বেলায়েত হুসাইন ♦
ইলহান আব্দুল্লাহ ওমর একজন মার্কিন কংগ্রেস সদস্য। ২০১৮ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোন মুসলিম হিসেবে কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন।
৩৭ বছর বয়সী সোমালি বংশোদ্ভূত ইলহান ওমর ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের একটি আসন থেকে বিজয়ী হন।
বিজয় লাভের পরে তার প্রথম ভাষণে ইলহান ওমর বলেন, মিনেসোটায় আমরা অভিবাসীদের শুধু সাদরে বরণই করিনা, আমারা তাদের ওয়াশিংটনে পাঠাই।
আজ রাতে অনেকগুলো 'প্রথম' বিশেষণের অধিকারী হিসেবে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি - প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে আমি এই রাজ্যকে কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছি, হিজাব পরিহিতা নারী হিসেবে কংগ্রেস যাচ্ছি, আমিই প্রথম শরণার্থী যে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছি, এবং প্রথম একজন মুসলিম নারী হিসেবে কংগ্রেসে যাচ্ছি।
হিজাব-পরিহিতা ইলহান ওমর ১৪ বছর বয়সে পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনের আগে কেনিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে চার বছর কাটিয়েছিলেন।
স্থানীয় একটি গির্জার স্পন্সরশীপে ১৯৯৫ সালে তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে আসার সুযোগ পান। বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যায়, ১৪ বছর বয়সে যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, ইলহান ওমর তখন সামান্যই ইংরেজি জানতেন এবং এই অবস্থা থেকে মাত্র তিন মাসের ভেতর ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। তখন থেকেই তার দাদার অনুবাদক হিসেবে ডেমোক্র্যাটদের বিভিন্ন সভায় যেতে শুরু করেন তিনি।
তিনি সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কট্টর সমর্থক। একইসঙ্গে, ঘণ্টায় কমপক্ষে ১৫ ডলার মজুরীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন।
এর আগে ২০১৬ সালে ইলহান ওমর মিনেসোটা রাজ্য-সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে জেতার পর তিনি বলেছিলেন, এ বিজয় শরণার্থী শিবিরে ৮-বছর বয়সী এক শিশুর বিজয়।
এ বিজয় একজন তরুণীর যাকে জোর করে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। এই বিজয় তাদের যাদের বলা হয় যে, তাদের স্বপ্ন দেখার সীমা রয়েছে।
বিশ্বের মানুষ আজ ইলহান ওমরকে বলছেন মিনেপোলিসের (মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের) ‘অগ্রদূত’ এবং তারা অসম সাহসী এক নারীর খেতাবে ভূষিত করছে তাকে।
ইলহান ওমরকে সাহসী বলা হচ্ছে এ কারণে যে, হিজাব পরার পক্ষে তর্কযুদ্ধেও তিনি জয়ী হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রথম হিজাব পরা সদস্যও তিনি। অথচ ওখানকার অনেক শাসকই তা না পরার পক্ষে যুক্তি দেখান। তিনি কৌশলে এসব যুক্তি খণ্ডন করেন।
কংগ্রেসের একটি সভায় তার হিজাব পরার বিষয়ে অভিযোগকারী এক ধর্মীয় নেতাকে কৌশলে নিশ্চুপ করিয়ে দেন। ইলহান বলেন, আমি এখন একজন কংগ্রেস প্রতিনিধি। এ ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি মনে করি। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রূপ পাক কংগ্রেস।
বিরোধীরাও বলছেন, এখন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মত দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের অধিবেশন। বলা যেতে পারে, প্রায় ১৮১ বছরের পুরনো গতানুগতিক ভাবধারাকে পাল্টে দিলেন তিনি। ইলহানের পক্ষের লোকেরাও এই আইনের ব্যাখ্যা চেয়ে দাবি করেছেন যে, ধর্মীয়ভাবে শিরাবরণ ব্যবহার করা উচিত হাউজ চেম্বারে। ইলহান ওমর এ সংক্রান্ত যে দাবি করেছেন তা অযৌক্তিক নয় মোটেই।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টার এক হিসেবে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ৩.৪৫ মিলিয়ন। এ অবস্থায় সভা চলাকালে মাথায় হিজাব পরা যুক্তিহীন কোনো বিষয় নয়। এ ব্যাপারে ইলহান বলেন, ‘আমার মাথায় কেউ হিজাব পরিয়ে দেয়নি।
