মাস-তিনেক পরপর আলোচনায় আসে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। এর দানবাক্স খোলা হলে রীতিমতো গণমাধ্যমে খবরের হিড়িক পড়ে যায়। গতকাল শনিবারও খোলা হয়েছে পাগলা মসজিদের দান বাক্সগুলো। সবমিলিয়ে নয় কোটি ১৯ টাকা পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও আছে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ।
অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে- পাগলা মসজিদের বিপুল পরিমাণ এই অর্থ কোথায় খরচ করা হয়? দিন দিন এই মসজিদে দানের পরিমাণ শুধু বেড়েই চলেছে। প্রতি বারই রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু মুসলিমরাই নয়, অমুসলিমরাও এই মসজিদে অকাতরে দান করে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু তদারকির জন্য কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসককে সভাপতি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে সহসভাপতি এবং গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী, নেজারত ডিপুটি কালেক্টর (এনডিসি), সদর মডেল থানার ওসি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত।
এ ছাড়া সুশীল সমাজের পক্ষে একজন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পাগলা মসজিদের অর্থায়নে এলাকার অন্যান্য প্রাচীন মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়। এলাকার দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ ও অসচ্ছল পরিবারের জন্য পাগলা মসজিদ থেকে অনুদান দেওয়া হয়। লেখাপড়া, চিকিৎসা, অভাবী নারীর বিয়ের সময় সাহায্য করা এই মসজিদের গণমুখী কার্যক্রমের অংশ। ওয়াকফ এস্টেটের অডিটর দ্বারা পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়।
অডিটের পর প্রতি অর্থবছরে আয়ের ওপর ৫ শতাংশ ওয়াকফ প্রশাসন চাঁদা নিয়ে যায়। ব্যাংকে রাখা দানের টাকা থেকে মসজিদ-মাদরাসার ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা, আনসারের বেতন বাবদ প্রায় ২ লাখ, বিদ্যুৎ বিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মসজিদ-মাদ্রাসার গ্যাস বিল বাবদ প্রায় ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসায় অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা শুধু শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দান থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের। পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত।
মসজিদটিতে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু দৃষ্টিনন্দন মিনার। লোকমুখে শোনা যায়, একদা প্রমত্তা নরসুন্দা নদীর পানিতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের আবির্ভাব হয়। তার কল্যাণেই নদীর মধ্যে চর জেগে ওঠে। নদীর তীরবর্তী রাখুয়াইল গ্রামের এক গৃহস্থের গাভি নিয়মিত নদী সাঁতরে ওই দরবেশের ভাণ্ডে ওলানের দুধ দিয়ে আসত। এতেই গাভির দরিদ্র মালিক ও স্থানীয় লোকজনের অনেক বৈষয়িক উন্নতি হয়।
এমন আরও অসংখ্য কেরামতিতে বিমুগ্ধ মানুষজন ওই দরবেশের খেদমতে হুজরাখানা তৈরি করে। দরবেশের মৃত্যুর পর তার হুজরাখানার পাশেই পাগলা সাধকের স্মৃতিতে পাগলা মসজিদ নির্মিত হয়। তবে এই জনশ্রুতির ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আরেক জনশ্রুতি হলো, হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির এক নিঃসন্তান মহিলাকে জনগণ পাগলা বিবি বলে ডাকত। এ মহিলা নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে তা পাগলা বিবির নামে পরিচিতি পায়।
এনএইচ/