বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


জীবনযুদ্ধে যেভাবে সংগ্রাম করে টিকে আছে চেচনিয়ার মুসলিমরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: পূর্ব ইউরোপে এবং উত্তর এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ককেশাস পর্বতমালার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র চেচনিয়া। বর্তমান স্বাধীন চেচনিয়ার উত্তরে মূল রুশ ভূখণ্ড ও দাগিস্তান প্রজাতন্ত্র। পূর্বে দাগিস্তান। পশ্চিমে উত্তর উশিতিয়া ও এস্তোনিয়া।

দক্ষিণে ইঙ্গুশেতিয়া ও জর্জিয়া। ২০২০ সালের হিসাব মতে, তাদের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ লাখ। যার ৯৫ শতাংশেরও বেশি মুসলমান।

চেচনিয়া একটি তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল। আর এ কারণেই রাশিয়ার কাছে চেচনিয়ার গুরুত্ব এত বেশি। এই খনিজ তেলের বিপুল সম্ভারকে কেন্দ্র করেই চেচনিয়ায় গড়ে উঠেছে রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ারও) প্রধান পেট্রোলিয়ামজাত শিল্প।

সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনে ককেশাস অঞ্চলের সাতটি প্রদেশের মধ্যে চেচনিয়া ছিল একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র। এর আগে চেচনিয়াসহ গোটা অঞ্চলটি পরিচিত ছিল সংযুক্ত ককেশাস অঞ্চল নামে।

কিন্তু এই সংযুক্ত অঞ্চল মোটেই নিরাপদ ছিল না সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে। তারা জানত, এই সংযুক্ত অঞ্চলকে আয়ত্তে রাখা অত্যন্ত কঠিন। তাই এ ক্ষেত্রে সনাতন ব্রিটিশ পদ্ধতি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ প্রয়োগ করে তারাও। ১৯২৪ সালে এই অঞ্চলকে বিভক্ত করা হয় সাতটি প্রদেশে। এসব প্রদেশের মধ্যে চেচনিয়া একটি।

কিন্তু এর পরও চেচনিয়ার ভৌগোলিক পট পরিবর্তিত হয় বারবার। ১৯৪৪ সালে চেচনিয়া ইঙ্গুশেতিয়ার গোটা জাতিকে স্ট্যালিনের নির্দেশে পাঠানো হয় নির্বাসনে। তারই নির্দেশে চেচনিয়ার ভৌগোলিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। চেচনিয়া সংযুক্ত হয় অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে। কিন্তু ১৯৫৭ সালে ক্রুশ্চেভের নির্দেশে আবার পুনর্গঠিত হয় চেচনিয়া। এ ছাড়া ককেশাস অঞ্চলে চলতে থাকে লাগাতার ভাঙাগড়ার খেলা।

সোভিয়েত রাশিয়ার আগে জার শাসনামলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে চেচনিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান। ইমাম শামিল (রহ.)-এর নেতৃত্ব চেচনিয়া-দাগিস্তান একতাবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এর আগেও প্রায় তিন শ বছরের ইতিহাস সম্মিলিত প্রতিরোধেরই ইতিহাস।

১৭০০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বারবার এ অঞ্চলের মুসলিমরা বহু ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু তাদের ঈমানি শক্তি তাদের নিশ্চিহ্ন হতে দেয়নি।

১৯৪৪ সালে এখানকার মুসলিমদের সমূলে উত্খাত করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়, যেখানে বহু মানুষ মারা যায়। আধুনিক রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে রচিত সেবাস্টিয়ান স্মিথের বই ‘‘আল্লাহ’স মাউন্টেন’’-এর একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো—

১৯৯৫ সালের যুদ্ধে এএসপির সিনিয়র করেসপনডেন্ট সেবাস্টিয়ান স্মিথ চেচেন হিরো শামিল বাসায়েভের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাতে চেচনিয়ান মুসলিমদের ওপর রাশিয়ার গণহত্যার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়। বাসায়েভ বলেন, ১৯৪৪ সালে জোসেফ স্ট্যালিন কর্তৃক (মুসলিম) নারী, পুরুষ ও শিশুদের মধ্য-এশিয়ায় গণহত্যামূলক নির্বাসন দেওয়া হয়। সেই হত্যাযজ্ঞে প্রতি তিনজনে একজনের বেশি মানুষ টিকে থাকতে পারেনি।

স্ট্যালিন আমাদের বিতাড়িত করলে রাশিয়ানরা দখল করে নেয় আমাদের শূন্য ঘরগুলো। ওরা আমাদের কবরস্থানের ফলকগুলো উঠিয়ে সেগুলো রাস্তাঘাট, ব্রিজ, শূকরের খোঁয়াড় বানানোর কাজে ব্যবহার করে। এত অত্যাচারের পরও সেখানকার বীর মুসলিমরা আজও টিকে আছে, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এবং শত জুলুম-নির্যাতনও তাদেরকে তাদের ধর্ম ও ঈমান থেকে দূরে রাখতে পারেনি।

