শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ৪ মাঘ ১৪৩১ ।। ১৮ রজব ১৪৪৬


যার পরশে ধন্য আমি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া ||

আমাদের শরহে তাহজিব পড়ানোর সময় ফকিহুল মিল্লাত রহ. হজ্বের সফরে গিয়েছিলেন। সফর থেকে ফেরার পর তিনি আমাদের দিয়ে যাওয়া সবক শুনতে চাইলেন। উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই শোনাতে পারল কেউ আবার শোনাতে পারল না। কেউ আংশিক বলল কেউ বলতে পারলো না। তখনকার সময়ে আমাদের ছাত্রদের মাঝে শরাহ শরুহাত মুতালা করার অনেক বেশি আগ্রহ ছিল। যখন আমার পড়া শোনানোর সিরিয়াল আসলো তখন আমি হুজুর যেই শরাহগুলো মুতালা করে এসে আমাদের সবক পড়িয়েছিলেন, আমি তার থেকে কিছু অতিরিক্ত শরাহ মুতালা করে এসে পড়া শুনিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে আমার প্রতি হুজুরের নেক দৃষ্টি পরে।

ক্লাস শেষে হাফেজ ওবায়দুল্লাহ নামে আমার এক সহপাঠী আমাকে এসে বল্লেন, হুজুর তোমাকে ডাকছেন। আমি হুজুরের সেই কামরায় গেলাম। এখানে মেহমানদের জন্য চা ও বেলা বিস্কুট-এর ব্যবস্থা ছিল। হুজুর আমাকে বললেন, আমার এখানে চা আর বেলা বিস্কুট-এর ব্যবস্থা আছে তুমি যখন চাও আসরের পর এসে খেতে পারো। এখান থেকে হুজুরের সাথে আমার সম্পর্ক ও গভীরতা শুরু হয়।

তখনকার সময়ে মাওলানা আমিনুল হক ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখতেন। খাতা দেখতে গিয়ে তিনি একবার দেখলেন পুরাতন ছাত্রদের তুলনায় আমি অনেক বেশি নাম্বার পেয়ে গেছি। তখন তার সন্দেহ হল, আমি হয়তোবা নকল করেছি। তিনি বিষয়টি ফকিহুল মিল্লাত রহ.কে জানালেন। হুজুর বললেন, ছাত্রের নাম কী? তখনকার সময়ে খাতার উপরে ছাত্রদের নাম লেখা থাকতো। আমার নাম জানানো হলে হুজুর বললেন, এই ছেলে নকল করেনি, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন এবং বিষয়টি আরো যাচাই করেন। আমাকে ডেকে যাচাই করার পর মাওলানা আমিনুল হক বুঝতে পারলেন আমি নকল করিনি। এভাবে আস্তে আস্তে হুজুরের সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হতে থাকে।

দরসের বৈশিষ্ট্য:

ফকিহুল মিল্লাত রহ বলেছিলেন আমি যখন প্রথম শিক্ষক হয়েছিলাম। আমাকে কিতাব ভাগ করে দেওয়ার পর আমি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বসার আগে কিতাব মুতালা করার পর রুমের দরজা বন্ধ করে নিজেই একবার সেই সবক-এর তাকরির করতাম। নিজে ঠিক মত আয়ত্তে এনে এরপর ছাত্রদের ক্লাসে বসতাম।

হুজুর আমাদের বলতেন, আমি যখন ক্লাস এর উদ্দেশ্যে বের হই। আমার পিছনে তোমরা যারা থাকবে কেউ আমার সাথে কথা বলবে না। ক্লাস থেকে ফিরে আসার সময় বলতে পারো।

ক্লাসে যাওয়ার সময় কেন কোন কথা বলবো না? জানতে চাইলে হুজুর বলেছিলেন, আমি ক্লাসে যাওয়ার আগে ছাত্রদের কি পড়াবো সে বিষয়ে মাথায় একটা ছক এঁকে নেই তাই তোমরা এ সময় কথা বলবে না।

প্রত্যেক উস্তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হুজুরের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, ক্লাসে ছাত্ররা কোন বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি অনেক খুশি হতেন।

