শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কাল যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন: মজলিস মহাসচিব ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল

সিহহত ও আফিয়াত তালিবে ইলমের মূলধন: মাওলানা আব্দুল মালেক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত বাণী প্রায় সকল তালিবে ইলম ভাইয়েরই জানা রয়েছে-

‘দুটি নেয়ামতের ক্ষেত্রে বহু মানু ষ ক্ষতিগ্রস্ততার মধ্যে রয়েছে- সুস্থতা ও অবকাশ।’

মানুষ ভালো কাজে মগ্ন থাকুক বা মন্দ কাজে, সে প্রকৃতপক্ষে আখিরাতের তিজারতে মগ্ন রয়েছে। এই তিজারতের মূলধন হচ্ছে সুস্থতা ও অবকাশ। কেউ যদি এই মূলধন মন্দ কাজে ব্যয় করে তবে তা নির্ভেজাল লোকসান। কেউ যদি অর্থহীন বিষয়াদিতে ব্যয় করে তবে তা-ও লোকসান। আর কেউ যদি এগুলোকে যে পরিমাণ ফলদায়ক বানানো সম্ভব ছিল সে পরিমাণ বানানোর চেষ্টা না করে তবে তা-ও এক ধরনের লোকসান।

আখিরাতের এই তিজারতের বৈশিষ্ট্য হল, এখানে মূলধনও ব্যক্তির নয়, সে নিজেও তার নয়। এ অবস্থায় মূলধনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না করা এবং তা থেকে যে পরিমাণ মুনাফা আসা প্রয়োজন ছিল সহজসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও তা অর্জনে ব্যর্থ হওয়া কেমন পরিণতি বয়ে আনবে?

তালিবে ইলম, যে নিজেকে দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের জন্য ওয়াক্ফ করেছে সে যদি তার সুস্থতা ও অবকাশকে বিনষ্ট করে কিংবা যথাযথ ব্যবহার না করে তাহলে সে শুধু নিজের ক্ষতিসাধন করল-এমন নয়। এ ক্ষতি সম্মিলিত ক্ষতি, গোটা উম্মতের ক্ষতি এবং এ লোকসান দ্বীনের লোকসান।

অবকাশের নিয়ামত সম্পর্কে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর কিতাব ‘কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা’ অধ্যয়ন যথেষ্ট। এ নিবন্ধে আমি সিহহত ও আফিয়াত সুস্থতা এবং রোগ-শোক, বিপদ-আপদ থেকে মুক্ততা সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ইয়াকিন ও কালিমায়ে ইখলাস (কালিমায়ে তাইয়্যেবা)র পরে আফিয়াত-সুস্থতা ও বিপদাপদমুক্ততা থেকে বড় কোনো নিয়ামত কাউকে দেওয়া হবে না। (অর্থাৎ ঈমানের পরে এটাই হল সবচেয়ে বড় নিয়ামত।) এজন্য তোমরা আল্লাহর কাছে ‘আফিয়াত’ প্রার্থনা কর। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ৫, ১৭, ৩৪, ৪৪; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৯৫০

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বোত্তম দুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুনিয়া ও আখিরাতের আফিয়াত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর। দ্বিতীয় দিন সে আবার এই প্রশ্ন করল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই জবাব দিলেন। তৃতীয় দিন প্রশ্ন করলেও একই জবাব দিলেন এবং ইরশাদ করলেন,

যদি তোমাকে দুনিয়াতে আফিয়াত দান করা হয় এবং আখিরাতেও তা প্রদত্ত হও তবে তুমি কামিয়াব হয়ে গেলে।’ -তিরমিযী হাদীস ৩৫১২

‘আফিয়াতে’র প্রার্থনা কীভাবে করতে হবে তা-ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন।

ইরশাদ হয়েছে, এবাক্যগুলোতে তোমার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

আফিয়াত-প্রার্থনার একটি উপযুক্ত সময় হল আযান-ইকামতের মধ্যবর্তী সময়। কেননা, এটা দুয়া কবুলের সময়। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দুয়া কবুলের এ সময়ে আমরা কী দুয়া করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের আফিয়াত প্রার্থনা করবে।’ -তিরমিযী হাদীস ২১২

