।। মাওলানা আব্দুর রহমান সিলেটী ।।
সহীহ বুখারী শেষ করার তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ!
যাঁরা এই উম্মতের সবচেয়ে বা-কামাল মনীষী ছিলেন, তাঁরা সহীহ বুখারী পড়েছেন। পড়িয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মধ্যে ঐ ধরণের কোনো যোগ্যতা নেই। এটা মুখের কথা নয়, বাস্তবতা।
তবু আল্লাহ তাআলা পড়ার তাওফিক দান করেছেন। এর শোকর আদায় করার উপযুক্ত ভাষা নেই। শুধু বলি- اللهم لك الحمد ولك الشكر
এই যে দ্বীন শেখার ও বোঝার সিলসিলাতুয যাহাব- স্বর্ণধারা; যা সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে নিয়ে উলামায়ে দেওবন্দ পর্যন্ত এসেছে, তার সাথে যুক্ত হওয়া মহা সৌভাগ্যের বিষয়। আমরা নিজেদেরকে এই সোনালী ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি- এটা আমাদের বড় পাওয়া। এই আমরাও ইনশাআল্লাহ সেই নূরানি ধারার একেকটা বিন্দু-
اللهم لك الحمد كله ولك الشكر كله، اللهم لك الحمد كما ينبغي لجلال وجهك وعظيم سلطانك-
রব্বে কারীমের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ধারার সাথে যুক্ত রাখেন। এই ধারার সকল ফুয়ূয ও বারাকাত দান করেন, আমীন।
এই ধারা থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার জন্যে আমাদের কিছু সিফাত (গুণ) অর্জন করতে হবে:
এক. নিজেকে মওত পর্যন্ত তালিবে ইলম মনে করবো।
তালিবে ইলম ( জ্ঞান অন্বেষী) একটা লকব। একটি অভিধা। মৃত্যু পর্যন্ত এই লকব নিজের মধ্যে ধারণ করবো এবং অন্তরে লালন করবো। এটাকে নিজের জন্যে গর্বের মনে করবো। অন্তরে সর্বদা এ কথা জাগরুক রাখবো যে, আমি একজন তালিবে ইলম। আমার কাজ ইলম তলব করা। ফানা ফিল ইলম হওয়া। ইলম-অন্তপ্রাণ হওয়া।
প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের প্রয়োজনে মানুষ হয়ত আমাকে বলবে- ইনি মুদাররিস, ইনি মুফতি, ইনি মুহাদ্দিস। এটি তাদের বিষয়, ইন্তিজামী প্রয়োজনে বলছে। কিন্তু আমার উপলব্ধি থাকবে- আমি নিতান্তই একজন তালিবে ইলম; আমি মুদাররিস তালিবে ইলম, হয়তো আমি মুফতি তালিবে ইলম...। এই অনুভূতি অন্তরে ধারণ করবো। তাহলে ইনশাআল্লাহ ইলমের প্রতি শওক-যওক বাড়বে। ধীরে ধীরে ইলম ফাহম আসবে। প্রতিদিন ইলম ও ফাহমে ইযাফা হতে থাকবে। মুহাসাবা করতে হবে, আজ কী পরিমাণ ইলম বৃদ্ধি পেল। যদি না বাড়ে তাহলে خسارة (ক্ষতি)!
দুই. ফোকাহায়ে আবেদীনের সাথে জুড়ে থাকবো।
ইলম ও ফাহম কার কাছ থেকে নিবো? কোন উৎস থেকে গ্রহণ করবো? ফিকরে নিরাপত্তা কীভাবে আসবে? ফাহাম কীভাবে সালীম হবে?