এছাড়াও হুজুর ক্লাসে বসে সবকের সারসংক্ষেপ বলে দিতেন। কোন বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে তাও হল করে দিতেন। হুজুরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ক্লাসে ছাত্রদের চেহারা মুতালা করতেন। যদি বুঝতে পারতেন ছাত্ররা সবক বুঝেনি তাহলে তিনি আবারও ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে সহজ করে পড়াতেন।

হুজুরকে ছাত্ররা কোন প্রশ্ন করলে হুজুর তার উত্তর না দিয়ে যেতেন না। প্রশ্ন করলে সবসময় হুজুর উত্তর দিতেন। তবে উত্তর দেওয়ার পর কখনো যদি হুজুরের কাছে মনে হতো উত্তর ভুল হয়েছে তাহলে তিনি পরেরদিন এসে বলে দিতেন গতকাল যে উত্তর দিয়েছি তা ভুল ছিল উত্তরটি যেভাবে বলেছি সেভাবে নয় এভাবে হবে। এছাড়াও হুজুরের নিজের ক্লাসে কোন সবক পোড়ানোর পর যদি মনে হতো বিষয়টি ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাহলে বুঝতে পারার পর তিনি স্পষ্ট করে বলে দিতেন বিষয়টি আমি এভাবে পড়িয়েছিলাম কিন্তু তা আসলে এমন নয়।

হুজুর ক্লাসে ছাত্রদের পোড়া বুঝানোর সময় কোন ছাত্র যদি বলতো, হুজুর বিষয়টি আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবে নয় এভাবে হবে। তখন হুজুর তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। শুনে চিন্তাভাবনা করে যদি ছাত্রের বিষয়টি সঠিক হতো তিনি সবার সামনেই অকপটে বলে দিতেন সে যা বলেছে সেটাই সঠিক।

তিনি ছাত্রদের সহজ সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তার ক্লাসে মেধাবী ছাত্রদের পাশাপাশি দুর্বল শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য অসাধারণ উপমা দিতেন তিনি। যেমন কোন বিষয়টি আগের কিতাবের সাথে সম্পর্ক থাকলে তিনি সেটি খুব ভালোভাবে উদাহরণ টেনে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। যেমন শরহে জামির কোন কিতাব পড়াতে গেলে এর কোন মাসয়ালার সম্পর্ক নাহবেমীর কিতাব-এর সাথে থাকলে সেখান থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে মেছাল নিয়ে আসতেন। এভাবে একেবারে নিচের ক্লাসের কিতাব থেকে মেছাল দেওয়ার কারণে যারা একটু কম মেধার ছাত্র তারাও বিষয়টি সহজে বুঝতে পারে।

হুজুরের কাছে আমরা সুনানে আবু দাউদ পড়েছি। পড়ানোর সময় হুজুর বলেছিলেন, যখন তিনি দেওবন্দে আবু দাউদ শরীফ পড়েন তখন জানতে পেরেছিলেন কোন মহিলার তিনটি সন্তান মারা গেলে তার জন্য সুসংবাদ রয়েছে। সে সময় তিনি দোয়া করেছিলেন তার যেন তিনটি সন্তান মারা যায়। এরপর হুজুর যখন বিয়ে করলেন দেখা গেল, একে একে তার তিনটি সন্তান জন্মের পরে মারা গেল। এসব দেখে হুজুরের আম্মাজান অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং আফসোস করেন আহা! আমার ছেলের সন্তান হচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে। এরপর  চতুর্থ সন্তান গর্ভে আসলে হুজুর তার আম্মাজানকে বললেন, আম্মা এবার আর আমার সন্তান মারা যাবে না। কারণ আমি সুনানে আবু দাউদ-এর সবক পড়ার সময় সুসংবাদের অধিকারী হতে দোয়া করেছিলাম আমার তিন সন্তান যেন মারা যায়।

