রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ৫ মাঘ ১৪৩১ ।। ১৯ রজব ১৪৪৬


খালেদা জিয়া : রাজনীতির লাইমলাইটে বেগমের প্রত্যাবর্তন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগ্রহিত

১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে বঙ্গোপসাগর থেকে উড়ে আসা মেঘ যেন আছড়ে পড়েছিল চট্টগ্রামে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই শহরের সার্কিট হাউসের ছাদে প্রচণ্ড বৃষ্টি আছড়ে পড়ার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান।

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে একজন পাকিস্তানি সৈনিক হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী জাতীয়তাবাদী অফিসার হিসেবে ইতোমধ্যেই নিজের সাহসিকতার জন্য পরিচিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। গোলাগুলির শব্দে লুকিয়ে পড়ার মতো কোনও মানুষ তিনি ছিলেন না। আর তাই নিজের নাইট স্যুট পরেই জিয়াউর রহমান বন্দুকের গুলির কারণ জানতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ঠিক তখনই গুলির শিলাবৃষ্টি তাকে আক্ষরিক অর্থে ঝাঁঝরা করে দেয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করলেও খুনিরা ক্ষমতা দখলের চক্রান্তে ব্যর্থ হয় এবং অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুস সাত্তার তৎকালীন সেনাপ্রধান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সমর্থনে দ্রুত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এই নাটকীয় পরিস্থিতিতেই জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রবেশ করেন। স্বামী জিয়াউর রহমানকে হত্যার খবর শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল, কিন্তু আড়াই বছর পর আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে দায়িত্ব নেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

অবশ্য জিয়াউর রহমানের মৃত্যুও হয়েছিল দেশের জন্য এক সংকটময় সময়ে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।

মূলত খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দুজন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছেন। খালেদা জিয়া ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি অফিসারের স্ত্রী এবং আর হাসিনা ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতার কন্যা। কিন্তু ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরোধিতাকারী দুটি রাজনৈতিক জোটের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তারা দুজন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় জোট এবং হাসিনা এরশাদের বিরুদ্ধে ১৫ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন করেন। জাল ভোটে ক্ষুব্ধ হয়ে দুই জোট একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এবং অবশেষে ১৯৯০ সালে তারা এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হন।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে এবং বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু বেগম জিয়া যখন দেশের সমস্যাগুলো কেবল বুঝতে শুরু করছেন, তখনই একটি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়। শেখ হাসিনা সুযোগ বুঝে সেসময় বিএনপি সরকারকে অযোগ্য বলে অভিহিত করেন।

বিরোধিতা সত্ত্বেও বিএনপি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলার পর ক্ষমতা ছেড়ে দেয় দলটি। এরপর শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম জিয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী হাসিনার সাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি চলতি শতাব্দীর শুরুতে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সমর্থনে ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।

নির্বাচন বয়কট

যদিও পরবর্তী ১৫ বছরে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতার বাইরে রেখেছিলেন হাসিনা কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক ময়দানে বিএনপি ছিল শক্তিশালী। শেখ হাসিনার আমলে খালেদা জিয়া যখন পিছিয়ে পড়েছিলেন, তখন দলের দৈনন্দিন বিষয়গুলো দেখভাল করতেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো নেতা, তারা একাধিকবার নির্বাচন বর্জন করে দলের লড়াইয়ের মনোভাব বজায় রেখেছিলেন।

তবে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত বছরের আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বেগম জিয়া জানান, তিনি হাসিনার প্রতি কোনও বিরাগ বা অসৎ ইচ্ছা পোষণ করেন না।

যদিও বিএনপি অতীতে নির্বাচন বর্জন করেছিল, কিন্তু হাসিনার সরকার ২০২১ সালে খালেদা জিয়ার জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স হাসপাতালের ডাক্তারদের ঢাকায় আসতে বাধা দেয়নি। কিন্তু বারবার আবেদন সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশে যেতে দেয়নি হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তথা গণবিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হাসিনা এখন বাংলাদেশের বাইরে এবং বহু বছর পর আবারও ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনায় বিএনপি উচ্ছ্বসিত। আর এমন পরিস্থিতিতে ৭৯ বছর বয়সী বেগম জিয়া আবারও চলে এসেছেন লাইমলাইটে, কিন্তু এবার তিনি অনেক বেশি সতর্ক। এই মাসের শুরুর দিকে কাতার থেকে আসা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশেষ চিকিৎসা সেবার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। সেখানে দীর্ঘ সময় পর তিনি তার বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথে পুনরায় মিলিত হন। এছাড়া গত সপ্তাহে একটি দুর্নীতির মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন খালেদা জিয়া। আদালত তার আগের ১০ বছরের সাজাও বাতিল করেছেন।

বাংলাদেশের ভগ্নদশাপূর্ণ রাজনীতিতে বহু ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করেই টিকে আছেন খালেদা জিয়া। এবং যখন অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দেবে তখন নিশ্চিতভাবেই আবারও রাজনৈতিক পরীক্ষা দেবেন এই নেত্রী।

সূত্র: দ্য হিন্দু

বিনু/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