মুফতী রেজাউল করিম।।
আত্মমর্যাদাবোধের মূর্ত প্রতীক ছিলেন আল্লামা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ্ রহ.। মাগুরা জেলায় আমার পার্শবর্তী ইউনিয়নের বেরইল গ্রাম ছিল তাঁর পূর্ব পুরুষ ও বংশীয় লোকদের বসতী। তাঁর বাবা মাওলানা কাজী সাখাওয়াত হুসাইন রহ. দ্বীনি খিদমাতের নিসবতে যশোরে পাড়ি জমান। পরবর্তিতে যশোর ঝুমঝুমপুর গ্রামে তিনি স্থায়ীভাবে বসতী স্থাপন করেন। তাঁর নসলের সবাই এখন সেখানেই বসবাস করেন। কাজী সাহেব হুজুরের মামা বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। তাঁর মামারা কালীগঞ্জ শহরে বসবাস করেন। তারা পীর বংশ। পীর বাড়ী নামেই তাদের বাড়িটি পরিচিত। তাঁর জন্ম হয় মামা বাড়িতে এবং শৈশবকালও মামা বাড়িতেই কাটান। তিনি বিবাহ করেন মাগুরায়। তাঁর শ্রদ্ধেয় শশুর মাগুরার প্রসিদ্ধ পীর হাজী আব্দুল হামীদ রহ.।
হুজুরের নিজের ভাষ্যমতে তাঁর পূর্বপুরুষগণের মূল বাড়ি ছিল বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার শিবালায় উপজেলার এলাছিপুর গ্রামে। তাঁর পূর্ব পুরুষদের কেউ একজন হিজরত করে বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ শহরের উপকন্ঠ কালীচরণপুর গ্রামে আসেন। পরবর্তীতে তিনি কালীগঞ্জ নলডাঙ্গা রাজার বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তারই পরবর্তী বংশধর কাজী শাকির হুসাইন বিবাহের সুবাদে বর্তমান মাগুরা জেলার বেরইল গ্রামে স্থায়ী বসতী স্থাপন করেন। তাঁর বাবা যশোর কালেক্টর মসজিদের (যশোর জামে মসজিদ) আমৃত্যু ইমাম এবং মনিরামপুর লাউড়ী আলিয়া মাদরাসার মুদাররিস ছিলেন।
কাজী সাহেব হুজুর শুরু থেকে বাবার কর্মস্থল লাউড়ী আলিয়া মাদরাসায় লেখা-পড়া করেন। অতপর উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। সেখানে কয়েক বছর লেখা-পড়া ও শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর সুহবতে আধ্যাত্মিক মেহনতের পর দেশে ফিরে এসে লাউড়ি মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। অতপর ঢাকা বড়কাটারা, কিশোরগঞ্জ জামিয়া এমদাদিয়া, মোমেনশাহী কাতলাসেন আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত হন। সেখানে তাঁর মাসিক হাদিয়া ছিল আটশত টাকা। তখনকার একটি মজার ঘটনা হুজুরের মুখ থেকে বারবার শুনেছি। তিনি বলেন-‘কাতলাসেন মাদরাসাসহ আশপাশের কোন মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন এতো বেশী ছিল না। তাই এলাকাবাসী আমাকে দেখতে আসতেন’। (হুজুর মজাক করে তাঁর স্বভাবজাত ভঙ্গিতে বলতেন, এলাকার লোকজনে দেখতে আসতেন, আমাদের প্রিন্সিপাল সাহেব আটশত টাকা দিয়ে কুরবানীর কত বড় ষাঁঢ় কিনে এনেছেন একনজর দেখে আসি।) সেখান থেকে একসময় তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসায় খেদমতে নিয়োজিত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর হুজুর যাত্রাবাড়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের মত করে মাদরাসাটিকে গড়ে তোলেন। এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ইতিহাস ও কষ্টের কথা আছে যা আমি হুজুরের যবান থেকে নিজ কানে বহুবার শুনেছি। সেগুলো আলোচনা করলে অনেকের ব্যাপারে আমাদের কু-ধারণা তৈরি হতে পারে; তাই তার অবতারণা করছি না।
হুজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী ফাউন্ডেশনসহ অনেক দ্বীনি ও দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠানে খিদমাত করেছেন। সে সুবাদে তাঁর জন্য দুনিয়াবী ফায়দা হাসিল করা অনেক সহজ ছিল, কিন্তু তিনি তা করেননি বরং দু‘পায়ে ঠেলে দিয়েছেন দুনিয়াকে।
এমন প্রস্তাব কীভাবে প্রত্যাখ্যান করে!
