শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫ ।। ২৮ চৈত্র ১৪৩১ ।। ১৩ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
হারামাইনে আজ জুমার নামাজে ইমামতি করবেন যাঁরা ‘মার্চ ফর গাজা’য় অংশগ্রহণকারীদের জন্য জরুরি ৫ নির্দেশনা তালিবুল ইলমের আবশ্যকীয় পাঁচটি কাজ পাকিস্তানের সব সমস্যার পেছনে ইহুদি ষড়যন্ত্র থাকে: মাওলানা ফজলুর রহমান বাড়িতে বাবার লাশ রেখে এসএসসি পরীক্ষা দিল নাহিদ মানবতার জন্য আপনিও আসুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে: শায়খ আহমাদুল্লাহ ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ দরকার: বিএনপি মাদরাসাছাত্রদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে কাজ করছে এনসিপি : নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর এখন সশস্ত্র ল’ড়াই ফরজ: মুফতি তাকি উসমানি ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি সফল করার আহ্বান শায়খে চরমোনাই’র

সুবহে সাদিকের মুয়াজ্জিন মুনশী মেহেরুল্লাহ রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আল আমীন আজহার।।

বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মুনশী মেহেরুল্লাহ রহ. চির ভাস্বর এক ব্যক্তিত্ব। মুসলিম বাংলার আকাশ যে সময়টাতে গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেই গভীর দুর্দিনে নতুন দিনের আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ রহ.।

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মুসলিম সিপাহী-জনতার বিপ্লব যখন ব্যর্থ হয় তখন মুসলমানদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ দুর্দিন। শাসন ও বিচারের নামে জুলুমে অত্যাচারে মুসলমান সমাজের জীবন দিনদিন মানবেতর হয়ে পড়ে।

মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার এই দুর্দিনে মুসলিম বাংলার আকাশে কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে দেখা দিয়েছিল খ্রিস্টান মিশনারিদের এদেশে আগমন। খ্রিস্টান পাদ্রী ও যাজকেরা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের স্লোগান ছিল 'মুসলিম সমাজকে এই কঠিন দুর্যোগ থেকে তারা উদ্ধার করতে চায়'!

কিন্তু শিক্ষা বিস্তার ও সেবার আড়ালে গ্রামে-গঞ্জে শহরে নগরে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজি শিক্ষার নামে খ্রিষ্টধর্মের ত্রিত্ববাদ প্রচার এবং সাধারণ অসহায় মানুষকে খ্রিষ্টবাদের দীক্ষা দিতে থাকে।

মিশনারিদের প্রচার-প্রোপাগান্ডা এবং লোভ-লালসা জালে বহু মানুষ আটকে গিয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে যে দুরবস্থা তৈরি হয়েছিল, অর্থের প্রলোভন উপেক্ষা করা সাধারণ মানুষের জন্য একটু কঠিনই ছিল। ওই সময়ে খ্রিস্টান মিশনারীদের এসব দীনবিরোধী কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রকে রুখে দেওয়ার মতো মুসলিম সমাজে কেউ ছিল না। সাধারণ অসহায় মুসলমানদের ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে ফেরানোর মতো কেউ ছিল না তখন।

ইতিহাসের এই দুর্দিনে মুসলমানদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল যশোর অঞ্চলের মৌলভী জন জমির উদ্দিন নামের এক লোক। সে ইসলাম ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এরপর খ্রিস্টান মিশনারীদের তত্ত্বাবধানে দু'বছর বিদেশে প্রশিক্ষণ করে দেশে ফিরে এসে সাধারন মুসলমানদেরকে খ্রিষ্টবাদের দাওয়াত দেয়া শুরু করে।

শুধু তাই নয়; মৌলভী জন জমির উদ্দিন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে আলেমদের উদ্দেশ্যে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। 'আসল কুরআন তৃতীয় খলিফা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে' এ ধরনের অবান্তর দাবি নিয়ে একটি বই লিখে 'আসল কোরআন কোথায়?'