তালিবে ইলমদের কাছে অবিদিত নয় যে, ইলম অত্যন্ত ভারী জিনিস। এর প্রশস্ততাও অনেক এবং গভীরতাও অনেক। এই সম্পদের জন্য প্রয়োজন নিশ্চিন্ততা ও একাগ্রতা। আর তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সুস্থতা ও রোগ-শোকমুক্ততা। এজন্য প্রাচীন সময় থেকেই ইলম অন্বেষণের শর্তাবলির মধ্যে সুস্থতাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এজন্য আমাদের এই সমাজ, যার নাম তালিবানে ইলম তাদের কর্তব্য হচ্ছে-

১. স্বাস্থ্যরক্ষার সাধারণ বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা এবং নিজের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করা।

২. স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সকল প্রকার খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।

৩. স্বাস্থ্য নষ্টকারী সকল কাজকর্ম থেকে নিজেকে দূরে রাখা।

৪. আহার ও নিদ্রায় স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়ে সচেতন থাকা। প্রয়োজনের চেয়ে কমও ঘুমাবে না, আবার গাফলতের নিদ্রা থেকেও বিরত থাকবে।

৫. অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প পরিমাণে হলেও বলবর্দ্ধক খাদ্য গ্রহণ করবে।

৬. প্রত্যহ নিয়মিত কিছু সময় হাঁটার অভ্যাস করবে। সুযোগ হলে কিছু শরীরচর্চাও করবে।

৭. আল্লাহ তাআলার কাছে সুস্থতা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করবে।

৮. সিহ্হত ও আফিয়াতের বাতেনী সহায়ক যথা- নযরের হেফাযত ও দুআর বিষয়ে যত্নবান হওয়া।

৯. সিহ্হত ও আফিয়াতের বাতেনী প্রতিবন্ধক থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। আর এর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়া। বিশেষত যেসব গুনাহ স্বাস্থ্য নষ্ট করে।

গুনাহ সম্পর্কে কখনো একথা ভেবে শিথিলতা করা হয় যে, আল্লাহ তাআলা গফুরুর রাহীম, তিনি মাফ করে দিবেন। তদ্রূপ মনে করা হয় যে, তওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু একথা লক্ষ করা হয় না যে, তওবার কারণে গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার ওয়াদা রয়েছে কিন্তু এর কারণে এটা অপরিহার্য হয় না যে, তওবার কারণে এর মন্দ প্রভাবগুলোও দূর হয়ে যাবে। অতএব গুনাহর কারণে দিল-দেমাগ ও স্বাস্থ্যের উপর যে প্রভাব পড়বে তার কী করবেন?

হাকীমুল উম্মত রহ. তাঁর ওয়াজ ‘আলমুরাদে’ অত্যন্ত উত্তম কথা বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা গফূরুর রাহীম হওয়ার অর্থ এই নয় যে, গুনাহর কারণে যে ক্ষতি হয়ে থাকে তা-ও আর হবে না।... কি জানি কীভাবে গুনাহ সম্পর্কে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, উপরোক্ত বিশ্বাস মনে পোষণ করলেই (অর্থাৎ আল্লাহ গফূরুর রাহীম হওয়ার বিশ্বাস) গুনাহ আর কোনো ক্ষতিসাধনও করবে না...।’ -খুতবাতে হাকীমুল উম্মত ১/৩৩

কিছু দিন আগের কথা। ৯ জিলকদ ১৪২৮ হি.  মোতাবেক  ২১  নভেম্বর বুধবার সকালে হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম এর খেদমতে বসা ছিলাম। এক প্রসঙ্গে তালিবে ইলমদের স্বাস্হ্যরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় এসে গেল। তখন তিনি যে প্রজ্ঞাপূর্ণ নসীহতের কিছু কথা বলেছেন, সংক্ষিপ্তাকারে মোটামুটি তাঁরই ভাষায় আপনাদের সামনে পেশ করছি-

