সাঈদ আহমাদ খান নদভি।।
তুরস্কের বিখ্যাত আলেম আল্লামা শায়খ আমিন সিরাজ রহ.'র ইন্তেকালে আজ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হলো জামিয়া সায়্যিদ আহমাদ, লাখনৌতে৷ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শায়খ ইউসুফ হুসাইনি নদভি, শায়খ ইউনুস হুসাইনি নদভি, শায়খ আব্দুল মুয়িদ নদভিসহ আরো অনেকে৷
একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্রকে ধর্মমুখী করতে হলে, দু'বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য৷ এক, দ্বীনি শিক্ষা সিলেবাস৷ দুই, এবং এই সিলেবাসকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে একদল কর্মঠ ব্যক্তিত্ব গঠন৷
আজকের আধুনিক তুরস্ক শায়খ সাঈদ নুরসি রহ.'র পরে যে ব্যক্তিত্বের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভান্বিত হয়েছে, তিনি হলেন শায়খ আমিন সিরাজ৷ বর্তমান তুরস্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বীনি শিক্ষা ও সিলেবাসের যে পরিবেশ আজ তৈরি হয়েছে, হজরত ইমাম সাঈদ নুরসিকে এর মূল সঞ্চালক গণ্য করা হয়৷ ইমাম সাঈদ নুরসি তুরস্কে নিজের লেখনীর মাধ্যমে দ্বীন প্রচার করেছেন৷
অন্যদিকে শায়খ আমিন সিরাজ রহ. লেখলীর জগতে ততোটা কাজ তো করেননি, তবে তৈরি করেছেন মনিবের জন্য কুরবান করে দেয়া একদল মেষপালক৷ তাই আজকের তুরস্কে এমন হাজারো ব্যক্তি আছে, যারা দ্বীন প্রচারের জন্য বিবাহ পর্যন্ত করেন না!
শায়খ আমিন সিরাজ উত্তর আনাতোলিয়ার তাওকাদ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা শহরের একজন প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন৷ পারিবারিকভাবেই তারা ছিলেন ধার্মিক৷ কামাল আতাতুর্কের যুগে কুরআন শিক্ষা নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তাঁর পিতাকে সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষা দেয়ায় ছয় মাস জেল খাটতে হয়৷
রাষ্ট্রীয় বাধাবিপত্তির মধ্যেও সাত বছরেই শায়খ আমিন সিরাজ কুরআন পড়তে শুরু করেন৷ এরপর ১৯৪০ সনে তাঁর পিতা তাঁকে মেরজিফন এলাকায় পাঠান৷ তিন বছর শিক্ষা গ্রহণ করে ইস্তাম্বুলে চলে যান৷ ইস্তাম্বুলের জামে সুলতান ফাতেহ'র তৎকালীন ইমাম শায়খ ওমর আফেন্দির কাছে বিভিন্ন কিতাবাদী পড়েন৷ সেখান থেকে মাদ্রাসা কারাগোমর্কে গিয়ে শায়খ সুলাইমান আফেন্দির কাছে বুখারিসহ হাদিসের কিতাবাদী পড়েন৷ শায়খ সুলাইমান আফেন্দিই তাঁকে সর্বপ্রথম হাদিসের সনদ প্রদান করেন৷ এরপর ইস্তাম্বুলেই ১৯৫০ পর্যন্ত বিভিন্ন শায়খের কাছে মারাকিল ফালাহ, সুনানে তিরমিজি, সহিহ মুসলিমসহ ফিকহ, হাদিস, তাফসির ও ইলমে কালামের বিভিন্ন কিতাবাদি পড়েন৷
এরপর মিসরের জামিয়া আজহারে যাওয়ার নিয়ত করেন৷ কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে মিসরে যাওয়ার টাকা পর্যন্ত যোগাড় করতে পারেননি৷ সামান্য পুঁজি নিয়েই সফর শুরু করেন৷ কিন্তু পৌঁছার পূর্বেই মাঝপথে পয়সাকড়ি শেষ হওয়ার উপক্রম হয়৷ বাধ্য হয়ে তিনি ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন৷ পরবর্তিতে তাঁর দাদার এক বন্ধুর সহযোগিতায় আজহারে যেতে সক্ষম হন৷ এবং উচ্চতর পড়াশোনা করে দেশে ফিরেন৷
