।।মুহাম্মাদ মাসউদুর রহমান।।
‘জীবনের যাত্রা পথে
হাজারও যাত্রী চড়ে,
কার পরিচয় বা কে রাখে
তারাই শুধু মনে থাকে।’
কালের আবর্তনে, আর সময়ের ঘূর্ণায়মান চাকায় ঘুরে কত ঘটনা, কত ইতিহাস, কত ব্যাক্তিত্ব স্বৃতির অতল গহীনে হারিয়ে যায়; কঠিন বাস্তবতা নতুনের হাতছানি পুরাতনকে বারে বারে ঠেলে দেয় পশ্চাতে। তবুও কিছু নাম, কিছু মানুষ স্বৃতির কুঠুরিতে থেকেও বারে বারে নাড়া দেয়। ইতিহাসের পাতা থেকে ক্ষণে ক্ষণে মানসপটে উদিত হয়। চলার গতি পথ রুদ্ধ করে দেয় অব্যকÍ বেদনা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় বিরহ ব্যাথায়। সঞ্জীবনী সুধা নিয়ে সামনে চলার প্রেরণা যোগায়।
ইতিহাসের এমনি চলমান ধারায় সর্বদায় ভেসে উঠে যে সুন্দর অবয়বখানা, সময়ের হাজারো আবর্তন যাকে মুছে দিতে পারেনা অন্তর থেকে, ক্ষণিকের তরেও ভুলা যায় না যার অপরুপ স্বৃতি। মূহুর্তে মূহুর্তে ঢেও তোলে হৃদয় দরিয়ায়।
সেই মহান ব্যাক্তিত্বটি হচ্ছেন সময়ের এক ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষ, হেরার রাজ তোরণ থেকে বিচ্ছুরিত ইলমে ওহীর অন্যতম ধারক, নববী কাননের ফুটনÍ গোলাপ, হাবিবী বাগানের সেরা সৌন্দর্য, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি আহমাদ শফী সাহেব (রহ:)(জন্ম-১৯১৬-মৃত্যু-১৮/০৯/২০২০)
“কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদাই আমার উম্মতের একদল লোক দীনে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তিরস্কারকারীদের তিরস্কার তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।,, মহানবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। তারা হলেন হক ও হক্কানিয়াতের পতাকাবাহী জামাত এবং তাদের অনুসারীরা। তারা নাজাত প্রাপ্ত হবেন প্রতিদান দিবসে।
কাল-পরিক্রমার বাকে বাকে দাড়িয়ে তারাই করেছেন এ উম্মতের দরদভরা রাহনুমায়ি। চিৎকার করে ডেকেছেন লোকদেরকে রহমান আল্লাহর দয়ার দিকে। কেদেছেন জার জার হয়ে মানুষের কল্যাণ চিন্তায় অহর্নিশি।
বলেছেন সদাসর্বদা আল্লাহ ও তার রাসূলের মধুময় বাণী। পার্থিব লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি ও কারো চোখ রাঙ্গানী তাদেরকে করতে পারেনি ক্ষণিকের জন্যও বিচ্যুত। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে দাড়িয়ে ও সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, أينقص الدين وأنا حيّ (দীনের ক্ষতি হবে আর আমি জীবিত থাকব এটা হতে পারেনা।) তারা হলেন সাহাবা, তাবেইন, তাবে তাবেইন, আইম¥ায়ে মুজতাহিদিন, মুজাদ্দিদিন, মুহাদ্দিসিন, ফুকাহা, ও উলামায়ে কেরামের সুমহান জামাত।
তাদের অক্লান্ত ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা ইসলামের সুশীতল সামিয়ানার নিচে স্থান পেয়েছি। পেয়েছি দ্বীন, ইমান ও ইহসান সম্পর্কে জানার অফুরন্ত সুযোগ।
ইলম আল্লাহ তা‘আলার দান। ইলমে ওহী অর্জনের প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহকে চেনা। প্রকৃত অর্থই যে চিনে, সেই একটি সত্তার শক্তি, ক্ষমতা, গুণ ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। সত্তাটি যদি মহান রাব্বুল আলামীন হন। তখন যে তাকে বেশি চিনে সেই তাকে অধিক ভয় করে।
এই ভয় তার শাস্তির ভয় তো বটেই, এর চেয়ে আরও বহু গুণ ভয় তিনি নারাজ হয়ে যাওয়ার ভয়। প্রকৃত আলেমের আরেকটি সমান্তরাল পরিচয় হলো, তিনি হবেন মুত্তাকি। আলেম তিনিই যিনি আরেফ। তিনি আবেদ। দুনিয়ার দায়িত্ব হিসাবে একজন আলেমের ইলম কাজে লাগবে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খানুরুপে জানার ক্ষেত্রে।
