বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


যে প্রভায় আমি বিভাময়: আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালটা মনে নেই। মনে রাখার চেষ্টাও করিনি। জামিয়া ইমদাদিয়া কিশােরগয়ে হেদায়াতুন্নাহু পড়ি। আশৈশব শিক্ষাগুরু হযরত মাওলানা কুত্বুদ্দীন রহ.-এর কামরা থেকে মাদরাসার দক্ষিণ দালানের দিকে কী একটা কাজে যাচ্ছিলাম। সারিবদ্ধ কামরা, আসাতেযায়ে কেরাম বসবাস করেন। কোনার কামরাটার দরজা একটু ফাঁকা ছিল। নজর পড়ল ভিতরে।

সুবাহানাল্লাহ কী হেরিলাম! শ্বেতশুভ্র বসন, সফেদবর্ণের মাদানী দু’পাল্লা টুপি শিরােপরি ভূষিত। ছােট্ট অবয়বের এক মহান অস্তিত্ব প্রভু সমীপে নিবেদনরত। চোখ বিস্ফারিত হল । সারাটা কামরাই যেন শ্বেতশুভ্র শুচিতায় বিভাময় হয়ে আছে। আলাের ঝটকা প্রভা ছড়াচ্ছে। এত আলােময় মানুষ দেখেছি বলে মনে পড়ল না। তিনি যে বাহ্যিকভাবে এতটা ফর্সা ছিলেন, সে দিকে আমার নজরও গেল না। হৃদয়ের তাবৎ নূরময়তায় গাত্রবর্ণ ছিল উজ্জ্বল। চেহারা দ্যুতিময়।

এই ছিল আপাদমস্তক হাদীস বিশারদ, শব্দের পরতে পরতে ডুব দিয়ে জ্ঞানসমুদ্রের মণিমাণিক্যআহারী সত্তা হযরত মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ.-এর সাথে এই অধমের প্রথম দর্শন।

‘ফির তাে মর মিটা’। সঁপে দিলাম অজান্তে নিজেকেই। এই অধম বঙ্গভাষা চর্চায় তখন অতিউৎসাহী। বাঙালিত্বের ফযীলত অন্বেষায় উদগ্রীব। ক্রমে প্রতীতি পেলাম হযরত মাওলানাও এ বিষয়ে একান্ত একনিষ্ঠ। কত দিন বলেছেন, বড় কাটারা মাদরাসায় পড়ানাের। সময় প্রতিদিন বিকালে গাঁটের পয়সা খরচ করে পাবলিক লাইব্রেরিতে আসতেন, আর তারাশঙ্কর, মনােজবসু, শংকর, যাযাবর, বিমলমিত্র, মুজতবা আলীদের গােগ্রাসে গিলতেন। একদিন বললেন, আজ তিন রাত ঘুমাইনি। বিমলমিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ খতম হল।

এই অধমও একটু আধটু বঙ্গকীর্তন করি। বাবার কাছে মধুকবির মেঘনাদবধ সবে শেষ করে কালিদাসের মেঘদূতের পাঠ নিচ্ছি। রবীন্দ্র-নজরুল তাে নস্যি। মনে আর স্বভাবে মিলে গেল। অবসরে কাজী হুজুরের কাছে ঘুরঘুর করি। তিনিও হয়তাে বনেদী মাদরাসার পরিবেশে এই বঙ্গসন্তান পেয়ে আহ্লাদিত হয়েছিলেন। সেকালে বিষয়টা ছিল দুর্লভ। তাই নিজেকে উজাড় করে গড়ে পিটে নিচ্ছিলেন অধমকে। তালীম ও সতর্ক তরবিয়তের সেই শুরু। মরণভেলার শেষ তীর্থ পর্যন্ত যা অবিচ্ছিন্ন নিরবধি অব্যাহত ছিল।

হযরত কাজী হুজুর রহ.ছিলেন দেদীপ্যমান মহাভাষ্কর শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.এর চেতনায় আপ্লুত। এক রত্তি তা থেকে হটা ছিল তার জন্য মৃত্যুতুল্য। এই আমাকেও রাঙ্গাতে ব্রতী হলেন সেই অভিরঞ্জনে। আমার শৈশব পরিবেশ হযরত শায়খুল ইসলাম রহ.এর নাম ততবেশি শুনতে অভ্যস্ত ছিল না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনি তার কাছে ইতিহাসের সেই মহানায়কের কথা। তার সংগ্রাম, তার মেধা, তাঁর তাকওয়া, যুহদ ও কানাআত আর ইলমী সমুদ্রমেখলার ধারাচিত্রণ।

