জুনাইদ আহমদ ।।
জুমার দিন সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। কুরআন হাদিসে জুমার দিনের বিশেষ ফযিলত ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহিমাহুল্লাহুকে জুমারদিন আমল ইত্যাদিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখেছি।
বৃহস্পতিবার রাতে শোয়ার সময় আমাদের বলতেন - আজ জুমার রাত। এ রাত ফযিলতপূর্ণ। ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখো। শেষ রাতে উঠতে হবে, তাহাজ্জুদ পড়তে হবে। শুধু জুমাবার নয় শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যাওয়া ছাড়া কখনো আল্লামা বাবুনগরী রহিমাহুল্লাহুকে তাহাজ্জুদ ছাড়তে দেখিনি। খাদেমদের উদ্দেশ্য করে বলতেন- আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। শরীর কুলায় না। মন চাইলেও অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাহাজ্জুদে উঠতে পারি না। তোমরা যুবক, বয়স কম, শরীর স্বাস্থ্য ভালো তোমাদের। তাহাজ্জুদের এহতেমাম করিও। শেষ রাতে উঠে যাইও।
আগ থেকে ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া থাকতো। তিনটা বাজলে হজরত ঘুম থেকে উঠে যেতেন। অনেক সময় আমাদের ঘুম না ভাঙলেও ঘড়ির এলার্ম বাজার সাথে সাথেই হজরত জাগ্রত হয়ে যেতেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে শারীরিকভাবে হজরত এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, নিজে নিজে ওজু করতে পারতেন না। হজরতের দীর্ঘদিনের খাদেম এনামুল হাসান ভাই গ্রেফতার হওয়ার পর আমিই অধিকাংশ সময় হজরতকে ওজু বানিয়ে দিতাম। ওজু শেষ হলে হজরত আমাদের বলতেন- যাও, তোমরাও ওজু করে তাহাজ্জুদ পড়ো। কেউ ঘুমে থাকলে জাগিয়ে দাও৷ আজ জুমার রাত। কিছু আমল করতে বলো।
জুমার রাতে তাহাজ্জুদ থেকেই শুরু হতো হজরতের জুমার দিনের প্রস্তুতি। তাহাজ্জুদ পড়ে দীর্ঘ সময় জিকির করতেন, আরবী, উর্দু বিভিন্ন শের (কবিতা) পড়ে পড়ে মোনাজাত করতেন। অনেক সময় আমি হজরতের চেয়ারের পেছনে বসা থাকতাম। তাহাজ্জুদের দুআয় হজরতকে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করতে আমি স্বচক্ষে দেখেছি।
শরীর ভাল থাকলে জুমার দিন ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে পড়তেন। নামাযের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত তাসবিহ-তাহলীল পড়ে সূর্যোদয়ের পর ইশরাক পড়তেন। এরপর মসজিদ থেকে রুমে আসতেন। হালকা কিছু নাস্তা-পানি খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন। দশটার পর ঘুম থেকে উঠে গোসল ইত্যাদি সেরে জুমার প্রস্তুতি নিতেন। অনেক সময় জুমার নামাজের আগেই সূরাতুল কাহাফ তিলাওয়াত করে নিতেন।
মাঝেমধ্যে জুমার পূর্বে জামিয়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বায়তুল করীমে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান করতেন। যেদিন হযরত বয়ান করতেন আগ থেকেই বয়ানের প্রস্তুতি নিতেন। নির্ধারিত বিষয়ে হাদিস তাফসীর মোতালায়া করে নিতেন। জুমার বয়ানের জন্য হজরতকে প্রায়ই মিশকাত শরীফ মোতালায়া করতে দেখেছি। আমাকে বলতেন- মিশকাত শরীফটা নিয়ে আসো। আমি হজরতের সামনে কিতাব খুলে ধরতাম। হজরত নিজ হাতে পৃষ্ঠা উল্টাতেন ও আলোচ্য বিষয় সম্বলিত হাদিস খোঁজে বের করে পড়তেন।
অনেক সময় আমি বলতাম, হজরত! আপনি দীর্ঘদিন ধরে বুখারী, মিশকাতসহ হাদিসের কিতাব পড়ান। বয়ানের আগে আবার এতো কষ্ট করে হাদিস দেখে নিতে হয়?