এখানে প্রতিটি ইলমওয়ালা ব্যাক্তির মর্যাদা এবং আল্লাহর নিকট তার মাকবুলিয়্যাত নির্ধারিত হয় তার একীন, ইখলাস, মারেফাত, মহব্বত ও কোরবানীর ভিত্তিতে। পাশাপাশি এসব অর্জনে কেউ আত্মনিবেদন করলে আল্লাহর তরফ থেকে তাকে দেওয়া হয় হেকমতের সীমাহীন ভাণ্ডার। সাথে যদি রোগ হয় জন্মগত ও স্বভাবগত মেধা, গভীর জ্ঞান, বোধ ও উপলব্ধি ক্ষমতা, তখন এই আলেম হয়ে উঠেন সমকালীনদের মধ্যে বিশিষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা যার কল্যাণের সিদ্ধান্ত নেন, তাকে এই সমন্বিত নেয়ামত বা তাফাক্কুহ ফিদ্দীন দান করেন। আর এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা আহলে ইলমদের জন্য ঘোষণা করেছেন অনেক অনেক স্তরবিশিষ্ট মর্যাদা। যুগে যুগে উম্মত এ খোদায়ী নীতির বাস্তবায়নই উলামায়ে উম্মতের জীবনে দেখে এসেছে।
উল্লিখিত বিবরণের আলোকে আপনি যদি চিন্তা করেন, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, মুহাদ্দিসীন, উলামা, সুলাহা সবার জীবন এই মানদন্ডে যাচাই করে নিতে পারেন। আজকের আলোচনা যে মনীষী আলেম সম্মর্কে আমরা করতে যাচ্ছি, তিনি বর্ণিত ক্রাইটেরিয়ার আলোকে একজন সেরা ব্যক্তিত্ব। যাকে আমরা সমকালের অন্যতম আলেম বলে প্রাণ খুলে আখ্যায়িত করতে পারি। তিনি হলেন, শায়খুল ইসলাম, খতীবে ইসলাম আল্লামা আহমাদ শফী সাহেব রহ.(জন্ম-১৯১৬-মৃত্যু-১৮/০৯/২০২০)
বিশ্ব ইতিহাসের সারে চৌদ্দশত বছরের পথ-পরিক্রমায় আজ থেকে প্রায় ১২৬ বছর পৃর্বে বৃটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের এতদাঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, তাহজিব-তামাদ্দুনের অবস্থা ছিল মুসলিম মিল্লাতের প্রতিকুলে।
এমতাবস্থায় নিখিল ভারতের সর্বজনমান্য আলিমে হক্কানী, যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ, হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী রহ. এর সূযোগ্য শিষ্য, আল্লামা আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব রহ. দেওবন্দ তরীকার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভুমিকা গ্রহণ করেন এবং হযরত মাওলানা আব্দুল হামিদ সাহেব রহ. ও হযরত মাওলানা সুফী আজীজুর রহমান সাহেব রহ. এর সক্রিয় সহযোগিতায় এবং হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর নির্দেশে শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব রহ. ১৩১৫ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৭ ইংরেজী সনে চট্রগ্রাম জেলার হাটহাজারীতে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র, দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারীর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পূর্ণ আদর্শ বুকে ধরে একজন আদর্শ ওয়ারিসে নবী তৈরির স্বপ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছিল দারুল উলূম হাটহাজারী।
আজ এশিয়া মহাদেশের কোণে কোণে অসংখ্যা অগণিত ওলামা, দাই মুবাল্লিগ, মুজাহিদ, বুযুর্গ-দরবেশ; মোটকথা ইসলামের সকল শাখায় যোগ্য প্রতিনিধি তৈরি করেছে এ মহান মারকায।
আল্লাহ পাকের মেহেরবাণীতে হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ রহ. ১৩১৯ হিজরী মোতাবেক ১৯০১ ইংরেজী শেষের দিকে মাদ্রাসা স্থাপনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ৬০ হাত লম্বা ছনের ছাউনি বাশের বেড়াযুক্ত একটি গৃহ নির্মান করেন। তখন ১৩২১ হিজরীর মাহে মহাররম, ১লা বৈশাখ (১৩১০ খৃষ্টাব্দ) মোতাবেক ১৯০৩ ইংরেজী সালের ১৪ ই এপ্রিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম ও আন্যান্য প্রশাসনিক কাজকর্মের শুভ সূচনা করেন।
সেদিনের বাশের বেড়ার গরীব মাদরাসা উন্নতি হতে হতে বর্তমানে, যে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় “আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম” নামে প্রতিষ্ঠিত আছে। এই মাদরসার উন্নতি-অগ্রগতির মূল ভুমিকাই হলেন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শফী সাহেব রহ.(জন্ম-১৯১৬-মৃত্যু-১৮/০৯/২০২০)