মৌলভী জন জমির উদ্দিনের এই পুস্তিকা মুসলিম সমাজে হৈচৈ ফেলে দেয়। তার উপযুক্ত জবাব দেয়ার মত কেউ সাহস করছিল না। মুসলমানদের এই কঠিন দুঃসময়ে মৌলভীর জন জমির উদ্দিনের মোকাবেলা করার জন্য মাঠে নেমেছিলেন মুনশী মেহেরুল্লাহ। হাতে তুলে নিয়েছিলেন শক্তিশালী হাতিয়ার কলম।'আসল কোরআন কোথায়?' এর জবাবে লিখেছিলেন এক অনবদ্য গ্রন্থ 'আসল কোরান সর্বত্র'! এবং জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বন সেলাই মেশিন বিক্রি করেই সেদিন মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রকাশ করেছিলেন 'আসল-কোরআন সর্বত্র'!

শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত হননি মুনশী মেহেরুল্লাহ। প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধের জন্যেও মাঠে নেমেছিলেন তিনি। শত শত মানুষের সামনে সেদিন তর্ক যুদ্ধ হয়েছিল। সেই তর্কযুদ্ধে মৌলভী জন জমির উদ্দিন অনেক শান শওকতের সাথে তর্ক শুরু করলেও ভয়- লেশহীন মুনশী মেহেরুল্লাহর সামনে একেবারেই কুপোকাত হয়ে পড়েছিল। এবং নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিল পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে। অন্যদিকে হাজারো মুসলমানের হৃদয়ে শ্রদ্ধার জায়গা করে নিয়েছিলেন একজন মুনশী মেহেরুল্লাহ রহ.।

পরবর্তী জীবনে মুনশী মেহেরুল্লাহ রহ. খ্রিস্টধর্মের স্বরূপ উদঘাটন করে দেনা 'রদ্দে নাসারা ও দলীলুল ইসলাম' নামে এক অনবদ্য গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ক্ষমতার মোহে পড়ে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যখন নবী দাবি করেছিল তখন ঈমান বিধ্বংসী এই ফেতনার ঢেউ পাঞ্জাব থেকে সুদূর বাংলাতেও আছড়ে পড়েছিল। মুনশী মেহেরুল্লাহ রহ. তখন এই নতুন ফেতনার মোকাবিলায় ও গর্জে উঠে ছিলেন। এবং লিখেছিলেন 'রদ্দে কাদিয়ানী' নামে এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ।

তিনি শুধু মুসলমানদের অধিকার আদায়ের জন্যে সংগ্রাম করেননি। তিনি মুসলমান হিন্দু খ্রিস্টান সকল ধর্মের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার আপামর জনতার সংগ্রামী এক জননেতা। হিন্দুদের বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা প্রথার বিরুদ্ধেও মুনশী মেহেরুল্লাহ কলম চালিয়েছিলেন। তার ‘বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ-ভা-ার’ এ বিষয়েই লেখা একটি গীতিকাব্য।

বিধবা নারীদেরকে কতটা যাতনার ভেতর দিয়ে জীবন কাটাতে হয়, গ্রন্থটিতে মুন্সী মেহেরুল্লাহ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ থেকে দলিল দিয়ে সেকথাগুলোই যৌক্তিক ব্যাখ্যাসহ ব্যক্ত করেছেন বিধবার বিষাদমাখা করুণ জবানে:

সাধে কি সেজেছি আমি চাতকিনী
দহিছে হৃদয় মম প্রাণপতি বৈ লো!
অনন্ত বিরহানল
হৃদয়েতে অবিরল
জ্বলে যেন ইশালে কাহারে তা কৈ লো!
পড়েছি ভীষণ রণে
এ পোড়া যৌবন বনে
বিন্ধিছে কণ্টক মনে, আর কত সই লো!
চাতকিনী শূন্য ভরে
মেঘ বারি বিনে মরে
তবুও সে আশা করে, আমি তাও নই লো!
সদা মনে এই বলে
মনের সুখে আগুন জ্বেলে
কুল পুতে বকুল তলে, উড়ো পাখি হইলো!

