আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: মসজিদে ইমামতির মাধ্যমে মাওলানা রাগীব আহসানের কর্মজীবনের শুরু। তবে এখানে বেশি দিন থাকেননি। ৯০০ টাকা বেতনে ঢাকার একটি এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন ‘এহসান গ্রুপ’। নিজের তিন ভাই, বোন, তার শ্বশুর, বোনজামাইসহ নিকটাত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান রাগীব। ইতিমধ্যে তিনি প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
তবে র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেছেন, ২০০৮ সালে দশ হাজার গ্রাহককে তার কোম্পানিতে যুক্ত করেন। ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা তিনি সংগ্রহ করেছেন। এই টাকায় তিনি গ্রাহককে দেননি।
শুক্রবার ভোররাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর একটি দল রাজধানীর শাহবাগ এলাকার তোপখানা থেকে রাগীব ও তার সহযোগী আবুল বাশার খানকে গ্রেপ্তার করে। তার (রাগীব) বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। এছাড়া শতাধিক ভুক্তভোগী রাগীবের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন।
শুক্রবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানে এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গত রবিবার রাজধানীতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন রাগীবের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা। সে সময় তারা বলেন, লক্ষাধিক গ্রাহক তার মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা প্রতারিত হয়েছেন।
র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি এমএলএম কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীরা
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। অনেকে র্যাবের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ছায়া তদন্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াই। পরে তোপখানা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯৬-১৯৯৯ পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি সনদ নেন। পরে পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে ‘এমএলএম’ কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি রপ্ত করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি করেন। ধর্মীয় আবেগ অনুভূতিকে অপব্যবহার করে ‘এমএলএম কোম্পানির’ ফাঁদ তৈরি করেন রাগীব।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার রাগীব দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, মসজিদের ইমাম ও অন্যান্যদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। তিনি ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’ এর বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন। তাছাড়া ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। লাখ টাকার বিনিয়োগে প্রতি মাসে বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত লাভের প্রলোভন দেখাতেন। ২০০৮ সালে দশ হাজার গ্রাহককে তার কোম্পানিতে যুক্ত করেন। এখন গ্রাহকের সংখ্যা লক্ষাধিক বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এলিট ফোর্সের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতারক রাগীবের তিন শতাধিক কর্মচারী রয়েছে। যাদের কোনো ধরনের বেতন দেওয়া হতো না। তারাই মাঠ পর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে দিত। এতে ২০ শতাংশ লভাংশের প্রলোভন দেখাতো। এভাবেই রাগীবের দ্রুত গ্রাহক বাড়তে থাকে। তবে বর্তমানে তিনি তার কর্মচারী, গ্রাহক সবাইকেই প্রতারিত করেছেন।
রাগীবের ১৭টি প্রতিষ্ঠান
রাগীব আহসান প্রতারণার মাধ্যমে ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেগুলো হলো- এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদ্রাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহ্সান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহ্সান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।
ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন, এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি অর্থ সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি কিনেছেন। এছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। শ্বশুরকে প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবাকে প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতিকে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার করেছিলেন প্রতারক রাগীব।
১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি
রাগীব আহসান গ্রাহকের টাকা দিয়ে হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, মার্কেট-দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এছাড়া রাগীব আহসান সাধারণ গ্রাহককে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারিত করেছেন। অনেকে পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হতেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছে।
এমডব্লিউ/