আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তান এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলা করছে। দেশটিতে মহামারী পুনরুজ্জীবন লাভ করার পর টিকাদান কর্মসূচীরও প্রসার ঘটানো হয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী ডা. ফয়সাল সুলতান অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, এই ভ্যারিয়েন্ট ৫০-৬০% গতিতে বিস্তার লাভ করছে।
পাকিস্তানে সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউ আসছে। টিকার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. ফয়সাল বলেছিলেন, হাল আমলের টিকাগুলো ভাইরাসের সকল ভ্যারিয়েন্ট এর বিরুদ্ধেই কাজ করে। ভিন্ন ভিন্ন টিকার কার্যকারিতার হার ভিন্ন ভিন্ন। তাছাড়া, টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা ফের সংক্রমিত হতে পারেন। হুট করে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জীবিকার তাগিদে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়াকেও দায়ী করেন।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক নিউজ ইন্টারন্যাশনাল জুলাইয়ের ২৮ তারিখ এক প্রতিবেদনে জানায়, দীর্ঘ দুই মাস পর পাকিস্তানে করোনায় শণাক্তের সংখ্যা আবারো ৪,০০০ অতিক্রম করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বরাতে বলা হয়, জুলাই মাসে পাকিস্তানে করোনায় মৃত্যুহার বৈশ্বিক মৃত্যুহারকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে পাকিস্তানে মৃত্যুহার ২.৩০% থেকে ২.৩৭%% এর মধ্যে ছিল। যেখানে জুলাই মাসে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার ছিল ২.১৫% থেকে ২.১৭% এর মধ্যে।
দেশটির প্রভাবশালী পত্রিকা ডন জানিয়েছে- চলতি (আগস্ট) মাসের প্রথম দিন পাকিস্তানে (আগের ২৪ ঘণ্টায়) ৫,০২৬ জনের করোনা শণাক্ত হয়। এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখের (৫,১১২ জন) পর থেকে এটাই ছিল দেশটিতে প্রতিদিনের হিসেবে সর্বোচ্চ শণাক্তের ঘটনা। পাকিস্তানে করোনা পরিস্থিতি যে দিন দিন কতোটা খারাপ হচ্ছে করোনা শণাক্তের ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।
সম্প্রতি পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সিন্ধু প্রদেশ গত শুক্রবার থেকে লকডাউনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এর আগে সেখানকার চিকিৎসকরা স্থানীয় সরকারকে অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর দ্রুত বিস্তার নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
এর আগে কয়েকদিন ধরে, করাচীর হাসপাতালগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকরাও করোনা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। ২ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই 'পরিস্থিতি বিশেষভাবে খারাপ' এমন বেশকিছু শহরে আরো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়।
২ ফেব্রুয়ারি চীনের দেয়া উপহারের ৫ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছিল পাকিস্তান। জুনে খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান চীন থেকে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন পেয়েছে তার ৯ শতাংশই উপহার হিসেবে পাওয়া।
এ ছাড়া পাকিস্তান নিজ দেশে মে মাস থেকে চীনের (এক ডোজের ভ্যাকসিন) ‘ক্যানসিনো’ উৎপাদন করছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। তখন জানা যায়, এ বছরের মধ্যেই চীনের সিনোফার্মের ৩ কোটি, সিনোভ্যাক ও ক্যানসিনো ভ্যাকসিনের ২ কোটি ডোজ আনার পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তান সরকার।
পাকিস্তানের পরিকল্পনা মন্ত্রী আসাদ ওমর ৩ আগস্ট এক টুইটে জানান, দেশটি একদিনে ১০ লাখ ডোজ টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। ১০ লাখ বা এর বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এমন শহরগুলোর মধ্যে ইসলামাবাদ প্রথম শহর যেখানে টিকা নেয়ার যোগ্য জনসংখ্যার ৫০ শতাংশকেই কমপক্ষে এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর আগে ১ আগস্ট আসাদ জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান ৩ কোটির বেশি টিকাদান সম্পন্ন করেছে। প্রথম কোটি দিতে সময় লেগেছিল ১১৩ দিন। দ্বিতীয় কোটি দিতে মাত্র ২৮ দিন। আর, তৃতীয় কোটি দিতে কেবল ১৬ দিন লেগেছে। গত ৬ দিনে ৫০ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছে। "
একদিনে ১০ লাখ ডোজ টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার ঘটনা নিশ্চিত করেছে ইউনিসেফ, পাকিস্তানও। ৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক এ দাতব্য সংস্থাটি জানায়, কোভাক্সের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৮০ লাখেরও বেশি টিকা পাকিস্তানে এসেছে এবং আরও অনেক চালান আসার পথে। টিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২৪ লাখ, ফাইজারের ১ লাখ ১৬০ এবং 'কোভ্যাক্স ডোজ-শেয়ারিং' পদ্ধতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান মডার্নার ৫৫ লাখ ডোজ।
বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, পাকিস্তান সরকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে চীনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভ্যাকসিনের প্রায় ৩ কোটি ডোজ কিনে ফেলেছে। মাসে ৩০ লাখ ডোজ সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি সম্প্রতি চীন থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক-ডোজের ভ্যাকসিন 'পাকভ্যাক' এর বোতলজাতকরণ শুরু করেছে।
সরকার ঘোষণা করেছে, আগামী কয়েক মাসে ১ কোটি ৩০ লাখ ডোজ ফাইজার ভ্যাকসিন কিনবে। দেশটির সাড়ে ২২ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দিতে যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা সম্পন্ন করেছে। স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রবীণ নাগরিকদের টিকা দেওয়ার পর, পাকিস্তান ধীরে ধীরে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য টিকা উন্মুক্ত করতে থাকে। সরকার ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে কেন্দ্র এবং "হটস্পট" এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামীণ সম্প্রদায়ের তুলনায় করোনা সহজে ছড়িয়ে পড়ে।
ডন জানায়, টিকা না নেয়া মানুষদের মোবাইল ফোনের সিম ব্লক করা হবে এবং তারা আগস্টের বেতন পাবেন না- সিন্ধু সরকার এমন ঘোষণা দেয়ার পর করাচীর কেন্দ্রগুলোতে টিকা নিতে আসা মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা) পাকিস্তানের ন্যাশনাল কমান্ড অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার (এনসিওসি) এর মতে, দেশজুড়ে মোট ৪০,৬৬৪,১১০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৩২,৬০৭,৮৮৪ জন। আর সম্পূর্ণভাবে টিকা দেওয়া হয়েছে ১১,৪৯৭,৪৬২ জনকে। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে শণাক্ত হয়েছেন ৪,৯৩৪ জন।
এদিকে, ইংরেজি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে বলেছে- ৬ আগস্ট যুক্তরাজ্যের উর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জেও চার্চিল বলেছেন "করোনা পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান অবনতি এবং টেস্টের হার কম" হওয়ার কারণে পাকিস্তানকে ব্রিটেনের "লাল তালিকায়" রাখা হয়েছে। সহকর্মীদের কাছে লেখা এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "গত ৭ দিনে, পাকিস্তানে করোনায় সংক্রমণ আগের সপ্তাহের (১৯-২৫ জুলাই) চেয়ে ৮৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে মৃত্যুর ঘটনা ৭৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। 'টেস্ট পজিটিভিটি'ও উচ্চ এবং ক্রমবর্ধমান। ২৬ জুলাই যা ছিল ৫.৬%, ৩ আগস্ট তা বেড়ে হয়েছে ৭.৯%।
-এটি