তুরাগ নদের তীরে গড়ে ওঠা বিশ্ব-মুসলিমের মিলনমেলা ইজতেমা মাঠের ধারাবাহিক আমলের অংশ ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ মাগরিব বয়ান। ধারাবাহিক আমলের এ অংশে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। বয়ানটি আওয়ার ইসলাম-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন নুরুদ্দিন তাসলিম।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের এখানে বসাকে কবুল করুন। এবং পৃথিবীর হেদায়েতের মাধ্যম বানিয়ে দিন। আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যাশা রাখতে হবে।হতে পারে আমাদের এই কষ্ট স্বীকার আমাদের ক্ষমা লাভের উপকরণ ।
একবার রাসুল সাঃ কোন শীতপ্রধান অঞ্চলে সফর করলেন। সে অঞ্চলের শীতের তীব্রতার তুলনায় সাহাবাদের পোশাক ছিল বেশ অপ্রতুল। তাই শীতের প্রকোপ থেকে বাচতে সাহাবারা গর্ত খুঁড়ে তাতে অবস্থান নিলেন। জামাতের পাহারার দায়িত্বে কেউ থাকলেন না। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাঃ এ অবস্থা দেখে ঘোষণা দিলেন: আজকের এই রাতে যে পাহারা দেবে, তার কষ্টের বিনিময় হবে তার জন্য আমার বিশেষ দোয়া।
এ কথা শুনে নবীপ্রেমিক এক সাহাবি সাথেসাথে রাজী হলেন। রাসুল সাঃ এর দোয়া লাভ করে ধন্য হলেন। পরক্ষণেই তার মতো বিশেষ দোয়া লাভের আশায় আরেক সাহাবী পাহারায় রাজি হলেন। রাসুল সাঃ তার জন্যও দোয়া করলেন। তবে প্রথমজনকে প্রাধান্য দিয়ে তার জন্য এক্টু কমিয়ে দোয়া করলেন। আল্লাহর রাস্তায় পাহারার কষ্টের বিনিময়ে সাহাবারা রাসুল সাঃ এর বরকতম দোয়া লাভ করলেন। সুতরাং এই মাঠে এসে যারা বিভিন্ন কষ্ট করছেন তারাও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার পাবেন।
আল্লাহ তায়ালার কাছে চাইতে হবে। সাথেসাথে আশা রাখতে হবে। নবুয়তের পাক জবানেও আল্লাহ তায়ালার কাছে চাওয়ার সাথেসাথে আশা রাখতে বলা হয়েছে। ইলিয়াস র বলেন আল্লাহ তায়ালার কাছে চাওয়ার পরও একিন না রাখাটা যেন মুনাফিকের আলামত। তাই আল্লাহ তায়ালার কাছে চাইতে হবে একিনের সাথে।
যে ব্যক্তি আমল করে। কিন্তু তার অন্তরে একিন থাকেনা, সে ফাসেক। নবুয়তের পাক জবানে উচ্চারিত হয়েছে: যে ব্যক্তি কষ্টে সবর ও সুখে শুকর করে, বিপদ-আপদে মহান রবেতে রাজী থাকে, সেই প্রকৃত মুমিন।
পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মে মানুষ কখনো অসুস্থ হয়। আবার কখনো সুস্থ থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে কেউ দরিদ্র, কেউবা ধনী। সামাজিক জীবনে কেউ দলিত, কেউ প্রভাবশালী। আবার ঋতু পরিক্রমায় শীত- গ্রীষ্মের ব্যবধানে কখনো দিন বড়। রাত ছোট। কখনো রাত বড়, দিন ছোট। রাত দিনের পরিবর্তনশীল এই নিয়মের আড়ালে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরিক্ষা করেন। যে ব্যক্তি এই পরিক্ষার অবস্থায়ও আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করে। সে কামিয়াব ।
সুখ-দুঃখ। হাসি-কান্না।বিপদ-আপদ। দরিদ্রতা। সব অবস্থা শেষ হয়ে যাবে এক সময়। কিন্তু এঅবস্থাগুলোতে ঈমানের কি হালত ছিল তার হিসাব থেকে যাবে আল্লাহ তায়ালার কাছে।
মানুষ সব বিষয়ের জ্ঞান রাখেনা। আল্লাহ তায়ালাই সর্বজ্ঞানী। তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলো তিনি আমাদের দান করেন। অকল্যাণকর বিষয়গুলো থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।
নবীদের আল্লাহ তায়ালা বিপদাপদ দিয়ে পরিক্ষা করেছেন। তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার হুকুমের উপর খুশি থেকেছেন। যেমন আইয়ুব আ: অসুস্থ অবস্থায় ধৈর্য্য ধারণ করে। আল্লাহ তায়ালার শুকর করেছেন। তাই কুরআনে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আল্লাহ তায়ালা। নবীজী মুহাম্মদ সাঃ- এর উপরও ভালমন্দ হালত এসেছে। অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। তিনি ধৈর্য্য ও শুকরের চরমপরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সুতরাং নবীদের সিফত এই ধৈর্য্য ও শোকর আমাদের অনুসরণীয়।
মানুষের অন্তরে ঈমান থাকলে সে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার বরকত হাসিল করে। রাসুল সাঃ একবার এক লোকের জানাজা পড়াচ্ছিলেন। পেছন থেকে কেউ একজন তার খারাবির কথা উল্লেখ করে তার জানাজা পড়াতে নিষেধ করলে। হুজুর সা উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, তার ভাল কোন আমলের ব্যাপারে তোমাদের কারো জানা আছে?