আমি নিজেই তা পরেছি। এটা আমার ব্যাপার। তা আমি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কাজ করছি। একসময় তা দেখা যাবে সভার বাইরেও। কিছু ধর্মীয় নেতা যখন এ নিয়ে রীতিমতো বিলাপ করছিলেন, তখন প্রতিনিধি সভা ইলহানকে নির্বাচিত করে যুক্তি দেয় যে, এখন থেকে ইলহান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জন্য উন্নততর নীতি নির্ধারণ করবেন।
এক যোগাযোগ বার্তায় ইলহান ওমর উল্লেখ করেন, ২০ বছর আগে কেনিয়ার একটি শরণার্থী শিবির থেকে আমার পিতা ও আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছেছিলাম।
আজ সোমালি আমেরিকান হিসেবে কংগ্রেসে শপথ নেয়ার জন্য একই বিমানবন্দরে যাচ্ছি, যা এক বিস্ময়কর গল্পের মতো।
২০১৯ সালের আগস্টে ইলহান ওমর এবং তার সঙ্গে নির্বাচিত হওয়া মার্কিন কংগ্রেসের আরেক মুসলিম নারী সদস্য রাশিদা তালিব ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা অধিকৃত পশ্চিম তীরে সফর করার ঘোষণা দেন। তবে ইসরায়েলকে বর্জনের আহ্বান জানানোর অভিযোগ এনে তাদের এই সফরের উপর নিষেধাজ্ঞারোপ করে ইহুদীবাদী অবৈধ এই রাষ্ট্র। আর উভয়ের নিষেধাজ্ঞারোপের প্রতি ইন্ধন জোগান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
কেননা, ইলহান ওমর ডোনাল ট্রাম্পের বেশ কিছু নীতির প্রকাশ্য সমালোচক। তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী এবং মুসলিমবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেন। এমনকি তাকে ফ্যাসিষ্ট পর্যন্ত বলতে তার বুক কাঁপেনি।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে ইলহান ওমর নিজের হিজাব পরিধান করার বিষয়ে বলেন,আমি হিজাব বা পর্দা ছাড়বো না। হিজাবকে আমি এক ধরণের প্রতিরোধ হিসেবে নিয়েছি, তবে তা সব সময় খুব সহজ বিষয় নয়। আর আমি শুধু ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে হিজাব পরি এমনটি নয় বরং হিজাব পরে আমি আনন্দও পাই।
কুরআনে হাত রেখে শপথ নিয়ে নজির সৃষ্টি করা প্রতিবাদী নারী ইলহান ওমর প্রাথমিক জীবন তিনি অতিবাহিত করেন সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে। সাত সন্তানের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। তার পিতা নূর মোহাম্মদ ওমর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতেন।
ইলহানের বয়স যখন প্রায় দুই বছর, তখন তার মা মারা যায়। পিতা এবং দাদার কাছে তিনি বড় হন। ১৯ বছর বয়সে ২০০০ সালে ইলহান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
ইলহান ওমরের জন্ম ১৯৮১ সালের ৪ অক্টোবর সোমালিয়ার মোগাদিসুতে। একসময় তিনি এডিসন হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ছাত্র সংগঠক ছিলেন। পরে নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে ২০১১ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। হামফেরে স্কুল অব পাবলিক এফেয়ার্সে একজন পলিসি ফেলো ছিলেন তিনি।
তিনি পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন তার সম্প্রদায়ের পুষ্টিশিক্ষা বিষয়ে। ২০০৬ থেকে ০৯ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর মেনিপোলিস সেইন্ট পল এলাকায় এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে কারি ডিজেজিক পুনর্নির্বাচনে অংশ নেন মিনোসোটা স্টেটস সিনেটের জন্য।
২০১২-১৩ পর্যন্ত মিনেসোটা ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনে শিশুপুষ্টির কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফেব্রুয়ারি ১৪ তে তিনি কিছু লোক দ্বারা আক্রান্ত হন।
সেপ্টেম্বর ২০১৫তে ওম্যান অর্গানাইজেশন ওম্যান নেটওয়র্কে পরিচালক ছিলেন। সংস্থাটি পূর্ব আফ্রিকার নারীদের নগর বা নাগরিক বিষয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করেন তিনি।
সূত্র: ইন্টারনেট
-এটি