ক্রমে একটা জামাআত তৈরি হল হযরত কাজী হুজুর রহ.-কে ঘিরে। ইসলামের স্বভাব, ইসলামের মেজাজ, আকাবির বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। বিশেষ করে হযরত মাদানী রহ.-এর ব্যাখ্যার আলােকে কুরআন হাদীসের সঠিক চেতনা বদ্ধমূল করার প্রয়াস নিলেন। তিনি আমাদের বুঝালেন ইসলাম কত উদার, অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল জীবনবাদী আদর্শ।

এর সমর্থনে বহু কুরআন-হাদীস এবং সাহাবীগণের জীবনাচার পেশ করতেন। পরবর্তীতে কিছু কিছু বিষয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে মতানুকূল না হওয়ায় নিজেকে জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে সরিয়ে নেন এবং কাতলাসেন মাদরাসার দরসে বুখারীর পাশাপাশি হযরত মুফতি মাহমুদ রহ. এবং হাজারভী রহ.-এর নেতৃত্বে জমিয়তে উলামার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি মুফতি মাহমুদ রহ.-কে হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর চিন্তাধারার বলিষ্ঠ অনুসারী বলে ভাবতেন।

মুফতি সাহেবও তাঁকে অত্যন্ত ধীমান ও গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী এবং হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর চিন্তাচেতনার বলিষ্ঠ ধারক বলে ভাবতেন। অনেক সময় বলতেন, তােমরা কাজী সাহেবকে মাটির উপরে যতটুকু দেখছ মাটির গভীরেও তিনি তা-ই।

বাতিলের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদাজাগ্রত প্রহরী। ইসলামের আওয়াজে যে সব বাতিল চোরাই পথে সমাজে স্থান করে নিচ্ছিল, বিশেষ করে মওদুদীবাদীদের তিনি সবিস্তার মুখােশ খুলে ধরেন। খতমে নবওয়াত আন্দোলনের ছিলেন অন্যতম সিপাহসালার। ঢাকায় হযরত মাদানী রহ.-এর চিন্তাচেতনার অধিকারী কেন্দ্রীয় কোনাে প্রতিষ্ঠান ছিল না। হযরত দরখাস্তী রহ. ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী ঢাকায় একটা প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র হিসেবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এর কর্ণধার হিসে সবার দৃষ্টি ছিলো কাজী হুজুরের প্রতি। তিনি কাতলাসেনের নিরাপদ উপার্জনের সুশান্ত আশ্রয় ছেড়ে বুখারি শরীফের দরসের স্থলে এক কথায় সবকিছু কুরবানী দিয়ে আশৈশব লালিত স্বপ্ন পালনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে আসেন। অথচ বলতে গেলে মাদরাসাটি তখন একটা মক্তব মাত্র। স্ত্রী-পুত্র-সংসার এবং নিজেকে নিঃশেষ উজাড় করে দিয়েছিলেন এ মাদরাসাটি গড়ে তুলতে।

মনে পড়ে কতদিন এমন হয়েছে যে, ঢাকায় সারাদিন হেঁটে একটা পয়সাও জোগাড় করতে পারেননি। তবুও তাঁর উৎসাহে, চেষ্টায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়তে দেখা যায়নি। পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে অনেক দিন রক্তপ্রস্রাব হত তার; তবু ছিলেন হাস্যময়। মাদরাসার ব্যস্ততায় নয় মাস একাধারে বিবি-বাচ্চার খোঁজ নিতে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারেননি। একে ঘিরে তাঁর চোখে ছিল এক স্বপ্নিল চিত্র, হৃদয়ে ছিল তাঁর এক স্বপ্নগাঁথা। সৌভাগ্য, তিনি অধমকেও এই স্বপ্নের সঙ্গী করেছিলেন। যখন তাকে এই মাদরাসা ছেড়ে আসতে হয়েছিল, তখন থেকেই তিনি অনেকটা উদ্যমহারা হয়ে পড়েছিলেন। এই কষ্ট কখনও আর  ‍ভুলতে পারেননি তিনি। আমাকে তিনি প্রায়ই স্বপ্নভঙ্গের এই কষ্টের কথা বলে সান্তনা পেতে চাইতেন।

যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীসের দরস শুরু হল। কাজী হুজুর রহ. বাংলা ভাষায় পাঠদান করতেন। আমিও তাঁর অনুগমন করি। এমন কি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও বাংলায় হল। তখন আমাদের নিয়ে সে কি টিটকারী আর হাসাহাসি। কেউ কেউ ইলমের এতদৃশ অধঃপতন দৃষ্টে মাতম গাইতে শুরু করল। বাংলা মাদরাসা করে আমাদের দিকে বাকাদৃষ্টিতে তাকাত। তখন সময়ে এটা বিপ্লব ছিল বৈ কী। বর্তমানে তাে দেখেছি, সকলেই কাজী হুজুরেরই দেখানাে পথে পা ফেলছেন। এটাই বিপ্লবের সাফল্য।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় প্রথম মাদরাসা খােলেন এবং অন্যান্য মাদরাসাও চালু করার প্রয়াস নেন। চারণ গায়কের মতাে ঢাকার অলিগলিতে তিনি ঘুরেছেন। আলেমউলামাদের সাহস দিয়েছেন। প্রায়ই বলতেন, আমার ঈমান যদি আমি রক্ষা করতে উদ্যম হই, তবে কোনাে শক্তি নেই তা ছিনিয়ে নেওয়ার। বলতে গেলে তাঁর প্রচেষ্টায় ঢাকার মাদরাসাগুলাে পুনরায় চালু হয়। জীবনের শেষার্ধে মালিবাগ মাদরাসায় ইহতিমামের দায়িত্ব নিয়ে আসেন এবং আলেম গড়ার প্রয়াসে নিজেকে সঁপে দেন।

কাজী হুজুর নিজে ছিলেন আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী। উস্তায় ও মুরুব্বি হযরাত শায়েখ তাজাম্মুল আলী রহ. এবং শেষে হযরত শায়খুলে ইসলাম অনুপম সংস্পর্শে তা পত্রপল্লবে আরাে বিকশিত হয় এবং সুউচ্চ আসনে তাকে অলংকৃত করে। তিনি নিজে ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। মেধাবী প্রতিভাদেরকে তিনি অগ্রসরমান করতে ভালােবাসতেন। নিজেকে পিছনে রেখে নিজের জুনিয়রদের সামনে ঠেলে দেওয়ার এই গুণ খুব কমজনের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়।

বিস্ময়কর এক বাগ্মী ছিলেন তিনি। আল্লাহ তাকে অসাধারণ এক ভরাট কণ্ঠ দিয়েছিলেন। একে তাে ছিলেন যশাের এলাকার মানুষ, তদুপরি বিশুদ্ধ ভাষা, অনুপম শব্দ চয়ন, বাচনভঙ্গি। সাগরের অতলস্পর্শী গভীরতাসমৃদ্ধ বক্তৃতা হাজারাে জনতার সমাবেশ প্রহরের পর প্রহর মন্ত্রমুগ্ধের মতাে শুনে যেত। সময় কোথা দিয়ে কেটে যেত তিনি বক্তৃতা শেষ না করা পর্যন্ত বােঝা যেত না। কখনাে কখনাে নজরুল, রবীন্দ্রের উদ্ধৃতি এর মনােহারিত্ব আরাে বৃদ্ধি করে দিত। প্রায়শ গাইতেন ‘তাের ডাক শুনে যদি কেউ না আসে তবে একলা চল একলা চল একলা চল রে।' বলিষ্ঠ ভরাট গলায় আবৃত্তি করতেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না...।

ছাত্রজীবন ছিল তাঁর অতিবর্ণাঢ্য। অধ্যপনাজীবন ছিল আরাে সমৃদ্ধ, সুশােভিত, পরিণত। বাহুল্য বর্জিত পাঠদান কুরআন, হাদীস, দর্শন, যুক্তি, আধুনিকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মাঝে মাঝে আকাবির ও মাশায়েখে কেরামের শিক্ষণীয় ঘটনা বিশেষ করে হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর আলােচনায় থাকত পুষ্পিত।