এরপর তুরস্কের বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ মুস্তফা সবরি আফেন্দি (১৮৬৯-১৯৫৪ ইং) এবং শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউসারি (১৮৭৯-১৯৫২ ইং) রহ.'র দীর্ঘ সোহবতপ্রাপ্ত হন৷ এবং হাদিসের ইজাযত লাভ করেন৷
শুরুতেই বলেছি, হজরত শায়খ আমিন সিরাজ কিতাব লেখার চেয়ে ব্যক্তিত্ব গঠনে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন৷ জামে ফাতেহের একটি ছোট্ট কামরায় একদম সাদামাটাভাবে জীবন কাটিয়েছেন এই মহান মনীষী৷ বয়ান, বক্তৃতা আর কুরআনের তাফসির করে ছাত্রদেরকে ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন৷ তাই তাঁর আন্ডারে বহু লেখকগণ তুর্কি ভাষায় দ্বীনি খেদমত করেছেন৷ হাজারো কিতাবের তুর্কি ট্রান্সলেট করেছেন৷ এগুলোর মাঝে সাইয়্যিদ কুতুব রহ.'র বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ 'ফি যিলালির কুরআন' 'র তুর্কি অনুবাদ সবচেয়ে বেশি সারা জাগিয়েছে৷ (সূত্র: আল জাজিরা আরবি, ১৯, ২, ২০২১ ইং)
শায়খের ইন্তেকালের পর আজকের স্মরণসভায় তাঁরই গড়া শাগরেদ আমাদের প্রিয় উস্তাদ মাওলানা ইউনুস হুসাইনি নদভি এক আশ্চর্য কাহিনি শুনিয়েছেন, একবার শায়খ তাঁর কিছু শাগরেদদের নিয়ে কোথাও গমন করেন৷ দাওয়াতের মেজবানকে খাবার পেশ করার সময় খুবই চিন্তিত মনে হলো৷ চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে৷ শায়খের এক শাগরেদ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার বলো? কোনো প্রবলেম? পেরেশানী? নাকি কাজের চাপে আজ রাতে ঘুম হয়নি বলে চোখ লাল হয়ে আছে? প্রশ্ন শুনে মেজবান হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷ অনেক জিজ্ঞাসার পর মেজবান জানালেন, আজ রাতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন৷ নবিজি সা. বলছেন, 'আমিন আমার মেহমান৷ তুমি তাঁর কদর করো!'
হজরত মাওলানা ইউনুস হুসাইনি নদভি আরো বলেন, আমি নিজ কানে হজরত শায়খ রহ.'র জবানে শুনেছি, এক সময় তিনি এতোটাই গরিব ছিলেন, আজহারে থাকাবস্থায় অনেক সময় খাবারের জন্য কিছু না পেয়ে রোজা রেখে দিন কাটাতেন৷ এমনকি ইফতারের জন্যও কেনার মতো কোনো টাকা তাঁর কাছে থাকতো না৷ বাধ্য হয়ে শুধু পানি খেয়েই ইফতারি সারতে হতো!
বলা হয়, এরদোগান যে ক'জন ব্যক্তির মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েছেন, তাদের একজন হলেন হজরত মরহুম শায়খ রহ.৷ জীবিতাবস্থায় এরদোগান বারবার শায়খের সান্নিধ্যে হাজিরা দিতেন৷ ইন্তেকালের পর প্রেসিডেন্ট এ্যারদোগান এক টুইটে অত্যন্ত আফসোস ও দু:খের সঙ্গে শোক প্রকাশ করেন!
প্রায় নব্বই বছরের এক ঐতিহাসিক জীবন কাটিয়ে অবশেষে ১৯-২- ২০২১ ইং চলে গেলেন আল্লাহর রহমতের সান্নিধ্যে৷ আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে ভালো রাখুন! আমীন!
-এটি