মোটকথা উপমহাদেশীয় মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে বঞ্চনা অবহেলা আর নানাবিধ কূটকৌশলের শতাব্দীকাল ধরে চলে আসা দুর্যোগ মোকাবেলায় সংঘটিত হওয়া বালাকোটের লড়াই, ১৮৫৭-এর সিপাহি বিপ্লব, তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা আন্দোলন, হাজি শরিয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনসহ মুসলমান তথা ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য নানা মুক্তিসংগ্রামের পর তিতুমির ও হাজি শরিয়তুল্লাহর ইনতেকালে যখন বাংলার গণমানুষ ব্যাপকহারে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে পদস্খলনের শিকার হতে থাকে ঠিক ঐ সময়টাতেই আলোর মশাল হাতে বাংলার জনপদে জনপদে হেদায়েতের আবে জমজম বিলাতে শুরু করেছিলেন মুনশী মোহম্মদ মেহেরুল্লাহ রহ.। অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর পাণ্ডিত্য নিয়ে উনিশ শতকের মুসলমান সম্প্রদায়কে বিধর্মী প্রচারণা থেকে শক্তহাতে উদ্ধার করেছিলেন।

ইংরেজরা এক সভায় ভারতবর্ষের মানুষকে কটাক্ষ করে বলেছিলো 'তোমাদের দেশের মানুষ-লম্বা খাটো বড় কালো ধলো কেন? অথচ আমাদের দেশে সব সাদা।' ইংরেজদের জবাবে মুনশী মেহেরুল্লাহ বলেছিলেনঃ "শুওর ক্যা বাচ্ছা এক কিছিম হ্যায়-লেকিন টাট্টু ক্যা বাচ্ছা হ্যারেক রকম হ্যায়"। প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে যেকোনো প্রশ্নের মোকাবেলা করা ছিল তার নিত্য অভ্যাস।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ১০ই পৌষ সোমবার দিবাগত রাতে বর্তমান যশোর জেলার অন্তর্গত ‘ঘোপ’ নামক গ্রামে মাতুতালয়ে ক্ষণজন্মা এই মহা মনীষী পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন।তাঁর পৈতৃক নিবাস একই এলাকার ছাতিয়ানতলায়। প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি কুরআন-হাদিস ও ফারসি সাহিত্যেও বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন কিন্তু দারিদ্রের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ সম্ভব হয়নি।

একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতার মৃত্যুতে মা ও তিন বোনের সংসারের হাল মুনশী মেহেরুল্লাহকেই ধরতে হয়েছিল। এবং সেই সাথে অনিবার্যভাবেই পড়ালেখারও ইস্তফা দিতে হয়েছিল। কৈশোরের থৈ থৈ উচ্ছলতায় মুনশী মেহেরুল্লাহর যখন নাটাই সুতো দিয়ে মুক্ত আকাশে ঘুড়ি উড়াবার কথা, যখন মায়ের বকুনি খেয়ে পাঠশালায় যাবার বয়স, তখন তাকে জীবিকার তাগিদে ইংরেজ সাহেবদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। তিনি কিছুকাল কেরানি পদে সরকারি চাকরি কথার সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে দর্জিবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যশোরে দর্জির দোকান খুলে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আর এই ব্যবসায়ই ছিল তার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।

ক্ষণজন্মা এই মহা মনিষী মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৯০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। কবরের পাকা দেয়ালে লেখা রয়েছে:

'ভাবো মন দমে দম
রাহা দূর বেলা কম'

যেতে হবে বহুদূর! কিন্তু বেলা যে পড়ে এলো!

-এএ


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