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোর্কারমের অধিকাংশ দোকান পাকিস্তানীদের ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে যখন তারা দেশ ত্যাগ করে চলে যায়, তখন কোন এক বৈঠকে আল্লামা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ রহ. হুজুরকে প্রস্তাব করেছিলেন, ‘কাজী সাব! পাকিস্তানীরা চলে গেছে তাদের দোকানগুলো পড়ে আছে, আপনার নামে একটা দোকান বরাদ্ধের ব্যবস্থা করে দেই? কাজী সাহেব হুজুর রহ. তখন হেলান দিয়ে বসা ছিলেন, তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন- ‘তর্কবাগীশ সাহেব! আপনি কার মালিকানাধীন দোকান আমাকে বরাদ্ধ দিবেন? এই প্রশ্ন শুনে তর্কবাগীশ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন।
আত্মমর্যাদাবোধে আকাবিরের নমুনা
হুজুর বলতেন, ‘আমি বিত্তশালী লোকদের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারি না’। আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেন! হুজুর বলেন-‘আমার মনে হয় এতে ইলমের ইহানত হয় এবং আকাবির ও আসলাফের মান ক্ষুন্ন হয়।’ অনেক বিত্তশালীদের সাথে সম্পর্ক ও তা ছিন্ন হওয়ার ঘটনা আমাদেরকে শুনিয়েছেন। সম্ভবত ২০০৮/৯ ঈ. সালে হুজুর সস্ত্রীক হজ্বব্রত পালন করেন। এটিই ছিল হুজুরের জীবনের শেষ হজ্বব্রত পালন। হুজুর বলেন- ‘শেষ পর্যন্ত একজন ধনী লোকের সাথে আমার সম্পর্ক আছে তবে ক’দিন থাকবে জানি না। (উক্ত হজ্বের সফরে তিনিও স্ত্রীসহ হজ্বে গিয়েছিলেন। হুজুরের সাথে একই কাফেলায় ছিলেন। ভদ্রলোকের বাসা ঢাকা মধ্যবাড্ডায় সম্ভবত।) তিনি হজ্বের সফরে আমার এত বেশী খেদমত করেছেন, যা বলে বোঝাতে পারবো না। দেশে আসার পরে তিনি ও তার স্ত্রী অনেক হাদিয়া-তোহফা নিয়ে আমার বাসায় এসেছেন। আমাদেরকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য খুব বলে গেছেন।’ আমরা বললাম, তিনি মনে হয় অনেক মুখলিস মানুষ, তার বাসায় গেলে অসুবিধা কী! একই উত্তর, ‘আমার মনে হয় ইলমের ইহানত হয়ে যায়। আকাবিরের অপমান হয়ে যায়।’ আমার জানা মতে হুজুর সে বাসায় যাননি কখনোও। হয়ত লোকটি আরো কয়েকবার এসেছেন ও খোঁজ-খবর রেখেছেন।
২০১০ঈ.। আমরা মালিবাগ জামিয়ায় দাওরা পড়ি। একদিন হুজুর দরস সমাপ্ত করে বসলেন। ইতোমধ্যে মধ্য বয়সী একজন আলেম কামরায় ঢুকলেন। হুজুরের কুশলাদী জানার পর বললেন, ‘হুজুর! আমার ছেলেকে এ বছর এখানে ভর্তি করিয়েছি, সে এমদাদী বরাদ্ধের জন্য দরখাস্ত করেছে, এখনো তা মঞ্জুর হয়নি’। হুজুর বললেন, ‘আমার সামনে যত দরখাস্ত এসেছে আমি সবগুলো দস্তখত করে দিয়েছি’। লোকটি বললেন, ‘ও আরবীতে দরখাস্ত লিখেছে’। হুজুর বললেন, ‘হয়ত অফিস সহকারী বুঝতে পারেনি। আমি আগামীকাল খোঁজ নিয়ে মঞ্জুর করে দিব, ইনশাআল্লাহ্।’ আমরা সবাই হুজুরের সাথে গল্প-গুজব করছি। হুজুর যখন বাসায় যাওয়ার জন্য উঠলেন, লোকটি হুজুরের সামনে কিছু ফল-মূল ইত্যাদি হাদিয়া পেশ করলেন। হুজুর দেখেই উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,‘ইন্নালিল্লাহ! এটা রেশওয়াহ! এটা ঘুষ! আমি এ গ্রহণ করতে পরবো না।’ লোকটি হতচকিত হয়ে হুজুরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন এবং অবোধ শিশুর মত বলতে লাগলেন, হুজুর! আমি কি দীর্ঘদিন আপনার খেদমত করিনি! আমি আপনাকে মুহাব্বত করি। আপনার কারণে আজ আমার এতো এতো সম্মান-মর্যাদা। আমি কী আপনাকে একটু হাদিয়া দিতে পারবো না! আমার ছেলেকে প্রয়োজনে এখানে পড়াবো না, অন্য কোথাও নিয়ে যাব। তবুও আপনি আমার হাদিয়াটুকু গ্রহণ করুন।’ তার কান্না আর আঁকুতি দেখে আমরা হুজুরকে সুপারিশ করে বললাম, এটা ঘুষ হবে কেন? আপনিতো মাদরাসার নেজাম অনুযায়ী তার দরখাস্ত মঞ্জুর করবেন। তিনি তো আপনার মহব্বতে কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছেন। তবুও হুজুর নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। আমাদের কেউ একজন হুজুরের নাতী মাকনূনকে ডেকে তার হাতে পোটলাটি ধরিয়ে দিল।
জীবনে সাদাকায়ে ফিতর ও কুরবানী ওয়াজিব হয়নি কোন দিন!
২০০৯ ঈ.। জিলহজ্বের ৯ তারিখ বিকেল বেলা। আমাকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘রেলগেইট থেকে একটা বকরী কিনবা। খাবার ও কসাইয়ের টাকা ফেরত আনবা’। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাত্র ৩ হাজার টাকা! তা থেকে আবার কসাই ও খাবার কেনার টাকা বাঁচাতে হবে! হুজুর বললেন, ‘আমার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, আমার ছেলে কুরবানী করার জন্য ৩ হাজার টাকা দিয়েছে, এ টাকা দিয়েই সারতে হবে, অতিরিক্ত খরচ করার মত টাকা নেই।’
জিলকদের শেষ দিকে একদিন হুজুরের মাথা মুন্ডন করে দিচ্ছিলাম। কথায় কথায় কুরবানী প্রসঙ্গ আসলে হুজুর বললেন, ‘আমার উপর কখনো সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়নি, আমি এখন কোন সম্পদের মালিক নই। আমার বাড়িতে যে বিল্ডিংটা আছে তা তোমার আম্মার ফারাজের টাকা দিয়ে করা, যেহেতু সে তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে ঘর করবে তাই আমি আমার নামে থাকা বাড়ির জমিটুকু তার নামে লিখে দিয়েছি। আমি এখন ভার মুক্ত। মৃত্যুর পরে আমার সম্পদের কোন হিসাব দিতে হবে না।
সততায় অতুলনীয়
২০১০ ঈ.। কাজী সাহেব হুজুর এখন খুব বেশী সুস্থ থাকেন না। কখনো বাসায় আবার কখনো হাসপাতালে, এভাবেই কাটছে। খুব কম সময় দফতরে বসেন । সাধারণত ১১.৩০/১২.০০ টায় বাসায় চলে যান। একদিন দেখতে পেলাম, হুজুর অফিস ও দফতরের সামনের বারান্দায় অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর বাসায় যাবেন না! হুজুর বললেন, ‘সরকার সাব কোথায় গেছে? (সরকার পরিভাষাটি মালিবাগে যারা পড়েছেন তাদের জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। জনাব রজব আলী, যিনি মালিবাগের হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন, তাকে সবাই সরকার নামেই চিনত) এক লোক তাকে না পেয়ে আমার কাছে মাদরাসার কিছু টাকা রেখে গেছেন, সেগুলো তাকে বুঝিয়ে না দিয়ে বাসায় যাই কী করে!’ দীর্ঘক্ষণ পরে সরকার সাব আসলে টাকা বুঝে দিয়ে বাসায় ফিরেছেন। এ নজীর এখন জুড়ি মেলা ভার।
স্বপ্ন পূরণ হলো না!