বাংলা ভাষায় দখল ছিল সহজাত। আরবী, ফারসী, উর্দুতে তাঁর বুৎপত্তি ছিল অসাধারণ। লিখেছেন কম, কিন্তু যা লিখেছেন বাঙালী আলেমদের রচনার মাঝে অনায়াশে শীর্ষে স্থান দেওয়া যায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সাহচর্য ও তথ্যের ভিত্তিতে হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর যে জীবনচরিত তিনি নিপুণভাবে এঁকেছেন ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সুর’ নামের জীবনীগ্রন্থে, এর তুলনা হয় না। এর সারনির্যাস শুনে দেওবন্দের অনেক আসাতেযায়ে কেরাম দ্রুত উর্দু অনুবাদের তাকাদা অনুভব করেছেন। আফসােস, হযরত মাদানী রহ.-এর রাজনীতি ও ধর্মবােধ নিয়ে যে খণ্ডটি লেখার কথা ছিল সেটি অসমাপ্ত রয়ে গেল। তিনি নিজেই বলতেন, আমি দেওবন্দ গিয়েছিলাম এক জীবন্ত ইসলামকে পাঠ করতে। আমি সেখানে হযরত মাদানী রহ.-কে পাঠ করেছি। বাংলাভাষায় রচিত ইসলামী বিশ্বকোষ ও তাফসীর-সম্পাদনা পরিষদের তিনি ছিলেন মধ্যমণি। পরিষদের সবাই তথ্য অনুসন্ধান ও কঠিন কোনাে বিষয়ে তাঁরই দিকে চেয়ে থাকত। বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি প্রচারিত কুরআন মাজীদের তরজমা সম্পাদনা পরিষদ ও সিহা-সিত্তা অনুবাদ ও সম্পাদনায় তাঁর অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অতিবিনয়ী। এত পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে একজন তালিবে ইলম ভাবতেই ভালােবাসতেন বেশি। সমসাময়িক সমাজে এর উদাহরণ খুবই বিরল। আলেম-উলামাদের খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। এমন কি শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তিনি সম্মানের আচরণ করতেন। সাক্ষাৎপ্রার্থী সে যেই হােক, প্রথমেই তাঁর সারল্যমিশ্রিত অমায়িক হাসিটিতে আপ্যায়িত হত। তাঁর মজলিসে গীবতচর্চা বা কারাে প্রতি কোনাে হেয় মন্তব্য হতে দেখা যেত না। বর্তমানে যেখানে আমানতদারি শব্দটিই সবচেয়ে লাঞ্ছিত-অপহৃত, সেখানে তার মাঝে এর বিরাট অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত দেখা যায়। প্রতিষ্ঠান-পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জীবনের একটা বিরাট সময়, কিন্তু কখনও টাকাপয়সা নিজের হাতে নেননি। হিসাবরক্ষক বা সেক্রেটারি সাহেবকে দেখিয়ে দিতেন।

সব কাজে সুন্নতের অনুসরণ ছিল তার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ইহসান ও তাসাউফের ক্ষেত্রেও ছিলেন তিনি অতিউচ্চমার্গের। হযরত মাদানী রহ - হয়ে প্রথাগত লেখাপড়া শেষ করার পরও আরােও বছরখানেক তাঁর খেদমতে থেকে তরবিয়ত ও আত্মশুদ্ধির মেহনত করেছেন। শেষে তার আশৈশব উস্তায হযরত মাদানী রহ. এর বিশিষ্ট খলীফা শায়খ তাজাম্মুল আলী রহ.-এর থেকে খেলাফত ও ইজাযত পেয়েছিলেন। এই অধম আমি এত চেষ্টা করেছি বায়আত হওয়ার জন্য, কিন্তু সেটি কোনাে দষ্টিপাত না করে তুলে দিলেন হযরত ফিদায়ে মিল্লাত আস'আদ মাদানী রহ. এর হাতে। জানতে পারিনি কাউকে তিনি মুরীদ করেছেন কি না, ইজাযত দিয়েছেন কি না।

এত নির্মোহ ও দুনিয়াত্যাগী ছিলেন, জীবনে কোন অর্থবৈভব একত্র করে যাননি। এভাবে দুনিয়া থেকে গিয়েছেন যে, তাঁর হাতে এক দিনের জন্যও কিছু ছিল না। অথচ চাইলে কাজ বিত্তবৈভবের মালিক হতে পারতেন। যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন যাত্রাবাড়ী এলাকায় দুই আড়াই হাজার টাকায় জমির বিঘা বিক্রি হত। সেদিকে নজরও দেননি। স্বাধীনতার পর লুটেরাদের উৎসব লেগেছিল। কতজন বায়তুল মুকাররমে দোকান বাগিয়ে নিয়েছে। হযরত কাজী হুজুর বায়তুল মুকাররমের কর্তাব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট ছিলেন, কিন্তু কখনও বৈধভাবে কিছু নেওয়ারও চিন্তা করেননি। কোনাে আফসােসও তাঁর ছিল না। নেকী ও পুণ্যকর্মে দুহাত ভরে দুনিয়া থেকে রিক্ত থেকে আল্লাহ তা'আলার সান্নিধ্যে যাওয়ার মহান সুন্নত, তিনি পালন করে আমাদের জন্য উদাহরণ রেখে গিয়েছেন।

