|| মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ||
আমাদের আকাবির ও আসলাফগণের জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতি কী ছিল? এটি একটি বড় প্রশ্ন। কওমি তরুণদের জন্য এই প্রশ্নের উত্তরই হতে পারে পথের দিশা। হতে পারে উজ্জল দৃষ্টান্ত। তাহলে আর বর্তমান যামানার বিভিন্ন কথায় বিভ্রান্ত হওয়া লাগবে না।
ইমাম যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮ হিজরি/১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দ) রচিত গ্রন্থ سِيَر أعلام النبلاء অধ্যয়ন করলে এক বিস্ময়কর তথ্য সামনে আসে—এতে উল্লেখিত বহু পণ্ডিত ছিলেন ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। ইলম ও বাণিজ্যের এক অপূর্ব সমন্বয় গঠিত এই আকাবির-আসলাফগণের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তারা একাধারে ছিলেন উচ্চস্তরের আলেম ও সফল ব্যবসায়ী। এতে উল্লেখিত শত শত আশ্চর্যজনক তথ্য ও ঘটনা ইলমের সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ককে উজ্জ্বল করে তোলে।
এইসব বিজ্ঞ আলেমদের একজন বলেছিলেন,
"لم يكن في الدنيا أيسر منه من التجار"!
"পৃথিবীতে ব্যবসায়ীদের চেয়ে ধনী আর কেউ ছিল না!" তার মৃত্যুর পর তিনি তিন লক্ষ দিনার (আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) রেখে যান। এমনকি তিনি বলতেন, "ليس في الدنيا مثل داري"!!
"আমার বাড়ির মতো পৃথিবীতে আর কিছুই নেই!"
তদ্রূপ, ইমাম আবু সাদ আস-সামআনি আল-মারওয়াজী (মৃত্যু ৫৬২ হিজরি/১১৬৬ খ্রিস্টাব্দ) রচিত 'আল-আনসাব' গ্রন্থেও শত শত পণ্ডিতের জীবনী সংকলিত হয়েছে। যারা বিভিন্ন পেশা ও শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশেষত, তৃতীয় হিজরি শতাব্দীর প্রথম দিকে / নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে এই পেশাজীবী আকাবির-আসলাফদের জীবনী শ্রেণীবদ্ধ করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
আস-সামআনি আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক আস-সা'দী আল-হারাউই আশ-শাফি'ঈ (মৃত্যু: প্রায় ২৮৫ হিজরি/৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে বলেছেন,
"رأيتُ في تصنيفه كتابا حسنا ببخارى أظنه لم يُسبَق إلى ذلك، سمّاه: ‘كتاب الصُّنّاع من الفقهاء والمحدِّثين‘"!!
"আমি তার শ্রেণিবিন্যাসে বুখারায় একটি ভালো বই দেখেছি, যা আমার মনে হয় আগে কখনও লেখা হয়নি। তিনি এটির নাম দিয়েছিলেন: كتاب الصُّنّاع من الفقهاء والمحدِّثين 'ফিকাহবিদ ও হাদিস পণ্ডিতদের কারিগরদের বই'।" এই গ্রন্থে তিনি পঞ্চাশজনেরও বেশি সুগন্ধি ব্যবসায় নিযুক্ত আকাবেরের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এই সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে যে ইসলামের ইতিহাসে বহু আসলাফ ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তারা দ্বীনের জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সফলতা অর্জন করেছিলেন।
গবেষক আব্দুল বাসিত বিন ইউসুফ আল-গারিব একটি গবেষণা পরিচালনা করেন এবং 'الطرفة فيمن نُسب من العلماء إلى مهنة أو حِرفة' শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তিনি প্রায় ১৫০০ পণ্ডিতের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যারা প্রায় ৪০০টি ভিন্ন পেশা ও শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৪০০টি পেশার একটিও মসজিদ মাদরাসা ছিল না। অবাক লাগে না বিষয়টা!
