নুরুদ্দীন তাসলিম।।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আজকাল ছবি আপলোড দেওয়ার হিড়িক দেখা যায় নেটিজেনদের। বিভিন্ন ক্যাপশনে ব্যক্তিগত বিশেষ মুহুর্ত শেয়ার করা বর্তমান সময়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে এসবের মাধ্যমে কখনো কখনো ট্রলের শিকার হতে হয় অনেককে। বিষয়টি অনেক সময় মানসিক পীড়ার কারণ হয়েও দাঁড়ায়।
অনেক সময় সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা ছবির কারণে বিভিন্ন ডিজিটাল অপরাধ চক্রের কবলেও পড়ে যান কেউ কেউ। এছাড়া সেলফি ও ছবি তোলার বিষয়ে শরয়ী বিধি-নিষেধ তো আছেই। এমন বেশকিছু বিষয় মাথায় রেখে সামাজিক মাধ্যমে সব মুহূর্তের ছবি আপলোড দেওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে আরবি ভাষা গবেষক ও রাজধানীর মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়ার পরিচালক মাওলানা মুহিউদ্দীন ফারুকী আওয়ার ইসলামকে বলেন, ছবি তোলার বিষয়ে আকাবির এবং বর্তমান সময়ের বরণীয় আলেমগণ সবসময় রক্ষনশীলতার দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর ব্যাপকতার কারণে যদিওবা এ বিষয়টিকে কিছুটা শিথিলতার চোখে দেখেন বড় আলেমগণ। এক্ষেত্রে সবাই শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকি উসমানীর ফতোয়াকে সামনে নিয়ে আসেন। এরপরেও গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তিনি বিষয়টিকে শিথিল বলে মতামত দিলেও বিশেষ প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ছাড়া ব্যাপকভাবে তার মাঝে ছবি তোলার কোন প্রবণতা নেই। যেমনটি বর্তমান সময়ে আমাদের বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের মাঝে দেখা যায়’।
এই আরবি ভাষা গবেষকের মতে, ‘বিশেষ কোন ইভেন্ট, দ্বীনি প্রচারণা, টার্গেট মূলক কাজ এসব প্রচারের ক্ষেত্রে ছবির ব্যবহার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এজাতীয় ক্ষেত্রে ছবির ব্যবহার না হলেই বরং ইভেন্ট যথাযথ সফলতা পায় না। তাই এসব বিষয় ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ছবি তোলার প্রবণতা এবং তা আপলোড দেওয়ার হিড়িক কোনোভাবেই সন্তোষজনক কাজ নয়’ বলেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘গত কিছুদিন আগে এবং বর্তমানেও বড় একটি ইভেন্ট চলছে , সেখানে বিশেষ কেউ এসব প্রচারের দায়িত্ব নিতে পারেন, কিন্তু তা না করে সবার মাধ্যমে এক ধরনের প্রচারণার প্রবণতা। সবাই প্রচার করলে দেখবে কে? শুনবে কে?’ -প্রশ্ন করেন তিনি।
তিনি আরো যুক্ত করেন, এছাড়াও আরও একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে বর্তমানে, দেখা যায় কেউ কেউ তার সব মুহূর্তের ছবি লাইভে এসে শেয়ার করছেন, -কি করছেন, কি খাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন। এগুলো এক ধরনের অসুস্থতা মানসিকতা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এসব বিষয়ে সহনশীলতা ও আরো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকী।
এদিকে একই বিষয়ে তরুণ আলেম, লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট মাওলানা আব্দুল্লাহ আল ফারুক আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, ‘ছবি তোলার বিষয়টি যে আলেমগণ জায়েজ বলেছেন তারাও জায়েজের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো দ্বীনি প্রয়োজনে ছবি তোলা। আর যারা একে এখনো হারাম বলেন তারা তো কোন শর্ত ছাড়াই হারাম বলেন’।
তার ভাষায়, ‘সৌদি আরবের ওলামায়ে কেরামগণ এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয়, কিন্তু হজের সময় হারামাইন শরীফাইনের ইমাম ও খতিবদের রবাবরই এ বিষয়টিতে কঠোর দেখা যায়’।
‘এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইবাদতের মাহাত্ম্য ও এখলাস নষ্ট হয়। আত্ম প্রদর্শনীর প্রবণতা তৈরি হয়। এছাড়াও এর ক্ষতি বহুমুখী’- বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন ইভেন্টে ওলামায়ে কেরামকে ঘিরে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়ে থাকে। এসব ভিড়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ের থেকে সেলফি- ছবি তোলার মহড়া অনেক বেশি দেখা যায়। হয়তোবা বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে সেখানে ওলামায়ে কেরাম কিছু বলতে পারছেন না, তাদের ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। পরবর্তীতে আবার এসব ‘সেলফিবাজ’দের কারণে আলেমদের বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে’।