শিক্ষক হিসেবে অনন্য ছিলেন ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান। ছাত্রদের তরবিয়তের জন্য তিনি সবসময় শাসন করতেন। আমাকে তিনি পটিয়া মাদ্রাসার নায়েবে মুফতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি শিক্ষক হওয়ার পর একদিন তামরীন করে তাকে দেখাচ্ছিলাম। এক তামরীন-এ ভুল হওয়ায় তিনি আমাকে ছাত্রদের সামনে থাপ্পড় দিলেন। শাসনকে সব সময় তিনি আগে রাখতেন। একটু কড়া শাসন করতেন। তবে শাসনের কারণে কোনো সমস্যা হয়ে গেলে পরবর্তীতে ডেকে আবার আদর করতেন।

আরেকবারের ঘটনা। তখন আমি নতুন বিয়ে করেছিলাম। বৃহস্পতিবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছি। হুজুর হঠাৎ আমাকে বললেন, ফতোয়ার কাজ আছে বাড়িতে যাওয়া যাবে না। আমি রাতে বেলা ফতোয়ার কাজ শেষ করে হুজুরকে দেখালাম। তবে হুজুর যেহেতু বলেছিলেন আজকে বাড়িতে যাবে না তাই সেদিন আর যাইনি। পরদিন শুক্রবারে বাড়িতে গিয়েছিলাম। অন্যান্য সময় শনিবারে চলে আসি তবে এবার আমি সোমবারে বাড়ি থেকে আসি। সরাসরি হুজুরের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বকা দিতে পারেন তাই আমি একটু কৌশল অবলম্বন করলাম। মেহমানখানায় মেহমান এসেছিলেন তখন মেহমানের সামনে গিয়ে আমি হুজুরকে সালাম দিয়ে আবার চলে আসি যেন হুজুর আমাকে আর বকা দিতে না পারেন।

ফকিহুল মিল্লাত এর হাতে বাংলাদেশে প্রথম ফতোয়া বিভাগ পটিয়া মাদ্রাসায়:

হুজুর পটিয়া মাদ্রাসায় দারুল ইফতার পাশাপাশি তাখাসসুস ফিল হাদিস বিভাগ প্রথম চালু করেন। আদব বিভাগকে সমৃদ্ধ করতে হাজী সাহেব হুজুর  ফকিহুল মিল্লাতের পরামর্শে সুলতান যওক নদভীকে নাদওয়াতে এ বিষয়ে পড়াশোনা করানোর জন্য পাঠান।

বহু আগে থেকেই বাংলাদেশ মানুষ ফতোয়া চর্চা করত, ফতোয়া দিতেন তবে ফতোয়া বিষয়ে ছাত্রদের অভিজ্ঞ করে তোলার কোন বিভাগ ছিল না। দেওবন্দে অনেক আগেই ফতোয়া বিভাগ খোলা হয়েছে। বাংলাদেশে অনেকেই দাওরা পড়ে ফতোয়া দিতেন। মানুষ মনে করতেন দাওরা পড়ে ফতোয়া দেওয়ার উপযুক্ততা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে দাওরা পড়ে এমন যোগ্যতা অর্জন হয় না, তাই এ বিষয়টি নিয়ে হুজুর খুব চিন্তিত ছিলেন।

ভারত ভাগের আগে বাংলাদেশ থেকে ছাত্ররা দেওবন্দে গিয়ে ফতোয়া পরে আসতো। এর পর করাচি-সহ পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ফতোয়া পড়তো। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে গিয়েও ফতোয়া শেখার সুযোগ আর থাকলো না। তাই হাজী ইউনুস সাহেব রহ.-এর সাথে পরামর্শ করে ১৯৭৪ সালে হুজুর পটিয়াতে ফতোয়া বিভাগ খুলেন। আমি ৭৬ /৭৭ সালে এই বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলাম।