‘আমি প্রায়ই একটা কথা বলি, আল্লাহ আমার যেহেনে দিয়েছেন, কোনো কিতাব থেকে নিশ্চয় পেয়েছি, কুওয়াত মানুষের শরীরে দাখিল হয় এবং খারিজ হয়। তো আমাদের দেহে যতগুলো ছিদ্রপথ আছে, লোমকুপ থেকে শুরু করে চোখ, নাক, কান-যতগুলো ছিদ্রপথ আছে এগুলো ‘মাদাখিলুল কুওয়্যাহ’ এবং ‘মাখারিজুল কুওয়্যাহ’। এই যে নজর হিফাযত করতে বলা হয়েছে- নজর হিফাযত করলেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে- কারণ নযরের হেফাজত করার মানে হল কুওয়াতগুলোকে বের হতে না দেওয়া। আর যেই নজরের হেফাজতের কমি হল কুওয়াত খারেজ হওয়া শুরু হল। তো আমাদের কানের রাস্তায়, চোখের রাস্তায়, দিমাগের রাস্তায় আরো অন্যান্য রাস্তায় কুওয়াত শুধু খারেজ হতে থাকে। নিছক ডাক্তারদের মতে হয়তো এগুলো স্বাস্থ্যের উপযোগী বা অনুপযোগী তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরো দেখুন ওযুর আমলটি, ফযীলতের নিয়তে ওযু করলে ওযুটা সিহ্হাতের জন্য বড় মুফীদ। কিন্তু আমাদের ওযুটা, আমার মনে হয় শতকরা নিরানববই জন ওযু ‘মিফতাহুস সালাহ’ হিসেবে করে। ওযুর যে ফাযায়েল আছে ওযুর যে খায়ের এবং বারাকাত আছে, ঐটা হাসেলের নিয়ত আমাদের অধিকাংশেরই থাকে না, আমারও থাকে না। মাঝে মধ্যে মনে পড়ে, কিন্তু এটা তো আসলে আদত হয়ে যাওয়া দরকার।

এই যে মেসওয়াক, আমাদের অধিকাংশ ছেলে মেসওয়াক করে না, মেসওয়াক কিন্তু সিহ্হাতের জন্য খুব জরুরি। এখন কিছু ছেলে ব্রাশ করে। ব্রাশটা অবশ্য জরুরি আমাদের বর্তমান হালাতের প্রেক্ষিতে। কিন্তু এটা তো শরয়ী কোনো বিষয় না। তাই যদি মেসওয়াক করা হয় তো বিরাট ফযীলত এবং স্বাস্থ্যগতভাবেও খুব উপকারী। এগুলো সব বাতেনী আসবাব।

শরীয়তের মাকসাদ স্বাস্থ্য নয়। কিন্তু আহকাম সবগুলোই স্বাস্থ্য উপযোগী এবং স্বাস্থ্যের জন্য মুফীদ। মাকসাদ যদিও স্বাস্থ্যরক্ষা নয়। কিন্তু পার্শ্ব আসবাব হিসেবে পার্শ্ব উদ্দেশ্যে হিসেবে সবগুলোই আছে। মূল কথাটা হল যে, আমাদের এ ছিদ্রপথগুলো হল ‘মাদাখিলুল কুওয়্যাহ’ এবং  ‘মাখারিজুল কুওয়্যাহ’ এগুলোর হেফাজত করা দরকার কিন্তু এখন যে যামানা এসেছে শক্তি শুধু বের হচ্ছে- সঞ্চয় নেই। ঐ যে ব্যাটারীর মতো, চার্জ করছি না, কিন্তু ব্যাটারী খরচ করছি।

তালবে ইলম ভাইদের আজকাল স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অবগতি নেই, সচেতনতা নেই। আর একটা কথা হল- স্বাস্থ্যের যে বাতেনী আসবাব আছে এই বিষয়ে আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই। আর যেহেতু আমরা শরীয়তের পাবন্দ, শরীয়তের অনুসারী এজন্য আমাদের ক্ষেত্রে বাতেনী আসবাবের ছাড় পাওয়া যাবে না। অন্যরা কিন্তু ছাড় পাবে, তাদের স্বাস্থ্য বাতেনী আসবাব ছাড়াও ভালো থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যেহেতু এটার ইলতেঝাম করেছি, আমরা এগুলো তরক করলে- এগুলোর মাযাররাত আমাদের খুব ভালোভাবে ধরবে এবং ধরছে। দেখা যাচ্ছে। আল্লাহ হেফাজত করুন।’

আল্লাহ তাআলা এই মূল্যবান নসীহতের উপর আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(লেখাটি মাসিক আলকাউসার থেকে নেওয়া হয়েছে)

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