এটার জন্যে পদ্ধতি হলো- حيث ما كنت كن قرب فقيه ‘যেখানেই থাকো, একজন ফকীহ ফিদ দ্বীনের নিকটে থাকো।’ তাঁর সংশ্রব গ্রহণ করো। তাঁর কাছ থেকে ইলম ও ফাহম হাসিল করো। তাঁর বয়ান-আলোচনা শুনো। তাঁর সঙ্গে মশওয়ারা করো। তাঁর লিখিত কিতাব পড়ো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- شاوروا الفقهاء العابدين
‘ইবাদাতগুজার ফকীহগণের মশওয়ারা নাও।’
মশওয়ারা মানে- ইলমী মশওয়ারা; শুধু জাগতিক-পারিবারিক বিষয়ে মশওয়ারা নয়। এটা তো করবোই। মূলত ইলমী বিষয়ে মশওয়ারা করবো, যা ইমাম আবু হানীফা রহ. করেছেন। ইলমী বিষয়ে মশওয়ারার জন্যে তিনি চল্লিশ সদস্যের ফিকহী বোর্ড গঠন করেন। এই বোর্ডের সাথে মাশওয়ারা করেই তিনি ফিকহে হানাফী পত্তন করেছেন।
নিজের বুঝের ওপর অতি ইতেমাদ, মোহমুগ্ধতা এখন বড় ফেতনা। যেটা বুঝলাম, সেটাই প্রচার করে দিলাম। কোনো মশওয়ারা নেই, মোযাকারা নেই, মনে আসল আর বলে দিলাম। অথচ জরুরি ছিল- আমার সামনে যেসব ফকীহ উলামায়ে কেরাম আছেন, তাঁদের তাওছীক গ্রহণ করা। এটা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ- ফুকাহায়ে আবেদীনের সাথে মশওয়ারা করো, তোমার ফিকির সঠিক কি না- যাচাই করো।
এখন ফিকরের কোনো নিরাপত্তা নেই। চতুর্মুখী হামলা হচ্ছে চিন্তাধারার উপর। আমি নিজের ইলম ও ফাহমকে নিরাপদ রাখার জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহ না করুন বাতিলে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি, বে-উসুলী আমাকে গ্রাস করে নিতে পারে। তাই বলব- যদি ফিকরের সালামতি ও নিরাপত্তা (الأمن الفكري) চাও, তাহলে ফকীহ ফিদদ্বীন-এর সোহবতে যাও। যাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ আছে, গভীর সমঝ আছে, তাঁদের সোহবতে থাকো। এর জন্য কোশেশ করো। দোয়া করো।
আহলে ইলমের সাথে চলাফেরা উঠাবসা হওয়া সমঝদারির আলামত- من فقه الرجل ممشاه ومدخله ومخرجه مع أهل العلم এই বিশেষণ অর্জন করো।
তিন. মুসলিহ হওয়ার আগে নিজে সালেহ হওয়ার ফিকির বেশি করবো।
উর্দুতে একটা কথা আছে- پیر نابالغ کسی کام کا نہیں ہوتا অর্থাৎ ‘যে পাঁকার আগে পেঁকে যায়, সে কোনো কাজের হয় না।’ সালেহ না হয়ে মুসলিহ হওয়ার ধান্ধা- এর নাম ‘পীরে না-বালেগ’।
স্বাভাবিক নিয়মে প্রত্যেক জিনিষ পাঁকার একটা সময় আছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রতিটি বস্তু পরিপক্ক হওয়ার একটা মেয়াদ আছে। যে এই সময় আসার আগে পেঁকে যায়, সে কাজের হয় না। সময়ের আগে পেঁকে গেছে বা মুরব্বী বনে গেছে, এমন ‘পীরে না-বালেগ’ কাজের হয় না। ফেতনা আর বিভ্রান্তি ছড়ায়। নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, উম্মতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। তোমরা পীরে নাবালেগ হয়ো না, সময়ের আগে পেঁকে যেও না।
কৃষক বীজতলায় বীজ ছিটায়। এরপর সেখান থেকে চারা উঠিয়ে জমিতে রোপন করে। বীজগুলোর মধ্যে কিছু বীজ দূরে গিয়ে পড়ে, কিছু চারা বিচ্ছিন্ন থাকে। ওগুলো উঠতেই মোটা হয়ে ওঠে। কিন্তু কৃষক উপড়ে ফেলে দেয়, রোপন করে না। ওটা থেকে ধান হয় না। এটা পীরে না-বালেগ!
আম পাকার একটা মৌসুম আছে। জৈষ্ঠ মাসে আম পাঁকে। পরিপুষ্ট হওয়ার আগে যদি কোনো আম পেঁকে যায় অর্থাৎ রং হলুদ হয়ে যায়, তাহলে তা অপুষ্ট, ওটা ঝরে পড়ে, খাওয়ার উপযুক্ত হয় না। এটা পীরে না-বালেগ।
পরিপক্ক হতে হলে দীর্ঘ সবর করতে হবে। ম্যাচিউর্ড হতে হলে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। যাদের সবর নেই, তারা ‘পীরে না-বালেগ’ হয়। পড়তে হবে। মুযাকারা অব্যাহত রাখতে হবে। ফকীহ ফিদদ্বীনের সোহবতে নিজেকে ওঠাতে হবে। তাঁর কাছ থেকে সমঝ-ফাহম হাসিল করতে হবে। এরপর বিতরণের সময় আসবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার ও মানার করার তাওফিক দান করুন, আমীন।
বিনু/