ফতোয়া বিভাগকে সমৃদ্ধ করতে হুজুর আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। পটিয়া মাদ্রাসায় এ নিয়ে ব্যাপক কাজ করেছেন। এরপর যখন তিনি সেখান থেকে চলে আসেন হুজুরকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি যেন বড় কোন প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন যেখানে কিতাবখানার সব ক্লাস থাকবে। কিন্তু হুজুর বলেছিলেন আমার বিষয় হলো ফিকহ। আমি এটা নিয়ে কাজ করব। তাই তিনি প্রথমেই বসুন্ধরায় ফেকহা বিভাগ খুললেন। হুজুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাখাসসুস-এর বিভাগের জিম্মাদার অন্য কোন বিভাগে ক্লাস করাবেন না। তিনি বলতেন, এটি আমাদের দেশে নেই তবে অন্যান্য দেশে চালু রয়েছে। কারণ তাখাসসুস-এর উস্তাদকে এখানেই স্বতন্ত্রভাবে সময় দিয়ে ছাত্রদের পেছনে মেহনত করতে হয়। এই বিভাগের জিম্মাদারকে অন্য কোন বিভাগের দায়িত্ব দিলে তিনি সেখানেও মনোযোগ দিবেন। এর ফলে তাখাসসুস-এর মূল বিষয় ও উদ্দেশ্যে ঘাটতি আসবে।

ছাত্রদের ফতোয়া বিষয়ে আগ্রহী করতে তুলতে পরবর্তীতে হুজুর জাতীয় মুফতি বোর্ড নামে একটি বোর্ড খুলেন। কারণ তৎকালীন সময়ে দেখা যেত ভালো ছাত্র যারা তারা ফতোয়া পড়তে চাইতো না মানতেক বা এজাতীয় বিষয়গুলোতে তাদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। ছাত্রদের ফতোয়া বিষয়ে আগ্রহী করতেই হুজুর এই উদ্যোগ নেন।

ফতোয়ার ক্লাসে ফকিহুল মিল্লাত এর বৈশিষ্ট্য:

অন্য দশজন ফতোয়ার শিক্ষক থেকে ফকিহুল মিল্লাত রহ.-এর বৈশিষ্ট্য ছিল ফতোয়া সংক্রান্ত বিষয় কোনটি আলোচনার যোগ্য কোনটি আলোচনা যোগ্য নয় এ বিষয়টি তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতেন। একটা শব্দ যেনো বেশি লেখা না হয় এ বিষয়ে তিনি খুব সর্তকতা অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন। প্রত্যেকটা শব্দ মেপে মেপে লেখার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এছাড়া কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা একটি অপরটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ একটাকে অন্যটা থেকে সহজে পার্থক্য করা যায় না এ বিষয়টিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। কোন বিষয়টি সাদৃশ্যতা থাকার পরেও কিয়াস মাআল ফারেগ এ বিষয়টি তিনি সহজেই বুঝতে পারতেন।

ফতোয়ার কিতাব-এর সূত্রের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন কিতাবের থেকে আমাদের আকাবির আসলাফের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি বলতেন, আকাবীরগণ আমাদের কিছুটা কাছাকাছি সময়ের এবং এই অঞ্চলের তাই ফতোয়ার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ।

যুগ জিজ্ঞাসার ব্যাপারে সচেতনতা:

সময়ও যুগ জিজ্ঞাসার ব্যাপারে হুজুর ব্যাপক জ্ঞান রাখতেন। বগুড়ার আজিজ উদ্দিন লিমিটেড-এর হাজী বশির-এর ব্যবসা বাণিজ্যের কার্য কারবারের শরিয়া উপদেষ্টা ছিলেন হুজুর। তাই তখন থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং এ বিষয়গুলোতে জ্ঞান রাখতেন তিনি।

ইসলামী ব্যাংকের ১০ জন শরিয়া উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমে হুজুরের নাম ছিল না । ব্যাংকের শরিয়া উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য তার থেকেও ফেস ভ্যালু কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আরো হুজুরের তখন খুব একটা পরিচিত ছিল না।তবে হাজী ইউনুস সাহেব হুজুর সে সময় পুরো কওমি অঙ্গনের অভিভাবক ছিলেন। তাই তাকে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া উপদেষ্টার ১০ সদস্যের একজন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

হাজী সাহেব হুজুর যখনই ব্যাংকের কোন কনফারেন্সে যেতেন সাথে ফকিহুল মিল্লাতকে নিয়ে যেতেন। এভাবে কয়েকবার যাওয়ার পর একবার হাজী সাহেব কোন কারণে যেতে পারলেন না তখন একটি চিঠি লিখে ফকিহুল মিল্লাত রহ,কে ব্যাংকের কনফারেন্স এ পাঠালেন। ব্যাংকের লোকজন কোন আপত্তি করল না কারণ তাদের যুগ সচেতন ফকিহ দরকার ছিল তারা তা পেয়ে গিয়েছিল। উম্মতের জন্য যে বিষয়টি সহজ হবে হুজুর ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তাকেই প্রাধান্য দিতেন।

পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকের দ্বিতীয় কাউন্সিলে হুজুরকে আর রাখা হয়নি। এর দুটি কারণ ছিল প্রথমত পটিয়া মাদ্রাসার সাথে হুজুরের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণ ছিল, সমসাময়িক যুগ সচেতন মাসয়ালা দিলেও তাদের সাথে হুজুরের মেজাজ মিলতো না। তবে হুজুর সেখান থেকে চলে আসার পর তারা আফসোস করেছিল এমন রতœ ক হারানোর কারণে। ইসলামী ব্যাংক থেকে চলে আসলেও পরবর্তীতে হুজুর আরো বিভিন্ন ব্যাংকের শরিয়া বোর্ড-এর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে হুজুর নিজের ছেলে শাএহদ রাহমানীকে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন। এ বিষয়ে নিজেও বিভাগ খুলেছেন। মুফতি তাকি উসমানীকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ১০ দিনের কোর্স করেছিলেন। সেই করছে আমি নিজেও অংশগ্রহণ করেছিলাম।

ছাত্র গড়ার কারীগর:

ছাত্রদের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন তিনি। পটিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরুর আগে মহেশখালীর এক মাদ্রাসায় তিন বছর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি আমি। যে বছর পটিয়া মাদ্রাসায় আমি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হই সে বছর মহেশখালীর মাদ্রাসাতে আমাকে মেশকাত কিতাব দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি এখানে চলে আসি। এখানে আসার পর আমাকে নিচের দিকের ক্লাস দেওয়া হয়। ক্লাস শুরুর তিন চার মাস পর হুজুর একদিন আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোমাকে তো নিচের দিকে ক্লাস দিয়েছি আমি, হাজী সাহেব, হুজুর ইমাম সাহেব হুজুর উপরের কিতাব দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি নিজেই তোমাকে নিচের কিতাব দিয়েছি। এনিয়ে ওস্তাদরা বিভিন্ন কথা বলছেন, আবার তুমি নিজেও মনোক্ষুন্ন। আমি তোমাকে নিচে কিতাব দেওয়ার কারণ হলো, আমি তোমাকে প্রথমে অভিজ্ঞ মুফতি বানাতে চাচ্ছি। এ কারণে তুলনামূলক নিচের দিকে কিতাব দিয়েছি যাতে তুমি ফতুয়া বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারো। ফতোয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ হলে পরবর্তীতে তুমি মুহাদ্দিসও হতে পারবে। কিন্তু আগেই মুহাদ্দিস হলে পরবর্তীতে আর অভিজ্ঞ ফকিহ হতে পারবে না। ছাত্রদের মনে কষ্ট পাওয়ার বিষয়টিও তিনি খুব মনোযোগের সাথে বিবেচনা করতেন।

তৎকালীন সময়ে ছাত্রদের মাঝে দাওরা ফারেকের পর ইফতার না পড়ে ফুনুনাত পড়ার আগ্রহ ছিল। আমাদের যে দাওরার ব্যাচ ছিল ফারেগের পর রমজানে আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম রমজানের পর পরই আমরা অন্য বিভাগে ভর্তি হয়ে যাব ইফতা বিভাগে নয়। কারণ হুজুর আমাদের ইফতা বিভাগের টানার চেষ্টা করবেন। রমজানের পর আমার অন্যান্য সাথীরা ফুনুনাতে আলিয়াতে ভর্তি হয়ে গেলেন। কোন কারনে আমি দেরি করে আসলাম। তখন হুজুর বগুড়াতে বিশেষ কোনো সফরে ছিলেন। সফর থেকে আসার পরে ফতোয়া বিভাগ-এর খবর নিলেন। জানতে পারলেন হুজুরের টার্গেটের যে ছাত্ররা ছিল তাদের অধিকাংশই অন্যান্য বিভাগে ভর্তি হয়ে গেছে। শুধু আমি রয়ে গেছি। হুজুর তখন সুলতান যওক ও মোজাফফর সাহেবকে আমাকে বুঝাতে বললেন। তিনি নিজেই বুঝাতে আসলেন না, কারণ হিসেবে বললেন, আমি বুঝাতে গেলে সে জেদ করে বসবে আপনারা বুঝান। কিন্তু আমি কোন ভাবেই তাদের কথা মানতে প্রস্তুত নই। উল্টো আমি হুমকি দিলাম, আপনারা আমাকে ফুনুনাতে ভর্তি না নিলে আমি হাটহাজারীতে গিয়ে এই বিভাগে ভর্তি হব।