বাস্তবতা হলো, মুসলমানদের জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইলমের সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে ইসলামের মূল শিক্ষা ও জীবনব্যবস্থার সংযোগকে প্রতিফলিত করে। বাণিজ্যের পথগুলো দ্বীনের দাওয়াত ও ইলম অনুসন্ধানের যাত্রার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। যদিও তারা পৌঁছেছিলেন চীন। কিন্তু প্রতিটি কাফেলায় থাকত পণ্য, ব্যবসায়ী, আলেম, ছাত্র ও কিতাব। এটি ছিল এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক কাঠামো, যেখানে প্রতিটি উপাদান একে অপরকে পরিপূর্ণ করত, কোনো বিভাজন বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই। যে কেউ এই সংযোগের গভীরতা অনুধাবন না করলে, সে ইসলামকে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। ইসলাম বস্তু ও আত্মার মধ্যে এক অভূতপূর্ব ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
একই সঙ্গে, মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে স্বাধীনতার অনুভূতি অত্যন্ত গভীর ছিল। তারা চিন্তা, মতপ্রকাশ ও বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকতে চাইতেন এবং এই স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে এমন কোনো বিষয়ের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। অর্থের প্রাচুর্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করত এবং ইসলামি জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করত।
তাই, মার্কিন ইতিহাসবিদ ও গবেষক ওলিভিয়া রেমি কনস্টেবল - যিনি مركز دراسات الوحدة العربية কর্তৃক প্রকাশিত 'الحضارة العربية الإسلامية في الأندلس' (আন্দালুসে আরব-ইসলামি সভ্যতা) গ্রন্থে একটি গবেষণা সংযোজন করেছেন - তার উল্লেখ অনুযায়ী, এইচ.জি. কোহেন একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেন। তিনি দেখান যে, ১৪০০০ আলেমদের জীবনী থেকে ৪২০০ আলেমের পেশা সম্পর্কে তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কোহেন উল্লেখ করেন, এই ৪২০০ আলেমের মধ্যে:
- ২২% বস্ত্র ব্যবসা বা শিল্পে নিযুক্ত ছিলেন,
- ১৩% খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রির কাজে,
- ৪% গহনার ব্যবসায়,
- ৪% সুগন্ধি ব্যবসায়,
- ৪% চামড়াশিল্পে,
- ৪% বই ব্যবসায়,
- ৩% ধাতু শিল্পে,
- ২% কাঠের কাজ,
- ২% সাধারণ ব্যবসায়,
- ৯% অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।
এছাড়াও, ৩% ছিলেন মুদ্রা বিনিময় ও আর্থিক লেনদেনের কাজে এবং ২% দালালি ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এসব তথ্য ইসলামি ইতিহাসে ব্যবসা ও জ্ঞানের মেলবন্ধন এবং আকাবির-আসলাফদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে।
এই বিস্ময়কর বাস্তবতাকে আমরা ধারাবাহিক কয়েক কিস্তিতে গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে চাই, যেখানে আকাবির-আসলাফদের আর্থিক জীবন ও তাদের ব্যবসায়িক দক্ষতার কিছু দিক উন্মোচিত হয়েছে। বিভিন্ন যুগ ও অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ জন মুসলিম পণ্ডিতের বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০ জন বিশিষ্ট মুহাদ্দিসও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। তাঁরা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কীভাবে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন, তা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
বহু ক্ষেত্রেই আকারিব-আসলাফদের সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। বাস্তবে, ব্যবসায়ীদের বিষয়টি মুসলিম ফকিহদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ইসলামের সূচনালগ্নে মক্কার কুরাইশ গোত্র বাণিজ্যে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিল যে তারা সমগ্র আরব উপদ্বীপের অন্যান্য গোত্রের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। কুরআন আমাদের জানায়, তাদের দুটি বাণিজ্য.... (চলবে)
হাআমা/