রফিকুল ইসলাম জসিম
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট>
মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর একমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী পাঙাল বা মণিপুরি মুসলিমরা বর্তমানে সিলেটে মৌলভীবাজারে প্রায় ২০০ বছর ধরে বসবাস করছে। মণিপুরি বা পাঙালদের নিজস্ব ভাষায় কথা বললেও এরা সবাই ইসলাম ধর্মের সুন্নী মতাবলম্বী।
তাদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইমাম মুয়াজ্জিন হাফেজদের সামাজিক সম্মান-মর্যাদা থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা চরম অবহেলায়। তাদের নেই প্রয়োজন পূরণের মতো সম্মানী, নেই আবাসন। এমনিতে স্বল্প বেতন পান তারা। তার উপর গত দেড় মাস ধরে চলতে থাকা অঘোষিত লকডাউনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে ইমাম মুয়াজ্জিন হাফেজরা।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে দক্ষিণাংশে পাঁচটি ইউনিয়নের ৩০ গ্রামে প্রায় ১১ হাজার জনসংখ্যা বসবাস করে। তাদের প্রতিটি গ্রামে ১/২ টি মসজিদ, মাদ্রাসা রয়েছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে খুব কষ্টে অল্প বেতনে সেই মসজিদ গুলো দায়িত্ব পালন করছেন ইমাম, মুয়াজ্জিন হফেজরা। ধর্মীয় অবস্থানে তাদের মর্যাদা অনেক বেশি হলেও বাস্তবতায় বেতন পান নামমাত্র। দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিছু ধর্মীয় সেবার মাধ্যমে বাড়তি উপার্জন করে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতেন। করোনায় থেমে গেছে এসব সেবা কার্যক্রম। এতে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সংসারে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
মসজিদগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ফ্রি খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে মসজিদে চাকরি করছেন সব এলাকার ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা। থাকা-খাওয়া ফ্রি হলেও বেতনের পরিমাণ অত্যন্ত কম। বেতন কমের পাশাপাশি দিন-রাত মসজিদে ডিউটি করেও নেই মানসিক স্বস্তি। প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকতে হয় মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাব অনটনে দিনাতিপাত করছেন বেশির ভাগ এসব মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা।
জানা গেছে, মণিপুরি মুসলিমদের ৩০টি গ্রামে প্রায় ৫০টি মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদে প্রায় একশত বেশি ইমাম-মুয়াজ্জিন রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর কয়েকজন ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খতিবের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ মসজিদে মুয়াজ্জিনের সম্মানী ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। ধর্মপ্রাণ ধর্মীয় শিক্ষিতরা পেশা হিসেবে বেছে নিলেও মসজিদ কমিটি থেকে পাওয়া অর্থে সংসার চলে না।
অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ইমামদের সর্বোচ্চ ৫ হাজার এবং মুয়াজ্জিনদের এক থেকে দুই হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়। নিয়মিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি খতমে কোরআন ও অন্যান্য ধর্মীয় সেবা দিয়ে সামান্য সম্মানী পান ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। তবে রমজানে তারাবি পড়ানোর ফলে মুসুল্লিদের থেকে টাকা উঠিয়ে তারাবির ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং খাদেমকে ভাগ করে দেয়া হয়। এতে টানাপোড়নের সংসারে ঈদ উদযাপনের খরচ জোগাড় হয়ে যেতো।এই করোনাভাইরাসের মহামারির সময়ে সেটা আর হয়ে উঠছে না। কেননা তারা যে সামান্য সম্মানী পেতেন, এখন সেটাও বন্ধ।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমানের জীবনের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছেন ইমাম-খতিব - মুয়াজ্জিন। করোনা ভাইরাসের কারণে তারা এখন বেশ অর্থকষ্টে জীবন কাটছে তাদের। সমাজে যেন তারা বড়ই উপেক্ষিত, তাদের দেখার কেউ নেই। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষরা সরকারি-বেসরকারি সংগঠন সহায়তা পেলেও এদের কেউ খবর রাখছেন না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক সম্মান-মর্যাদা থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা চরম অবহেলায়। এমনকি সরকারী ত্রাণ ভাগ্যে জুটছে না।
উল্লেখ্য, সপ্তদশ দশকের প্রথম দিকে (১৬০৬ খ্রি.) সিলেটের হবিগঞ্জের তরফ অঞ্চলের পাঠান শাসক খাজা ওসমানের সৈনাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সানীর নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মের অনুসারী একদল সৈন্য ভারতে মণিপুর রাজ্যে অভিযান চালায়। তখনকার মণিপুরের রাজা খাগেম্বার সাথে এক সন্ধির ফলে এই বাহিনী মণিপুরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। পরে মণিপুরের স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মণিপুরের সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে পাঙাল বা মণিপুরি মুসলিম নামে পরিচিত লাভ করেন।
পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মণিপুর রাজ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, রাজ -ভ্রাতৃকলহ ও বহিঃশক্তির আক্রমণ ইত্যাদির কারণে রাজ্যকাঠামো কালক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে উনবিংশ (১৮১৯-১৮২৫) প্রথম দিকে বার্মার সৈন্যরা মণিপুর রাজ্য,আক্রমণ করলে সেখানকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মণিপুরি জাতিসত্তার মানুষ প্রাণভয়ে মণিপুর রাজ্য ত্যাগ করে বিক্ষিপ্তভাবে পাশ্ববর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বার্মা এবং এই বাংলাদেশের সিলেটে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
ইমাম, মুয়াজ্জিন এসব পরিবারটির পাশে কেউ কি এসে দাঁড়াবেন? আপনার সহযোগিতা,পরামর্শ জন্য (০১৭৭৯৬৬৬৯৩২) নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের আমল বিনষ্ট করেন না। অবশ্যই তিনি তার প্রতিদান দিবেন।
-এটি