বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সৌদি আরবে মুক্ত চিন্তাবিদদের কথা বলার অনুমতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: সৌদি আরবে দর্শন বিষয়ক একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও ভিন্নমতের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য বহু নাগরিককে কারাগারে বন্দী করেছে সৌদি আরব।

শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান দার্শনিক মাইকেল স্যান্ডেলসহ রিয়াদে অনুষ্ঠিত তিন দিনের ওই সম্মেলনে বিশ্বের অনেক সম্মানিত শিক্ষাবিদ অংশ নিয়েছেন।

দর্শনের রকস্টার হিসেবে খ্যাত হার্ভার্ডের অধ্যাপক মাইকেল স্যান্ডেল অনলাইনে ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে এতে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি কোনো বক্তৃতা দিতে চান না। বরং নারীসহ তরুণ সৌদিদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করতে চান।

কিং ফাহাদ ন্যাশনাল লাইব্রেরির কনফারেন্স সেন্টার থেকে ইউটিউবে লাইভ সম্প্রচারিত একটি অধিবেশন চলাকালীন স্যান্ডেল চার সৌদি শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমালোচনামূলক যুক্তি এবং নৈতিক দর্শনের বিষয়গুলো নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।

যে দেশে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে জনসমক্ষে প্রশ্ন করা একরকম নিষিদ্ধ সেখানে এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনাই বলা চলে।

আলোচনায় স্যান্ডেল করোনভাইরাস মহামারীতে সৌদি সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আলোচনাটিকে একটি নৈতিক প্রশ্নের দিকে নিয়ে যান যে, একজন খুনি আত্মীয়কে রক্ষা করা বা হস্তান্তর করা উচিত কিনা।

এর উত্তরে একজন ছাত্রী বলেন যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং এমনকি অপরাধী যদি তার বাবাও হন তিনি তাকে আইনের হাতে তুলে দেবেন। এসময় ওই ছাত্রীর বাবা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই ছাত্রীর এই সাহসী জবাবে উপস্থিত শিক্ষার্থী এবং শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

স্যান্ডেল তারপরে একজন শাসকের অন্তর্দ্বন্দ্বের একটি প্রাচীন চীনা গল্প বলেন। ওই শাসকের বাবা একজন খুনি ছিলেন। গল্পটি সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে বিশ্বব্যাপী একজন খুনি মনে করা হয়। তার বিরুদ্ধে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যদিও সৌদি কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

স্বাধীন চিন্তার জন্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে গত মাসে একজন সৌদি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একজন ইয়েমেনি সাংবাদিককে সম্প্রতি ধর্মত্যাগের জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের ইঙ্গিতে ইসলাম প্রচারক থেকে শুরু করে অল্পবয়সী সৌদি নারীদের মধ্যে অনেক সৌদি নাগরিককে, যেমন, লুজাইন আল-হাথলৌলকে দেশের আইন কানুনে সংস্কারের দাবি তোলায় জেলে পাঠানো হয়েছে।

স্যান্ডেল বিবিসিকে বলেছেন যে, তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শন পড়েননি। কিন্তু তারা বড় নৈতিক প্রশ্নে বিতর্কের জন্য ক্ষুধার্ত ছিলেন। যা দেখে তিনি চমকিত হয়েছেন।

শিক্ষার্থীরা নিজেরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। একজন বলেন যে, ওই আলোচনা তার চিন্তার ‘চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে’। এমন বিভিন্ন বিষয়ে তার চোখ খুলে গিয়েছে যেগুলো সম্পর্কে তিনি আগে সচেতন ছিলেন না। তিনি বিবিসিকে বলেন যে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ‘মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য’।

সৌদি আরবের আগের শিক্ষামন্ত্রী গত বছর ঘোষণা করেছিলেন যে, পাঠ্যক্রমে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং দর্শন অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু এরপরই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার সেই পরিকল্পনাগুলোও আটকে আছে।

অথচ এক হাজার বছর আগে আরব চিন্তাবিদরাই দর্শনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং আরবীতে অনুবাদের মাধ্যমেই প্রাচীন গ্রীক চিন্তাধারার ঐতিহ্য বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং দর্শন শাস্ত্রের পুনরুত্থান ঘটেছিল।

কিন্তু গত প্রায় ৮০০ বছর ধরে মুসলিমরা সেই জ্ঞান চর্চা থেকে দূরে রয়েছেন। রক্ষণশীল ইসলামি ধর্মগুরুদের প্রভাবে মুসলিম দুনিয়ায় জ্ঞান বলতে মূলত কুরআন এবং অন্যান্য পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ মুখস্ত করা বা ব্যাখ্যা করাকে বুঝায়।

সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা আলি শিহাবি নামের একজন বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা এবং শেখার সমস্ত কিছুর মধ্যেই যুক্তি অনুপস্থিত ছিল এবং কোনো সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার অস্তিত্ব ছিল না। তাই এমনকি জনগণ এবং শিক্ষাবিদদের সামান্য সতর্ক করাও সোদি আরবের একটা জন্য বিপ্লবী ঘটনা’।

সৌদি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলেছে যে, তারা ‘সৃজনশীলতাকে লালন করে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সৌদি আরবে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের চেষ্টা করছেন। যেখানে লোকে তাদের মত প্রকাশে অনুপ্রাণিত হবে’।

মাইকেল স্যান্ডেল বিবিসিকে বলেছেন যে, দর্শন সম্মেলন এবং এতে তার অংশগ্রহণ ছিল একটি পরীক্ষামূলক তৎপরতা।

‘এতে অংশগ্রহণকারীরা যদি অধিবেশন ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও আলোচনায় উঠে আসা নৈতিক দ্বিধা মাথায় নিয়েই বাড়িতে যায়, তাহলে আমি এটিকে একটি সাফল্য বলব। অন্তত প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। তবে সৌদি সিস্টেম কতটুকু পর্যন্ত অনুমোদন দেয় তা অবশ্য এখনো দেখার বাকি রয়েছে’।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