এশিয়া মহাদেশের সর্ব মহলে পরিচিত, প্রশংসিত মাদরাসা দারুল উলূম হাটহাজারীর সুযোগ্য, সুদক্ষ, শাইখুল হাদীস ও মহা পরিচালক ছিলেন শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমাদ শফী সাহেব রহ.(জন্ম-১৯১৬-মৃত্যু-১৮/০৯/২০২০) হাটহাজারীর মহা পরিচালক এটাই তার পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট।
মানুষ জন্মগ্রহণ করে আবার চলে যায়। এই ধরাধামে কেউ চিরস্থায়ী নয়। নশ্বর এই পৃথিবী ছেড়ে একে একে সবাইকে চলে যেতে হবে একদিন। মানুষের জীবন ফুলের মত। কোন ফুলকলি অঙ্কুরেই ঝরে যায়। কোনটা সুবাস ছড়ায়, মুগ্ধ করে সবাইকে। তার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে সকলে। মৌমাছিরা হন্যে হয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। তার থেকে মধু আহরণ করতে।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমাদ শফী সাহেব রহ.(জন্ম-১৯১৬-মৃত্যু১৮/০৯/২০২০)-এর জীবনটা ছিল ফুলের মত। তার সুবাসে সুরভিত ছিল দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসা। মধু আহরণে দেশের বহু প্রাšত থেকে তালিবে ইলমরা ছুটে আসত তার পবিত্র সোহবতে।তার দরসে গুণগুণ করত শুধু হাদ্দাসার সুর, আজ কষ্টে অশ্রুজল বিসর্জন দিতে হচ্ছে একথা ভেবে যে, অসংখ্যা আলিমের যিনি উস্তাদ, লাখো ভ্রমর যার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে যার অগণিত শাগরেদ। সেই মহান কালজয়ী মুহাদ্দিসের আমিও একজন ছাত্র হওয়ার বড় ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা নসীবে রাখেননি, আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্যা শুকরিয়া যিনি আমার অন্তরকে তার দিদারে ব্যাকুল করেছিলেন, এবং তার দেখার সৌভাগ্যে-সৌভাগ্যবাণ করেছিলেন।
হযরতের দিদারে চক্ষু শিতল
হযরতের শেষ বয়স, এমন সময় কাদিয়ানীদের অপতৎপরতা খুব বেড়ে গিয়েছিল,(হযরতের সারা জীবনটাই, দরস-তাদরীস, বাতিলের বিরুদ্ধে আপশহীন সংগ্রাম-আন্দোলন) তাই হযরত ঘোষনা দিলেন, যে আমি বেছে থাকতেই, কাদিয়ানীদের কাফের-অমুসলিম ঘোষনা (সরকারি ভাবে ) করবো।
সেভাবেই আন্দোলন শুরু করলেন, যে প্রত্যেক বিভাগে একটা করে প্রগ্রাম করবেন, এভাবে শেষ করে। ঢাকাতে সকলেই একত্র করবেন, এই আশায় মেহনত শুরু করলেন। তারপরে হতাৎ একদিন শুনলাম,হযরত যশোরে আসবেন। কবে আসবেন ? কোথায় আসবেন ? কিছুই জানিনা কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় দু‘একদিন পর সম্মেলন সফলের লক্ষে পোষ্টার ছাপা হলো, এবং আমাদের মাদরাসার পক্ষ থেকে সেগুলো আমাদের প্রচার করার জিম্মাদারী আসলো।
একদিকে হযরতের মুহাব্বত আর ভালবাসা এবং অন্যদিকে দ্বীনের খাতিরে, জিম্মাদারী পালন করার চেষ্টা করলাম, উক্ত দিনে সম্মেলনে যাওয়ার বড় ভাইদের অনুমতি হলো, আমার অনুমতি হলো না কিন্তু আমি মনোবল হারালাম না । কারণ আমার দীর্ঘদিনের আশা-প্রত্যাশা হযরতের হাদীসের দরসে বসার কিন্তু হযরত হায়াত পাবে কিনা তাতো জানা নাই।
হযরতের প্রতি আমার ভক্তি-ভালবাসার আধিক্যে আমার চোখ অছ্রুসিক্ত হলো। এঅবস্থায় হুজুরের নিকট ছুটির আবেদন করলাম , আমার কাকুতি-মিনতি দেখে হুজুর ছুটি দিলেন ।
তারপর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যশোর পানে ছুটলাম হুজুরের দিদারে। যথাস্থানে পৌছাতেই ষ্টেজপানে নজর করলাম,কিন্তু হযরতকে দেখিনা, অন্যন্য ওলামায়ে কেরাম বয়ান করতেছেন, হতাৎ দেখি হযরতের গাড়ি আমাদের পাশদিয়ে অতিক্রম করতেছে, তারপর হযরতকে ষ্টেজে নিয়ে গেলেন, হযরতকে দেখতেই আমার চক্ষু শিতল হলো, তারপর ছাত্রদের দস্তারবন্দী করলেন, এসময় হযরত একটা কথা বলেন; আজকের এই দস্তারবন্দী যেন, আজকেই শেষ না হয়ে যায়, মৃত্যু পর্যন্ত যেন থাকে।
অতঃপর হযরত কাদিয়ানী সম্পর্কে আলোচনা করেন, অল্প সময় আলোচনা করে দু‘আ করে দিলেন। এভাবেই তিনি সমস্ত বাতিলের বিরুদ্ধে আপোশহীন সংগ্রাম করেছেন। [শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রকাশিতব্য স্মারক থেকে লেখাটি সংগৃহিত।]
-কেএল