আবদুল্লাহ আশরাফ ।।
ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে ঘুরাফেরা করি। সবসময় শাহ সাহেবের কথা। যেখানে যাই সেখানেই তাঁর আলোচনা। মসজিদে প্রতিওয়াক্ত নামাজের পর এলান, শাহ হুজুরের জন্য দুআ চাই।
অশ্রুতে ভরে ওঠে চোখ। ওই মানুষটা কি সত্যই অনেক অসুস্থ? বিশ্বাস হয় না। তিনি এমন অসুস্থ হতেই পারেন না, যা তাঁকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেবেন। কী সুন্দরভাবে চলেন! কী সুন্দরভাবে কথা বলেন!
প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন, আবার সুস্থতার সঙ্গে ফিরে আসেন আমাদের মাঝে। এগুলো কিছুই না। তিনি আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবেন। এমন একটা আশা নিয়ে পথ চলি, কথা বলি।
মাঝেমধ্য রোগাক্রান্ত ছবি দেখে কষ্ট পাই। মানুষটার এমন ছবিগুলো দেখে ব্যথা পাই। সুযোগ পেলে মন্তব্য করি। রাগে অনেককে আবিজাবি বলি। আবার নিজেকে প্রবোধা দিই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরীক্ষা নিচ্ছেন।
হুজুর দেশে ফেরেছেন শুনে বারবার চেষ্টা করি হাসপাতালে যেতে। কিন্তু পরীক্ষা থাকায় যেতে পারিনি। ইজতেমা থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাও হয়ে ওঠেনি। সেখানে গিয়ে সুযোগ করতে পারিনি। মাদরাসায় এসে আবার ফলাফল ও খাতা দেখা নিয়ে ব্যস্ত।
ফেসবুক ও পীর সাহেব হুজুর কিশোরগঞ্জী থেকে সংবাদ নিই। হুজুর নিত্যদিন খবর নিচ্ছেন। শাহ সাহেব হুজুরের পরিবারের একজন যেন। আতহার আলী রহ. থাকতেই এ পরিবারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা।
গতকাল এশার পর কম্পিউটার বসে কাজ করছিলাম। তালীমাত সাহেব বললেন, শাহ সাহেব হুজুর মারা গেলে কোথায় জানাজা হবে? আমি এ বাক্যটা সহ্য করতে পারিনি। একটু কঠিক বাক্য বললাম, আপনি এ কি বলছেন? হুজুর মারা গেলে মানে? একটু চটে গেলাম। আমি এমনই। হুজুরের ব্যাপারে কেউ কিছু বললে চটে যাই।
হুজুর অসুস্থ। অনেক অসুস্থ। কিন্তু আমার হৃদয় বলছিল, হুজুর ফিরে আসবেন। আবার দেখা হলে বলবেন, 'তোরে দেখলে তোর বাবার কথা মনে পড়ে যায়'। এ কথা বলে, একটা শ্বাস ছাড়তেন।
মাওলানা ইসমাঈল সাহেব কিশোরগঞ্জী হুজুর ও আব্বা এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন জামিআয়। শাহ সাহেব হুজুরের প্রথম বুখারির ছাত্র ছিলেন বাবা শাইখুল হাদিস আশরাফ আলী রহ.। বাবা ছিলেন অন্য রকম। পড়াশোনা ছড়া কিছুই বোঝতেন না। আর উস্তাদদের পেলে সব ভুলে যেতেন। তাদের খেদমত করতেন। ছাত্রকালিন বাবা সবসময় সুযোগ খোঁজতেন। একটু সুযোগ পেলেই শাহ হুজুরের বাসায় গিয়ে বসে থাকতেন। হুজুর এখন খালি। ক্লাস করাতে হবে।
শাহ সাহেব হুজুর একটু আরাম প্রিয়। শাহ নামের সঙ্গে তাঁর চলন বলন ও কথাবার্তার ভীষণ মিল ছিল। বাবা সেগুলো বোঝতেন না। সুযোগ পেলেই চলে যেতেন বাসায়। বায়না ধরতেন ক্লাসের। বাবাকে দেখে শাহ সাহেব হুজুর বলতেন, 'আমার দারগা এসে পড়েছে। আর থাকা যাবে না'।