‘অনেক সময় ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে ওলামায়ে কেরামের ছবি দেখে কোন দ্বীনদার মানুষ ভেবে বসছেন ওলামায়ে কেরামও ছবি তোলার বিষয়টি হালকা করে দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিশেষ কোন ইভেন্ট বা মুহূর্তের মুখোমুখি হয়ে যে ওলামায়ে কেরাম ক্যামেরাবন্দি হতে বাধ্য হচ্ছেন-এ বিষয়টি হয়তবা তারা বুঝতেও পারছেন না’।
‘তাই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সেলফি মহামারী থেকে আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন’ বলে উল্লেখ করেন এই ইসলামী অনলাইন একটিভিস্ট।
তবে বিশেষ কোন প্রয়োজন ও ইভেন্টকে সফল করার লক্ষ্যে মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকের মতো তিনিও মনে করেন বিপরীতমুখী মাসয়ালা ও ওলামায়ে কেরামের কিছুটা নমনীয়তার সূত্র ধরে এসবের প্রচারণা চালানো যেতেই পারে।
তিনি আরো বলেছেন, ‘সেলফি এবং ছবি তোলার ক্ষেত্রে শরয়ী বিধিনিষেধের দিকটি বাদ দিলেও প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই সেলফি তুলতে গিয়ে মানুষ কত ধরনের বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন, অনেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন- এসব ক্ষতিও তো সেলফি মহামারি থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট- বলেন তিনি।
এছাড়া বর্তমানে ডাক্তাররা বলছেন সেলফি তোলার প্রবণতা এক ধরনের মানসিক রোগ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ডাক্তাররাও এসব থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন উল্লেখ করে এই অনলাইন এক্টিভিস্ট বলেন, ‘ স্বাস্থ্যগত কারণে ডাক্তাররা জায়েজ কোন বিষয় থেকে বিরত থাকতে বললে সেটিও আর জায়েজ থাকে না’।
সার্বিক দিক বিবেচনায় সেলফি তোলা ও সামাজিক মাধ্যমে আপলোড দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার কাছ থেকেই আরো সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মাওলানা আব্দুল্লাহ আল ফারুক।
বিশেষ প্রয়োজন ও কোন বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় ছবি তোলা ও আপলোড দেওয়া দোষণীয় কিছু নয়; তবে ব্যাপক আকারে যত্রতত্র ছবি তুলে আপলোড দেওয়া এবং কাউকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া থেকেই মূলত বিরত থাকা উচিত বলে মতামত এই দুই লেখক আলেম।
এদিকে মার্কিন গবেষকেরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার অভ্যাসের সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্ক থাকতে পারে। নিজের চেহারা প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সম্প্রতি মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শিকাগোতে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক পরিচালনা পর্ষদের সভায় সেলফির সঙ্গে মানসিক ব্যাধির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। গবেষকেরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেওয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, ব্যাধিটির তিনটি স্তর হতে পারে। প্রথম স্তরটি ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’। মানসিক সমস্যার এই পর্যায়ে দিনে তিনবার নিজের ছবি তুলে কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তা পোস্ট না করা। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘অ্যাকিউট সেলফিটিস’। এই পর্যায়ে দিনে অন্তত তিনটি নিজের সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে তিনটি সেলফিই পোস্ট করা হয়। শেষ স্তরটি হচ্ছে ‘ক্রনিক সেলফিটিস’। এ পর্যায়ে নিজের সেলফি তোলা রোধ করা যায় না। দিনে অন্তত ছয়বার সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে পোস্ট করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বারবার নিজের ছবি তোলার প্রবণতা থাকে ক্রনিক সেলফিটিস পর্যায়ে।
গবেষকেরা এই মানসিক সমস্যার আপাতত কোনো সমাধান নেই বলেই জানিয়েছেন।
এটি