অপারেশন লেন্টিল

১৯৪৩ সালের ১৩ অক্টোবর ১ লাখ ২০ হাজার মুসলমানকে চেচনিয়া-ইঙ্গুশেতিয়ায় ব্রিজ সংস্কারের জন্য পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর ১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘রেড আর্মি দিবস’-এ জোসেফ স্ট্যালিনের অনুমতিক্রমে ল্যাভরেনটাই বেরিয়া তাদের সবাইকে পার্টি বিল্ডিংয়ে ডেকে আনল এবং জানিয়ে দেওয়া হলো জার্মানিদের সহায়তার অভিযোগে শাস্তিস্বরূপ তাদের সবাইকে নির্বাসিত করা হলো। গোটা জাতি থেকে পাঁচ লাখ মানুষকে সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানে নির্বাসিত করা হয়েছিল। নির্বাসিত এসব জনগণের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ ছিল শিশু। নির্বাসিত করার আগেই অনেককে শহীদ করা হয়েছিল, অনেককে নির্বাসনযাত্রায় শহীদ করা হয়েছিল, পরেও শহীদ করা হয়েছিল; কিন্তু সেগুলো হিসাবে আসেনি। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত নির্বাসিত এসব মুসলমান চেচনিয়ায় ফিরে যেতে পারেনি। এই অপারেশনকে ‘অপারেশন লেন্টিল’ বলা হয়।
খাইবাখ মুসলিম গণহত্যা

নির্বাসিত মুসলমানদের তাপ নিরোধক কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ায় অনেকেই যাত্রাপথে ইন্তেকাল করেছিলেন।

কিন্তু ভয়াবহ ও পাশবিক এক ঘটনা ঘটে গেল খাইবাখ নামক অঞ্চলের কাছে। পথিমধ্যে প্রায় ৭০০ নারী, শিশুসহ মুসলমান গ্রামবাসীকে সোভিয়েত জালিমরা তালাবদ্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফলে সবাই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে শাহাদাতবরণ করেন; এমনকি যাঁরা পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদেরও গুলি করে শহীদ করা হয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন

চেচেনদের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেন দুদায়েভ। চেচেনদের দমন করতে রাশিয়াকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। যুদ্ধে অতি উচ্চমানের অস্ত্র নিয়ে চেচেনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশিয়া। এতে চেচেনদের জনপ্রিয় নেতা ও প্রেসিডেন্ট দুদায়েভ ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল মিসাইল আক্রমণে শহীদ হন।

কয়েক বছরের যুদ্ধে চেচনিয়ার প্রায় ৩০ হাজার লোক শহীদ হয়। আহত ও পঙ্গু হয় অসংখ্য চেচেন। রাশিয়াকেও চড়া মূল্য দিতে হয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চেচেন নেতা আসলান মাসখাদভ রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির আওতায় চেচেনরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা না পেলেও অধিকতর স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। (সূত্র : সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘দ্য ন্যাশনাল.এই’ ও ‘আল-মুজতামা’)

১৯৯৪ সালের ২৬ নভেম্বরের পর রাশিয়া চেচনিয়ায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। লড়াকু মুসলমানদের দমনে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসন চেচনিয়ায় ৪০ হাজার সেনা পাঠায়। রুশ বাহিনীর আশা ছিল, দ্রুত বিদ্রোহীদের পরাস্ত করে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনির নিয়ন্ত্রণ নেবে।

কিন্তু পরাশক্তি রাশিয়া তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অবশেষে দুই মাস তীব্র লড়াইয়ের পর রুশ বাহিনী গ্রোজনি অধিকার করে। ফলে চেচেন স্বাধীনতাকামীরা গেরিলাযুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করে।

গ্রোজনি দখলের দুই বছর পর যখন বেসামরিক শহীদান নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারে পৌঁছায়, তখন রাশিয়া সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেয়। ১৯৯৭ সালে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে চেচেন স্বাধীনতাকামীরা এই অস্ত্রবিরতি প্রত্যাখ্যান করে রুশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।

ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক অভিযান চালায়। রাশিয়ান বাহিনী চেচনিয়ায় ঢুকে পড়ে। ওই রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযানের পরও চেচেনদের নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। ৯/১১ আমেরিকায় আক্রমণের পর রাশিয়া চেচেনদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০০৯ সালের এপ্রিলে রাশিয়া মুসলমান নিধনের এই সন্ত্রাসী আক্রমণের সমাপ্তি ঘোষণা করে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