মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী।। গত ২২ আগস্ট ২০২১, রোজ রোববার রাজধানীর মিরপুরস্থ মারকাযুদ্ দিরাসাহ্ আল ইসলামিয়া ঢাকা-এর মাদানী অডিটরিয়ামে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সদ্যপ্রয়াত আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ.-এর জীবন ও কর্ম শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের বক্তব্য থেকে আল্লামা বাবুনগরী রহ.-এর জীবনের চারটি অনন্য বৈশিষ্ট নোট করেছেন মারকায পরিচালক মুফতী মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী। নিচে তা তুলে ধরা হলো-
এক, (ملازمة الاساتذ ة) সর্বদা উস্তাদদের সাথে নিয়মিত সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করা। যে সকল গুণাবলি আল্লামা বাবুনগরীকে সফলতার এই উচ্চ শিখরে এবং সম্মান-মর্যাদার এই উচ্চাসনে সমাসীন করেছে তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু নিজ শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন এবং তাদের দিকনির্দেশনাকে সামনে রেখেছেন।
দুই, (العيش مع رفوف المكتبات) লাইব্রেরির বুকসেল্ফে জীবন পার করা।
আল্লামা বাবুনগরী মানে নিরন্তর পড়াশোনা, গভীর অধ্যবসায়, মুতালাআ এবং কুতুববীনি। রাতদিন একাকার করেছেন কিতাব মুতালাআলার মাধ্যমে। গভীর রাতেও তার রুমে টিমিটিমি করে হারিকেনের আলো জলতে দেখেছেন তার সমসাময়িকরা। ১৯৭৮ ঈসাব্দে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে সম্পন্ন করে হযরত মাওলানা আব্দুল ওহহাব রহ. এর সত্যায়নপত্রসহ করাচীর জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়াতে ভর্তি প্রার্থী হিসেবে উপস্থিত হলে জামিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা ইউসুফ বিননোরী রহ. তার ভর্তির আবেদন পত্রে কোন রকম ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি অনুমোদন করেন।
কিন্তু বিভাগীয় প্রধান আল্লামা আব্দুর রশীদ নোমানী রহ. ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির অনুমোদনকে নাকচ করে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তিন মাস সময় দেন। এই তিন মাস আল্লামা বাবুনগরীর সকাল-সন্ধ্যা, রাতদিন পুরো সময় কেটেছে জামিয়ার কুতুবখানায়। ঐতিহ্যবাহী এ জামিয়ার বর্নাঢ্য লাইব্রেরীর বিশাল আয়োজনের আরবী ও উরদুতে সংকলিত তাফসীর, হাদীস, তারীখ, ফিকহ ,উসূলসহ প্রায় সকল কিতাবাদীর মুতালা'আ তিনি সম্পন্ন করেন। তিন মাস পরে আল্লামা নো'মানীর খেদমতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য উপস্থিত হলে আল্লামা আব্দুর রশীদ নো'মানী বলেন,
যাও, তোমার ভর্তি চূড়ান্ত ও অনুমোদিত। অবাক ও আশ্চর্য হয়ে ভর্তি প্রার্থী ছাত্র জুনায়েদ বাবুনগরী নিবেদন করেন-
আমারতো ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো!
জবাবে আল্লামা নোমানী বলেন- তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি মূলত দেখতে চেয়েছিলাম- আমার এ ধরনের কথার পরে তোমার মাঝে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আমি তা দেখে নিয়েছি। তোমার পরীক্ষায় পাশ করেছো। এই তিন মাস পর্যন্ত তেমার গতিবিধি, চলাফেরা,ওঠাবসা, কুতুবখানায় তোমার মুতালা'আ সবকিছুই আমার সামনে। অতএব, যাও এবার পড়তে থাকো আর আগাতে থাকো।
তিন, (الثبات على الحق) সত্য ও ন্যায়ের উপর অবিচলতা।
এটা ছিলো আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ এর জীবনের সবচে' বড় বৈশিষ্ট্য। যে বিষয়টি আল্লামা বাবুনগরীকে আর দশজন আল্লামা থেকে স্বতন্ত্র করেছে তা হলো আল্লামা বাবুনগরীর এই ন্যায় ও সত্যের পথে অটলতা। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে তিনি ছিলেন আপোষহীন এক লৌহমানব। শানে রেসালাত, খতমে নবুওয়াত, আজমতে সাহাবা, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বসিদ্ধি আকিদা ও আমলের হেফাজত, কুরআন-সুন্নহর যথাযথ রক্ষণ ও পালন, কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা সংরক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে তার দীর্ঘ আন্দলোন-সংগ্রামের পথে তিনি সামান্যতম ছাড় দেননি।
চার, (الصبر على البلاء ) বিপদাপদে আল্লাহমুখী হয়ে ধৈর্য ধারন করা, শারীরিক-মানসিক ভেঙ্গে না পড়া।
কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এটি বিনা হিসেবে মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাদের একটি গুণ। আল্লামা বাবুনগরী ছিলেন বিপদে ধৈর্য ধারনের এক মূর্তপ্রতিক। ৫ই মে ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন মহাসচিবের দায়িত্ব পালনকারী আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর পরবর্তী সময়টা ছিলো অত্যন্ত প্রতিকূল। মামলা-হামলা ইত্যাদিতে জর্জরিত হয়ে একপর্যায়ে তিনি শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি ধৈর্যের পাহাড়।
যুগযুগান্তরে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ এর এই অনুপম জীবনাদর্শ গুলো সারা পৃথিবী বিস্তৃত তার হাজারো লাখো ভক্ত-অনুরক্ত এবং ছাত্র-শিষ্যদের জন্য এক প্রত্যজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
-এটি