আওয়ার ইসলাম: ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের মামলায় ১৬ আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এই আদেশ দেন। রায়ে আপিলের জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন আদালত।
৮০৮ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় ১৬ আসামির অংশগ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। এছাড়া প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়।
এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দীন নান্নু সাংবাদিকদের বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তারা হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করবেন।
অন্যদিকে এ ঘটনার মাত্র সাড়ে ছয় মাসের মধ্যে এবং মাত্র ৬১ কার্যদিবসে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
গত ২০ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২৭ জুন থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলার ৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন। বাকি চারজনের মধ্যে একজন বিদেশে থাকায় এবং তিনজনের সাক্ষ্য অন্য সাক্ষীদের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাওয়ায় তাদের সাক্ষ্যগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম।
পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর আসামি মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।
মাদরাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলন সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন।
মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মণি।
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এরপর মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু নুসরাতের পরিবার ওই মামলা তুলে নেয়নি। নুসরাত ওই মাদরাসার শিক্ষার্থী ছিলেন।
গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যান নুসরাত। ওই সময় কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে তাকে ডেকে নিয়ে যায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সহযোগীরা।
পরে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। পরবর্তীতে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা মামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে বিষয়টি বুঝতে পেরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই।
এরপর ১০ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত।
২৭ ও ৩০ জুন বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসানকে (নোমান) জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর আদালত রায়ের জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন।
-এটি