আল্লাহর রাস্তায় তার পাহারার ব্যাপারে একজন সাক্ষ্য দিল। নবীজী সাঃ তার জানাজা পড়ালেন এবং বললেন, লোকেরা বলছে, তুমি জাহান্নামি। আমি বলছি, তুমি জান্নাতি। শুধুমাত্র দিনের রাস্তায় পাহারা দেওয়ায় তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পেলেন। এই মাঠেও আমাদের সহ্য করা কষ্টগুলো বিফল যাবেনা। একদিন এর বিনিময়গুলো দেখে আমাদের হৃদয় -মন জুড়িয়ে যাবে।
দ্বীন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক হক রাস্তা। এই হকের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নবীদের পাঠিয়েছেন। তাই দ্বীনের উপর চললেই মানুষ হকের পথে থাকবে।
ইলিয়াস রঃ বলেন, দিনের রাস্তায় চলতে গিয়ে ক্ষুধা-ভয়সহ বিভিন্ন কষ্ট ও বিপদের মুখে যারা অটল থাকবে। প্রবাহমান নদ-নদী ও নয়ানাভিরাম বাগান সমৃদ্ধ জান্নাত তাদের জন্য অবধারিত। হাদিসে এরশাদ হয়েছে, জান্নাতকে সাজানো হয়েছে পৃথিবীর কন্টকাকীর্ণ বস্তুর আদলে। জাহান্নামকে প্রস্তুত করা হয়েছে খাহেশাতপূর্ণ বস্তু দিয়ে। সুতরাং খাহেশাতের বিপরিতে অবস্থানকারী জান্নাতি। খাহেশাতের তাবেদারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামী।
আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করে নবীদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে গিয়ে মানুষ যে কষ্টের মুখোমুখি হয়। তার বিনিময়ে সে মহান রবের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হবে। আবার আল্লাহর হুকুম পালনের বিনিময়ে আলাদাভাবে পুরস্কৃত হবে। হুকুম পালন ও পালন করতে গিয়ে অনুভূত কষ্ট। দুটার জন্য আলাদা আলাদা পুরস্কার পাবে মানুষ। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ, কাজ এবং কাজ করতে গিয়ে অনুভূত কষ্ট দুটোরই পারিশ্রমিক দেয়না। শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালা এটা করেন।
আল্লাহ তায়ালা কষ্টের পরে সুখ রাখেন। হুজুর সাঃ দাওয়াতের কাজের শুরুর দিকে যখন অমানুষিক কষ্টের মুখোমুখি হলেন।তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে শান্ত্বনা দিলেন সুরা আলাম নাশরাহের ভাষায় "দুখের পরে সুখ আছে"।
আল্লাহর কাছে দীন পছন্দনীয়। কুরআনের ভাষায় তাই বিবৃত হয়েছে “তোমাদের জন্য আমি দীনকে পছন্দ করেছি।”- (সুরা মায়েদা:৩।)
আমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পছন্দ করা এ দ্বীন আমাদের সফলতার চাবিকাঠি। মেহনতের মাধ্যমে এ চাবিকাঠি অর্জন করতে হবে। যারা এ দ্বীন হাসিলে মেহনত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য জান্নাতে একটি বিশেষ দরজা রাখবেন, যা দিয়ে শুধু তারাই প্রবেশ করবে।
এই অস্থায়ী দুনিয়ায় আমরা মুসাফির। আখেরাত আমাদের চিরস্থায়ী আবাস্থল। সেখানে আবাসনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে দাওয়াতের মাধ্যমে।
ফেরাউনের দরবারে একজন দ্বীনে এলাহী বিশ্বাসী ছিল। সে তার সহকর্মীদের ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার বিপরিতে চিরস্থায়ী আবাসের দাওয়াত দিয়েছিল। তাই আমাদেরও উম্মতকে চিরস্থায়ী আখেরাতের দাওয়াত দিতে হবে।
ঈমানের জিম্মাদারি দাওয়াত দেওয়া। এ জিম্মাদারির পুরস্কার অনেক বড়। হাদিসের ভাষায় ‘কালিমা পাঠকারী ততক্ষণ পর্যন্ত সোওয়াব পেতে থাকে। যতক্ষণ সে কালিমার হক আদায় করে।’ কালিমার হক হল নিজে আল্লাহর হুকুম মানা এবং অন্যকে দাওয়াত দেয়া।
সাহাবারা আমৃত্যু দাওয়াতের কাজ করার সংকল্প নিয়ে ঈমান গ্রহণ করতেন। আমাদের দুর্বল ঈমান এমন সংকল্প নিতে আমাদের ভয় দেখায়। আমরা ভাবি দাওয়াতের কাজে নিযুক্ত হলে ভবিষতের কী হবে। অথচ ভবিষ্যৎ তো রাব্বে কারিমের হাতে নির্ধারিত। পুরো পৃথিবী মিলে চেষ্ট করলেও তা টলাতে পারবেনা।
দোয়া মুমিনের অন্যতম হাতিয়ার। এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিশেষ হাদিয়া। সাহাবারা দোয়া করতেন এবং একিন রাখতেন। তাই আমাদেরও তাদের অনুসৃত পথে হেঁটে একিনের সাথে দোয়া করতে হবে এবং তারতিবের সাথে সাহাবাদের দেখানো পথে মানুষের মাঝে দাওয়াতের মেহনত করতে হবে। তাই যারা এখনো মেহনতে বের হওয়ার নিয়ত করিনি তারা নিয়ত করে ফেলি।...
আরএম/