তখন ফকিহুল মিল্লাত নিজেই বললেন, আচ্ছা থাক সে যেহেতু ফুনুনাত ছাড়তে চাচ্ছে না তাহলে, সে ফুনুনাতে ৪ ঘন্টা করবে আর ইফতা বিভাগে দুই ঘন্টা করবে। তবে তার সিট থাকবে ইফতা বিভাগে। আমি বললাম সিট তো বন্টন হয়ে গেছে। হুজুররা বললেন কোন ব্যাপার না, সিট আমরা বন্টন করি, আমরা তোমার সিট ফতোয়া বিভাগ করে দিব। এরপর হুজুর আমাকে খারেজী ঘন্টা করানোর জন্য দুজন ওস্তাদ ঠিক করেন। এরপরও তিনি আমাকে ফতোয়া বিভাগে পড়ালেন। আজ এ বিষয়টিতে আমি শুকরিয়া আদায় করি, যদি হুজুর এভাবে ইফতা না পড়াতেন তাহলে আমার জীবনের গতি অন্যদিকে ঘুরে যেত।

তৎকালীন সময়ে আমাদের এক ভাই ছিলেন যিনি ফুনুনাতের অনেক ভালো ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানের শাইখুল হাদিস তিনি। তিনি একদিন বললেন, ৪ বছর ফুনুনাত পড়েছি কিন্তু তা কোন কাজে আসলো না।

পটিয়া মাদ্রাসায় দাওরা ইফতা পড়ার পর আমি যখন মহেশখালীতে তিন বছর খেদমতে ছিলাম তখন পটিয়া মাদ্রাসার দারুল ইফতায় যেসব প্রশ্ন আসত তার একটা ফটোকপি হুজুর রেখে দিতে বলতেন। এরপর আমি যখন পটিয়াতে আসতাম হুজুর আমাকে প্রশ্ন দিয়ে বলতেন, এই প্রশ্নের উত্তর তুমি তোমার মত করে লিখবে এবং আমার কাছে পাঠাবে। আমি নিজের মতো করে জবাব দিয়ে হুজুরের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। সেখানে কোন ভুলত্রুটি থাকলে হুজুর সংশোধন করে দিতেন। এভাবে পটিয়া মাদ্রাসায় এক বছর ও মহেশখালীতে আমার শিক্ষকতার তিন বছর তিনি আমাকে দিয়ে ফতোয়ার অনুশীলন করিয়েছিলেন। তার এই ঋণ কখনো শোধ হওয়ার মতো নয়। আজীবন আমি হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞ।

হজের সফর:

আমার জীবনে প্রথম হজের সফর হয়েছিল হুজুরের সাথে ১৯৯২ সালে। হুজুর হজ্বের সফরে আমাদেও বিভিন্ন উপদেে দিয়েছিলেন, এর মধ্যে একটি হলো, আরাফার ময়দানে যাওয়ার আগে কঠিন ইবাদত করবে না। আরাফার ময়দান থেকে ফিরে এসে যত পারো কঠিন ও ভারী ইবাদত করবে।

এর কারণ জানতে চাইলে হুজুর বলেছিলেন, আরাফার ময়দানে যাওয়ার আগে ভারী ইবাদত করলে পরবর্তীতে এর কারণে প্রধান ইবাদতের ছুটে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।

