বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ইভান বললেন, দুজনের সম্মতিতেই শারীরিক সম্পর্ক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রাজধানীর বনানীতে বাসায় ডেকে নিয়ে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার আসামি বাহাউদ্দিন ইভান এবং ধর্ষণের শিকার তরুণীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বনানী থানায় জিজ্ঞাসাবাদে দুজনই বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

৪ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন শনিবার দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত দু’জনকে মুখোমুখি জেরা করা হয়। পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়- মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে ইভান পুলিশকে জানিয়েছে, গত রমজানে ওই তরুণীর সঙ্গে তার বান্ধবী শারমীনের মাধ্যমে পরিচয় হয়। শারমীন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করে। মঙ্গলবারই প্রথম ওই তরুণীর (ধর্ষিত) সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক হয়। স্ত্রী-সন্তানদের অনুপস্থিতিতে তরুণী তার বাসায় আসে। যখন সে বাসায় আসে তখন তার বাবা-মা, ছোট ভাই এবং কাজের লোকেরা ঘুমিয়ে ছিল।

তবে এ বিষয়ে তরুণী জানায়, ১১ মাস আগে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় ইভানের সঙ্গে। গত ৪ মাসে তাকে বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেছে ইভান। তরুণীর দাবি, ইভান তাকে জন্মদিনের কথা বলে বাসায় ডেকে এনেছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ইভান বলেন, “আমি তাকে কোনো জন্মদিনের কথা বলিনি। বাসায় এ ধরনের কোনো আয়োজনও ছিল না। সে আমার কাছে টাকা ধার চেয়েছিল। আমিও টাকা দিতে রাজি ছিলাম। তাই তাকে বাসায় আসতে বলেছি। গভীর রাতে দুজনের সম্মতিতেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছি। সে নিজের ইচ্ছায় তার ড্রেস খুলে আমার টি-শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে।”

তবে ওই তরুণী বলেছেন, “অগের ধর্ষণগুলোর অন্তত দুটি ভিডিও চিত্র ইভানের কাছে আছে। ওই সময় ইভান দাবি করেন, সে ধর্ষণের কোনো ভিডিও করেনি। তবে তার কাছে একটি আপত্তিকর সেলফি আছে। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিকে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের (তরুণীর কথিত স্বামী) সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানান তরুণী।

তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো লোকের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তখন পুলিশ তাকে জানায়, “মিজানুর রহমানের সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।”

তরুণীর কথিত স্বামী মিজানুর রহমান জানান, ওই তরুণী আমার পরিচিত। দুই মাস আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে তার (তরুণী) সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আসলে বিবাহিত কিনা তা আমি জানি না। একজন ‘সিঙ্গেল মা’ হিসেবে আমি তাকে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য-সহযোগিতা করি। তাকে আমি বাসা ভাড়া নিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার স্বামী হিসেবে পরিচয় দিইনি। তবে গত এক মাসে ওই তরুণীর বাসায় ৪ দিন গিয়ে বাজার করে দিয়ে এসেছি।”

বারিধারা ডিওএইচএসের ২ নম্বর রোডের ২১৪ নম্বর বাড়ির মালিক কর্নেল (অব.) ওএফএম নাজিম উদ্দিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তার বাসায় দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান (যদিও একই এলাকার ৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে নিজের স্ত্রী নিয়ে থাকেন মিজান)। ওই ফ্ল্যাটে মিজান ও ওই তরুণী স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকেন। রাজও তাদের সঙ্গে থাকেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই তরুণী পুলিশকে জানায়, মিজান তাকে বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। মিজান তার স্বামী নন। রাজের কথা জিজ্ঞাসা করলেই পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তরুণীটি জানান পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রফিকুল ইসলাম।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইভান জানায়, সে ইয়াবাসহ নানা নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে। কিন্তু ঘটনার রাতে তিনি নিজে নেশা করেনি। এমনকি তরুণীকেও নেশা জাতীয় কোনো দ্রব্য খাওয়ায়নি। কিন্তু ওই তরুণী ইভানের সামনে পুলিশকে জানায়, তাকে একাধিকবার ইয়াবা খাইয়েছে ইভান। ইভানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই তরুণী তার (ইভান) বাসায় কোনো ব্যাগ বা টাকা-পয়সা রেখে আসেনি। দুটি মোবাইল ফোন রেখে এসেছিলেন, যা পুলিশ উদ্ধার করেছে। তবে তরুণীর দাবি, তার ব্যাগে তিনটি ড্রেস, দুটি জিন্স, একটি কুর্তা, তিনটি মোবাইল, চার্জার, সিমকার্ড, মেমোরি কার্ড এবং নগদ ১৫ হাজার টাকা ছিল। এসব রেখে ঘটনার রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়।

