এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ।।
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। একটি নাম, একটি ইতিহাস। একটি প্রতিভা, একটি সংগ্রাম। একজন নির্ভীক আলেম। এমন সব্যসাচী আলেম আমাদের অঞ্চলে খুব কমই জন্মেছেন। তাঁর ছিল বহুমুখী চেতনা ও বহুমাত্রিক গুণ। তিনি একাধারে অসাধ্য কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও অনুবাদক। তিনি ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও মাসিক মদীনা সম্পাদক। এতেই কি খেন্ত! না, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষকও বটে। তাঁর এই বহুমাত্রিক কর্ম সাধনায় তাঁকে উঁচু করে তুলেছে। তাঁকে সোনালী মানুষের রূপে রূপ দিয়েছে। তিনি হারিয়ে যাওয়া বিশ্ববরেণ্যদের অন্যতম একজন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ১৯৩৫ ঈসায়ীর ১৯শে এপ্রিল মুতাবিক ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ৭ই বৈশাখ শুক্রবার জুমআর আজানের সময় কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার ছয়চির গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার আনসার নগরে। পিতা মৌলভী হাকিম আনছার উদ্দিন,মাতা মোছাঃ রাবেয়া খাতুন। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাধক পুরুষ ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ।তাই তিনি আদর্শ বাবার গর্বিত সন্তান।
শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি বাবা মায়ের কাছ থেকেই শুরু। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম পাঁচবাগ ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন । অতঃপর তিনি পর্যায়ক্রমে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকেই আলিম ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ১৯৫৩ সালে দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে হাদিস বিষয়ে কামিল ও ১৯৫৬ সালে ফিকহ বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আলিয়া ধারায় লেখাপড়া করলেও কওমি অঙ্গনের সাথে ছিল তার ওঠাবসা। তাঁর লেবাস ও পথ চলাতে ছিল সুন্নতে রাসুল।
প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী তারকা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. এর কর্মজীবন সোনার হরফে লেখার মত। শৈশব কাল থেকেই ছিল তাঁর অনুবাদ ও সহিত্যচর্চার প্রতি আগ্রহ। গায়ে মাখতে চেয়েছেন সাহিত্যের রস। কলমের ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সময়ের কথামালা। তাই তিনি ১৯৬০ সালে ‘মাসিক দিশারী’, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬১ সাল থেকে আমৃত্যু ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনা করেছেন। এক সময় তার সম্পাদিত ‘আজ’ সাহিত্য মহলে সাড়া জাগায়। তা থেকেই ১৯৮৮ সালে সৌদিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রাবেতায়ে আলমে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। এর মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক মহলেও পরিচিত হয়ে ওঠেন।
দেশের বাইরেও বাংলাভাষীরা তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক। তার সাহিত্যকর্ম অনবদ্য। রচনাশৈলী নিদারুণ।তাই তিনি একজন বিদগ্ধ সাহিত্যিক। তাঁর অনুবাদ নিখুঁত। অনুবাদে রয়েছে সাহিত্যের রস। তিনি একজন খ্যাতিমান অনুবাদক। অনুবাদ করেছেন সুপরিচিত ও গ্রহণযোগ্য তাফসীরগ্রন্থ মা’আরিফুল কুরআনসহ ১০৫ টির ও বেশী গ্রন্থ। তাঁর চিন্তায় রয়েছে রাজনীতির সুকৌশল। তিনি একজন সংগঠকও। তিনি ছিলেন মু’তামার আল আলম আল ইসলামী এর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামী মোর্চার সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রধান।
প্রতিভাধর মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য রচনা, অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা ভাষায় সিরাত সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি ২৫ জুন, ২০১৬ রোজ শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে আজও বেঁচে আছে তার রেখে যাওয়া সাহিত্যকর্ম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর জীবন ও কর্মকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
-এএ