এছাড়া তিনি বলেছেন হজ্বের সফরে এসে কারো হাদিয়া গ্রহণ না করা। হাদিয়া গ্রহণ করলে পরবর্তীতে হাদিয়াদাতা দেশে থাকা তার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের জন্য বিভিন্ন জিনিস পাঠাতে পারে। এতে করে সফরের কষ্ট বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

তিনি হজ্বের সফরে এসে কারো খাবারের দাওয়াত গ্রহণ করতেন না। তিনি বলতেন আমি এখানে দাওয়াত খাওয়ার জন্য আসেনি।

অনেকেই হজ্বের সফরে গিয়ে সবসময় এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। হুজুর এমন ছিলেন না। তিনি বন্ধু-বান্ধব ও আশপাশের মানুষদের সাথে কথা বলাকেও  ইবাদত মনে করতেন।

যেই ইসলামী মহাসম্মেলন হয় এটা প্রথমে শুরু করেছিলেন মুফতি ইজহার। তবে তিনি একা কুলিয়ে উঠতে না পারায় সহযোগিতা নিয়েছিলেন হাজী সাহেব হুজুরের। হাজী সাহেব হুজুরকে এ বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দিতেন ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান রহ.।

মহাসম্মেলনের পর হুজুর মাদ্রাসার প্রত্যেকটি রুমে রুমে একটি সম্মেলন করেন এবং পরবর্তীতে প্রত্যেক জায়গায় সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। প্রথমে শুধু চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একটি মহাসম্মেলন হত পরবর্তীতে তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সম্মেলনকে ব্যাপকতা দেওয়ার ক্ষেত্রে হুজুরের সহযোগিতা ছিল উল্লেখযোগ্য।

হুজুর মাদ্রাসায় শিক্ষক নেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় যোগ্যতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতেন। কখনো ব্যক্তিগত ভালোলাগা ও সম্পক-এর্র কারণে কাউকে প্রতিষ্ঠানে সুযোগ দিতেন না। যেন এ কারণে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমে কোন ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়।

হুজুর প্রথমে মাদ্রাসার বাহির থেকে খেতেন। এরপর হাজী সাহেব ও হুজুর মাদ্রাসায় খেতেন। আলি বিন সালেহ-এর খরচে মাদ্রাসায় হুজুরের জন্য আলাদা রান্না হত। কিন্তু তিনি সেই রান্না করা খাবার খাওয়ার আগে মাদ্রাসায় ওস্তাদ ও ছাত্রদের জন্য যে রান্না হতো তা নিজের জন্য আনতে বলতেন। সেটা আগে খেয়ে দেখতেন রান্না কেমন হয়েছে। এরপর বাবুর্চিকে ডেকে বলতেন রান্নায় অমুক অমুক সমস্যা আছে এটা ঠিক করতে। বোর্ডিং বিষয়ে তার  দায়িত্ব ছিল না তবুও তিনি ছাত্রদের রান্না করা খাবার ঠিক হচ্ছে কিনা, সুস্বাদু হচ্ছে কিনা এসব খোঁজ রাখতেন।

একবার হুজুরের তত্ত্বাবধায়নে মাদ্রাসায় অনেক ভালো খাবার দেওয়া হচ্ছিল। একজন জিজ্ঞেস করলেন এত ভালো খাবার দিচ্ছেন কেন? হুজুর বললেন ভালো খাবার না দিয়ে কি করব। ফান্ডে এতগুলো যাকাতের টাকা পড়ে আছে এগুলো খরেচ না করলে তো বরকত আসবে না। তাই ছাত্রদের ভালো খাবার খাইয়ে নতুন বরকতের ইন্তেজাম করছি।

হুজুর মাদ্রাসার মোটামুটি সব সেক্টর দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বপ্রথম নায়েবে নাজেমে তা'লীমাত ছিলেন। তখন নাজেমে তা'লীমাত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ইমাম আহমদ সাহেব। তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার পর হুজুর এ দায়িত্ব পান। এরপর মুঈনে মুহতামিম ছিলেন। মুফতি ইব্রাহীম সাহেবের ইন্তেকালের পর রঈসে দারুল ইফতা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাদ্রাসার কেশিয়ার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

লেখক: প্রধান মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রাম।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