এগুলো সঙ্গে রাখার বিষয়ে তরুণী পুলিশকে বলেন, “আমি একজন আর্টিস্ট। পরদিন সকালে শুটিং ছিল। একটি বেসরকারি টিভির জন্য দুটি ধারাবাহিক নাটকে তার অভিনয় চলছিল। ওই রাতে যেহেতু ইভানের বাসায় থাকব, তাই সেখান থেকেই শুটিংয়ে যেতে চেয়েছিলাম। এজন্য সঙ্গে একাধিক পোশাক সঙ্গে রেখেছিলাম। তিনটি মোবাইলের মধ্যে একটি দিয়ে ইন্টারনেট চালাই এবং অন্য দুটি দিয়ে কথা বলি।”

জিজ্ঞাসাবাদের পর মিজানুর রহমান এবং রাজের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই তরুণী বলেন, “কি সব অদ্ভুত প্রশ্ন করেন? রাজ কে? মিজান কে? এসব আমি জানি না। আমি এসব নিয়ে মামলা করিনি। মামলা করেছি ধর্ষণ নিয়ে। আপনারা এ ঘটনাটি লেখেন। আমার অতীত নিয়ে টানছেন কেন? অতীত নিয়ে অনেক লিখেছেন। আর লিখবেন না। আপনারা লিখেন- আমি ধর্ষণের সঠিক বিচার চাই। ইভানের কাছে থাকা ভিডিও ফেরত চাই।”

পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমদিনের জিজ্ঞাসাবাদে দু’জনের কথাবার্তায় অনেক গরমিল পাওয়া গেছে। তাদের বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, তরুণী একেক সময় একেক কথা বলছেন। রাজ নামের ওই শিশুটি এখন কোথায় আছে তা জানার চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, তরুণীর বাবা সাবেক সেনাসদস্য। এখন গ্রামের বাড়িতে ব্যবসা করেন। তরুণীর মাও সেখানে থাকেন। তাদের খবর দেয়া হয়েছে। তারা থানায় আসলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। বনানী থানার ওসি বিএম ফরমান আলী জানান, তদন্তাধীন বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তদন্ত শেষ হলে এ নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

ধর্ষণের শিকার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের শিল্পী বুধবার দুপুরে বনানী থানায় একটি মামলা করেন। এর আগে মঙ্গলবার রাতে জন্মদিনের কথা বলে ওই তরুণীকে নিজ বাসায় ডেকে নেন ইভান। ওইদিন রাত ১টার দিকে বনানী ২ নম্বর রোডের ন্যাম ভিলেজের ৫/এ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার বি-১ নম্বর ফ্ল্যাটে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই তরুণীকে জোর করে বাসা থেকে বের করে দেয় ইভান। পরে সে পালিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার বিকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

‘বিবাহের প্রলোভনে আমাকে আগেও ধর্ষণ করে’

ধর্ষিত ওই তরুণী উল্লেখ করেছেন, ১১ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাদের বন্ধুত্ব হয়। এর সূত্র ধরেই তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো এবং ঘোরাঘুরি করতেন তারা। চার মাস আগে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ঘটনার দিন রাত ৯টায় ইভান ফোন করে ওই তরুণীকে জন্মদিনের কথা বলে তার বাসায় যেতে বলে এবং বলে, তার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।

“আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি তাহার (ইভান) মাকে জানাবে মর্মে জানায় এবং টেলিফোনে তাহার মায়ের পরিচয় দিয়ে একজন মহিলা আমার সঙ্গে কথা বলে আর আমি তাকে তাহার মা মনে করি। তারপর আমি আমার আপুর সঙ্গে কথা বলে রাত সাড়ে ১০টায় রিকশা করে তাহার বাসার সামনে পৌঁছালে সে আমাকে রিসিভ করিয়া তাহার বাসায় নিয়ে যায়।”

এজাহারে ওই তরুণী উল্লেখ করেন, “বাসায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কোনো আলামত দেখি না। আমি ভয় পাই এবং বাসায় আসতে চাই। কিন্তু সে বাসায় আসতে দেয় না। সে আমাকে রাতে খাবার খাওয়ায় এবং নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়।”

রাত দেড়টায় ইভান ধর্ষণ করে বলে তরুণী এজাহারে উল্লেখ করে বলেন, “আমি চিৎকার করিতে থাকিলে সে রাত সাড়ে ৩টায় আমার ব্যাগ রেখে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।”

“আসামি আমাকে এর আগেও বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণ করে। আমাকে ভয় দেখায়, মুখ খুলিলে তাহার নিকট আছে এমন খারাপ ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিবে”, এজাহারে বলেন তরুণী।

এর আগে গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদ, শাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অপর তিন আসামি হলেন শাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ, গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী ওরফে আজাদ।

শাফাতসহ সব আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন। এ মামলায় ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