করুন- ‘ক্রইকিৃত জোমির মালীক মতিউর রহামান’। ‘ভাত রুম করলে ১০ টাকা, পচরাফ করলে ৫ টাকা’। ‘বিলেরটাকাকেশেদীন দন্যভাদ’।
কেএল/