হুজুর মাগুরায় দাদার বাড়ি বেরইল আসবেন। কালুপাড়া মাদরাসা সফর করে নানা বাড়ি গোপালপুর যাবেন। একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘মামাদের অনেক জায়গা-জমি আছে। তাদের সাথে কথা বলে সেখানে একটি মাদরাসা করবো। মাহবুব (হুজুরের বড় সাহেবজাদা) শিক্ষকতা করবে। তোমার ভাই (কাসেমুল উলূম কওমী মাদরাসা কালুপাড়া (রহমতপাড়া) মাগুরা এর মুহতামিম মনিরুজ্জামান) কে দেখা-শোনার দায়িত্ব দিব। আমি মারা গেলে উক্ত মাদরাসার পাশে দাফন করবে।
আমার ভাইসহ যাদের সাথে আলোচনার প্রয়োজন ছিল করেছি। দিন-ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! হুজুর বড় ধরণের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এরপরে আর মাগুরা সফরের হিম্মত করতে পারলেন না। (আমার জীবনে আশা ভঙ্গের যত বেদনা এরচে‘ বেশি আর কোনটি নেই।)
আমাদেরকে এতিম করে বন্ধুর দরবারে হাজিরা
২০১৩ ঈ.। পবিত্র রমযান মাসের ৫ তারিখ। আমি এ বছর আমার শায়খ ও মুর্শিদ আল্লামা মুফতী হাফীজুদ্দীন দা.বা. এর মসজিদ মালিবাগ বাগানবাড়িতে খতমে তারাবীহ পড়াই। মাগরিবের নামাজ শেষ করার পরপরই সংবাদ আসল কাজী সাহেব হুজুর ইন্তিকাল করেছেন। সংবাদটি শুনে এক মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে গেলাম। মেনে নিতে পারছিলাম না, হুজুর আমাদেরকে এতীম করে চলে গেছেন! বিষন্ন মনে উল্কাবেগে ছুটে চললাম, জামিয়ার দিকে। দেখি ইতোমধ্যেই অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছেন। সবাই অস্থির হয়ে ছুটছে শেষবারের মত হুজুরের নূরাণী চেরহারাখানা দেখার জন্য। আমিও হন্যে হয়ে ছুটে গেলাম সবার সাথে। চেহারায় নযর পড়তেই অশ্রুরা বাঁধভাঙ্গা বানের ন্যায় উতাল পাথাল করে ছুটতে শুরু করল। আপনজন হারানোর বেদনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে হৃদয় ও মন।
আহ্! কি চমৎকার মুখচ্ছবি! মনে হচ্ছে যেন কারো সাথে মিটি মিটি হাসছেন তিনি। হে আল্লাহ! আমার শায়খ ও মামদূহের কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দাও। আমাদেরকে তাঁর রুহানী ফয়েজ দান করো। আমীন।
লেখক: ফাযেলে মালিবাগ জামিয়া -২০১০/১১ইং, নায়েবে মোহতামীম কাসেমুল উলুম কওমী মাদরাসা কালুপাড়া (রহমতপাড়া) মাগুরা।
-এএ