জবাবে হজরত বলতেন- ও মিয়া! জানা থাকলেও বয়ানের আগে মোতালায়া করে নেওয়াটা ভালো। যেন ভুল না হয়ে যায়। হজরত হাফেজে কুরআন ছিলেন। এরপরও জুমাবার বয়ানের আগে বলতেন - ও মিয়া! অমুখ সূরার এত নং আয়াত পড়ো তো। অনেক সময় একটা আয়াত পড়ে বলতেন সামনের আয়াতগুলো পড়ো। আমি পড়তাম। শুধু জুমার বয়ানই নয় বিভিন্ন মাহফিলে বয়ানের আগেও সুযোগমতো হজরত আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত আয়াত, হাদিস দেখে নিতেন।
জুমার দিন হজরত ভালো কাপড় পরতেন। জুব্বা এমনকি টুপিতেও মাড় দিতে হতো। জুমারদিন টুপিও আয়রন করে ব্যবহার করতেন। রুমাল দিয়ে মাথায় পাগড়ী বাঁধতেন। আমাদের বলতেন, দু’হাতের পিঠে, জুব্বায় ও পাগড়ীতে ভালোভাবে আতর সুগন্ধি লাগিয়ে দাও। মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে বারবার জিজ্ঞাসা করতেন- পকেটে তাসবীহ দিয়েছো? নামাজ ছাড়া যতক্ষণ মসজিদে বসতেন তাসবীহ হাতে নিয়ে পাঠ করতেন।
জুমার জন্য রুম থেকে বের হওয়ার আগে হজরত বলতেন, টাকার কৌটা থেকে আমার পকেটে কিছু ভাংতি টাকা দাও। সেগুলো হজরত মসজিদের দান বাক্সে ও মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ফকিরদের বন্টন করে দিতেন।
জুমার নামাজে প্রায়ই আমি হজরতের সাথে থাকতাম। হজরতের হুইল চেয়ারের চাকা ঘেঁষে একই কাতারে বসতাম। জুমারদিন কখনো পকেটে ভাংতি টাকা নিতে ভুলে গেলে যখন খুতবার আগে মসজিদের দানবাক্স সামনে আসতো হজরত আমাকে বলতেন- ও মিয়া! কিছু ভাংতি টাকা কর্জ দাও। নামাজ শেষে রুমে গিয়ে তোমাকে দিয়ে দিবো। আমি পকেট থেকে কিছু ভাংতি টাকা হজরতকে কর্জ দিতাম। হজরত নিজ হাতে মসজিদের দানবাক্সে দিতেন। নামাজ শেষে রুমে আসা মাত্রই আমার কর্জ পরিশোধ করে দিতেন।
এক জুমাবার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আমার হাতে পাঁচশত টাকা দিয়ে হজরত বললেন- এই টাকাগুলো ফকিরদের মাঝে বন্টন করে দাও। শুধু জুমাবার নয় এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হজরত প্রকাশ্যে-গোপনে অসহায় মানুষদের দান-সাদকা, খয়রাত করতেন। কোন অসহায় মানুষ আল্লামা বাবুনগরী রহ. এর কাছে এসে নিজের অভাব-অনটনের কথা জানালে হযরত রহ. তাকে নিজের সাধ্য অনুযায়ী দান করতেন। তার অসহায়ত্ব দূর হওয়ার জন্য দুআ করতেন। অভাব অনটন দূর হওয়ার বিভিন্ন আমল শিখিয়ে দিতেন।
জুমার নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় মুসল্লিরা দলবেঁধে হজরতের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কুশল-বিনিময় করতেন। হজরতও পরিচিত-অপরিচিত সবার খোঁজখবর নিতেন। অনেকের মাথায় হাত বুলিয়ে দুআ করতেন।
করোনা পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অনেক সময় আমরা হজরতকে বলতাম, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ডাক্তারের পরামর্শ হলো যথাসম্ভব মুসাফাহা না করা। আর আপনি জুমাবার সবার সাথে মুসাফাহা করেন। এতে সংক্রমণ হতে পারে। হজরত তখন নিম্নের হাদিসটি পাঠ করে বলতেন- مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا " . অর্থ: দুইজন মুসলিম পরস্পর মিলিত হয়ে মুসাফাহা করলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়।
জুমার পর মসজিদ থেকে রুমে এসে খাবার-দাবার সেরে খাদেমদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। খোঁজখবর নিতেন। কোন মেহমান সাক্ষাৎ করতে এলে তাদের সময় দিতেন। কথা বলতেন।
আসরের নামাজ পড়ে চেয়ারে বসে তাসবীহ-তাহলিল পড়তেন। দরূদ শরীফ পড়তেন। মাগরিবের আজানের আগে দুআ করতেন। এভাবেই কাটতো আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহিমাহুল্লাহুর জুমাবার।
স্মৃতিচারণে - খাদেম: আল্লামা বাবুনগরী (রহ.)
এমডব্লিউ/