মেহমানদারীতে মাদানী দস্তরখানের প্রতিকৃতি প্রস্ফুটিত হত। এ সময়ে দেখা যেত শত ধনীর চেয়েও তিনি বুঝি বেশি অর্থশালী। কত পদ মেহমানের সামনে পেশ করা যায় সে। ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিশীলতা আরাে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত।

‘ধৈর্যের পাহাড়' বলা হলে কম বলা হবে তাঁকে। জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই এমন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন তাঁকে হতে দেখেছি যে, আমরা নিজেরা ভেঙে পড়তাম, কিন্তু তিনি বেথ ও স্থৈর্যের প্রতিকৃতি হয়ে সুস্থির অবিচল থাকতেন তখনও।

জীবনের শেষ দিনগুলােতে কঠিন রােগে শয্যাশায়ী ছিলেন। লিভার সিরােসিসে আক্রান্ত ছিলেন। কোনাে আহাজারির শব্দ বা অনুযােগ তাঁর জবানে দেখা যায়নি। শেষ তক আল্লাহ আল্লাহই করছিলেন প্রতিমুহূর্তে। শেষ জীবনে মালিবাগ মাদরাসায় থিতু হয়েছিলেন। কমিটির সদস্যগণ, বাসিন্দাগণ, ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন, ভালােবাসতেন সন্দেহ উদাহরণ আমরা তার ইন্তিকালের পরও দেখতে পাই। কিন্তু একটা অতৃপ্তি তাঁর অন্তরে বিঁধত। যে স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন, উস্তাযে আযীম হযরত শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ.-এর চেতনার একটা কেন্দ্র গড়ে তােলা ছিল তাঁর আজীবন সাধনা; এর অভাববােধ ছিল তাঁর মনের গহীনে। মালিবাগের পরিবেশে সবকিছু পেয়েও কেন যে তা বাস্তব হল না, আল্লাহই জানেন। নিজেকে তার পিঞ্জিরাবদ্ধ সুখী পাখি বলে হয়ত মনে হত।

ইন্তিকালের কয়েক বছর আগে সেই স্বপ্নতাড়িত হয়ে আমাকে একদিন বললেন, চলুন, প্রথম জীবনের স্বপ্নের উপর একটা মারকাজী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। চিরজীবনই হুজুরের পরামর্শের বাইরে যাওয়ার উপায় পাইনি। তাকে জামিআ ইকরায় চলে আসার আবেদন জানালাম। বললাম, এটি আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বত প্রস্তুত। জামিআ ইকরা প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত জামিআ ইকরার প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। অধম তাে নিমিত্ত মাত্র।

কিন্তু আফসােস! সময় হল না। আল্লাহর কাছে চলে যাওয়াই তিনি শ্রেয়তর ভাবলেন। আল্লাহ নিয়ে গেলেন তাঁকে একান্ত সােহাগে। সন্ধার পর একটা অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলাম, মাওলানা শফিকের ফোন এল, হুজুরের স্বাস-প্রশ্বাস জানি কেমন হয়ে গেছে। দ্রুত এলাম মাদরাসার বাসায়।

প্রশান্তচিত্তে সৌম্যসমাহিত শুয়ে স্থির হয়ে আছে ইলম-আমলের নিস্তরঙ্গ সাগর। মহামিলনের অঙ্গহীন আলিঙ্গনে তৃপ্ত উদ্ভাসিত দীপ্তিময়, মায়াময় কান্তি। টের পাচ্ছিলাম না তিনি নেই। ডাক্তার এলেন, বললেন, না, চলে গেছেন তিনি। তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন কিছুতেই। হে আল্লাহ! অনন্ত সন্তুষ্টির সায়রে নিমজ্জিত করাে, সিক্ত করাে তাঁকে।

এই অধমকে আশৈশব দিতে চেয়েছেন অঞ্জলি ভরে। সাজাতে চেয়েছেন স্তবকে স্তবকে, বিকশিত করতে চেয়েছেন কর্মে-সাফল্যে। কিন্তু গর্দভ এই অধম গাধাই থেকে গেলাম। নিজের গাফলতি, অমনােযােগিতা, যােগ্যতাহীনতার পাত্রে নিতে পারিনি কিছুই। রিক্ত যে রিক্তই থেকে গেল। আফসােস, অনুশােচনা আর অশ্রু বিসর্জন ছাড়া আর কিছুই করার নেই অধমের। রহম কর, ক্ষমা কর হে আল্লাহ, ইয়া গাফুরুর রহীম। আমীন।

(২০১৭ সালে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শায়খুল হাদীস আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ. স্মারক গ্রন্থ’ থেকে নেয়া।)

লেখক: শায়খুল হাদীস ও শায়খ, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