শাহ সাহেব হুজুর রহ. দারগা বলে ডাকতেন বাবাকে। নাম ধরে ডাকতেন না। থানভী রহ. সঙ্গে মিলে যাবে। আশরাফ আলী বলতে গিয়ে একটু যদি কঠিন হয়ে যায় বাক্যটা। সুন্দর করে নামটা যদি না ডাকতে পারেন। আকাবেরদের জীবনটাও সেরকম। বাবার মুর্শীদের নামটাও সুন্দর করে না নিতে পারলে নিতেন না।
সোমবার রাতে শাহ সাহেব হুজুরের একটা বয়ান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যাই। তখন রাত তিনটা। ফেসবুক ওয়ালে সেটা রেখে দিই। বর্তমানে যে অবস্থায় শাহ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে, অনেকটা মিলে যায় গত বছরের বয়ানেরর সঙ্গে। হুজুর অনুভব শক্তিটা অনেক বেশি।
আজ বুধবার। অস্থীর অস্থীর ভাব। আসরের পর মসজিদে ইচ্ছে বসার। কিন্তু বসতে পারিনি। কোনো কিছু হয়ে গেছে বোধ হয়। পীর সাহেব কিশোরগঞ্জী হুজুর একটু কান্না-কাটি করেন। ওঠাবসা, চলাফেরায় খালি শাহ সাহেব হুজুর। কখনো কান্না করতে করতে চোখমুখ লাল হয়ে যায়।
হুজুরের কাছে গেলাম। না, এখন এ মুর্হূতে এমন কিছু নেই। মাদরাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাচলার পর কম্পিউটানে বসতেই জাবিদ ভাই কান্না-কাটি শুরু করেন। দৌড়ে বের হতেই শুনি পীর সাহেব কিশোরগঞ্জী হুজুর কান্না-কাটি করছেন। ছোট বাচ্চার মতো কান্না করে বাসায় চলে গেছেন। আওয়াজ ওঠল 'শাহ সাহেব হুজুর নেই'।
স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজের অজান্তেই কম্পিউটার বন্ধ করে রুমে চলে গেলাম। বুক ফেটে কান্না আসছিল। অতীতরা হইচই করতে লাগলো হৃদয়ের ক্যানভাসে। কতোক্ষণ ছিলাম জানি না। গাড়ির শব্দ শুনে দৌঁড়ে বের হলাম। গাড়ি কোন দিকে যায় বলা যায় না। ঢাকা গেলে চলে যাবো। কিন্তু গাড়ি এলো জামিয়াতুল ইমদাদিয়া, কিশোরগঞ্জ। মাগরিব শুরু হয়ে গেছে। প্রস্তুতি নিতে নিতে জামাত শেষ। মাইকে এলান হলো 'শাহ সাহেব ইন্তিকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
নামাজে দাঁড়িয়েও কান্না। নামাজটা পড়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নামাজ শেষে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করি। এতোক্ষণে ঐতিহাসিক শহিদী মসজিদ ও আশপাশ কান্নায় কান্নায় শোকের ছায়া। মুহূর্তে পুরো কিশোরগঞ্জ একটা শোক। সব শূন্য। মাদরাসার ছোট ছোট বাচ্চারা হাউমাউ করে কান্না করছে। ছোটাছুটি করছে।
কেউ মোবাইল নিয়ে দাঁড়ালে বলছে, হুজুরের ছবি আছে। হুজুর এখন কই? যারা যারা মোবাইলে ফেসবুক চালাচ্ছে, তাদেন কাছে ভিড় করছে। ছবিতে হলেও হুজুরকে একটু দেখবে। হুজুর ওদের প্রাণ মানুষ ছিলেন। আসরের পর ওদেন সঙ্গে কথা বলতেন। কুরআন শুনতেন। ওদেন অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন। তিনি আজ নেই। এতো উস্তাদ!এতো আলেম! এতো কিছু তবুও শূন্য। সবকিছু শূন্য। হাহাকার করছে কিশোরগঞ্জের আকাশ বাতাস।
খানকাহে আতহার ও মেহমানখানায় বসে
২৯/১/২০২০
আরএম/