ফরহাদ খান নাঈম ।।
শায়খ মুহাম্মাদ আলি আসসাবুনি ১৯৩০ সালে সিরিয়ার আলেপ্পোতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ জামিল ছিলেন আলেপ্পো শহরের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার। তিনি আরবিতে হাতেখড়ি ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর পিতার কাছ থেকেই লাভ করেন। এছাড়া উত্তরাধিকার ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞানও তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে অর্জন করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা চলাকালেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্থ করে ফেলেন; এবং অতি অল্প বয়সে পড়াশোনার উচ্চ মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করেন। তিনি আলেপ্পোর বিখ্যাত সব স্কলারগণের নিকট জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করেন। শায়খ আসসাবুনির কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষক হলেন- শায়খ মুহাম্মাদ নাজিব সিরাজুদ্দীন, শায়খ আহমাদ আশশামা, শায়খ মুহাম্মাদ সাইদ আলইদলিবী,শায়খ মুহাম্মাদ রাগিব আততাব্বাখ, শায়খ মুহাম্মাদ নাজিব খাইয়াতাহ প্রমুখ।
এছাড়াও বিভিন্ন মসজিদে দরসে নিয়োজিত অন্যান্য উলামায়ে কিরামের নিকট তিনি অধ্যয়ন করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি সরকারি স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালিয়ে যান। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি মাদরাসা আততিজারিয়াহ - এ ভর্তি হন; এবং সেখানে এক বছর পড়াশোনা করেন। মাদরাসা আততিজারিয়াহ - এ তিনি বেশিদিন তাঁর পড়াশোনা চালাতে পারেননি; কারণ সেখানে ছাত্রদেরকে সুদভিত্তিক লেনদেন শিক্ষা দেওয়া হতো। সেখানে অধ্যয়নকালে পড়াশোনায় তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচয় দেন, তথাপি তিনি উক্ত স্কুল ছেড়ে দিয়ে আলেপ্পোর বিখ্যাত শরীয়াহভিত্তিক খাসরাউইয়াহ স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ইসলামি ও সেক্যুলার বিষয় নিয়ে তুলনামূলক সমন্বিত শিক্ষা লাভ করেন। সেখান থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেন।
অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন শেষ করায় তৎকালীন আওক্বাফ মন্ত্রণালয় তাঁকে উচ্চতর গবেষণার জন্য মিসরের বিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৫২ সালে শরীয়াহ অনুষদের অধীনে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এবং ১৯৫৪ সালে তাঁর বিশেষায়িত কোর্স সম্পন্ন করেন।
পড়াশোনা শেষ করে তিনি নিজ শহর আলেপ্পোয় ফিরে আসেন; এবং শহরের বিভিন্ন স্কুলে ইসলামি শিক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে নিয়ে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় আট বছর শিক্ষাদানের কাজে মগ্ন ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়াহ অনুষদে লেকচারার পদে নিয়োগ পান; একই সাথে মক্কার কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অনুষদে অধ্যাপনা করেন। এই দুই বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রায় ২৮ বছর শিক্ষাদান করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে বহু বিখ্যাত স্কলার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু গবষেণামূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি ইমাম আবু জা’ফর আননাহ্হাস এর তাফসির গ্রন্থ মা’আনিল কুরআন সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদিত এই বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ৬ ভলিউমে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা পরিষদে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে কিছুকাল অতিবাহিত করার পর তিনি পুরোপুরিভাবে লেখালেখি ও গবেষণার কাজে আত্মমগ্ন হন।
শায়খ আসসাবুনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন যেগুলো সমগ্র বিশ্বের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর প্রণীত বহু গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। মক্কার কারাম ও জেদ্দার বিভিন্ন মসজিদে তাফসিরের উপরে তিনি নিয়মিত দারস প্রদান করতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ইসলামি টিভি চ্যানেলে নিয়মিত দারসের প্রোগ্রাম করতেন যেগুলোর সংখ্যা প্রায় ৬০০ এরও অধিক। তাঁর এসব দারস অডিও আকারে ক্যাসেটে ধারন করা হয়েছিলো।
তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ হলো-
ক. সাফওয়াতুত তাফাসীর;
খ. রাওয়াইল বায়ান ফি তাফসির আয়াতিল আহকাম;
গ. কাব্স মিন নূরিল কুরআনিল কারিম;
ঘ. আততাফসিরুল ওয়ামী আলমুয়াসসার;
ঙ. কাশফুল ইফতিরাত ফি রিসালাতিল তানবিহাত;
চ. আততাফসির বিমা ফি রাসাইল বকর আবু যায়দ মিন আততাজউইর ইত্যাদি।
তিনি ১৩৮৫ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৫ সালে মসজিদে হারামে সালাতুত তারাবিহের ইমামতির দায়িত্ব পান। ওই বছর তিনি হারামে রমজান ও হজ মৌসুমে মুদাররিসের দায়িত্বও পালন করেন।
২০০৭ সালে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড এর অর্গানাইজিং কমিটি শায়খ মুহাম্মাদ আলি আসসাবুনিকে ইসলামের জন্য তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনোনীত করে। মনোনয়নপ্রার্থীদের এক বিরাট তালিকা থেকে দুবাই’র উপ রাষ্ট্রপ্রধান যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন রাশিদ আলমাকতুম তাঁকে মনোনয়ন দেন। বিগত ১১ বছর যাবত একই পদ্ধতিতে দুবাই বিশ্বের অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করে আসছে।
ইসলামের এই মহান মনীষী আজ জুমাবার ১৯শে মার্চ ২০২১ ইং সালে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর সকল সৎ কর্মের উপযুক্ত প্রতিদান দান করুন।
এনটি