তানভীর সিরাজ ♦
একটি দেশ, একটি সমাজ, একটি পরিবার এবং ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনকে সুরক্ষা, সুস্থ ও সুন্দর রাখা সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। মানবতার ধর্ম ইসলাম তাই শিক্ষা দিয়েছে।
প্রতিটি সৃষ্টির নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে ইসলাম একজন মানব ও দানবের মানবতাকেই নির্ধারণ করেছে। সুতরাং প্রত্যেকের মানবতাই নিজ নিজ রক্ষীবাহিনী হিসেবে কাজ করবে।
নিজের ক্ষমতা অক্ষত রাখতে অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে যেমন অপরাধী বলে সাব্যস্ত করা যায় না, নিজের শখ মিটাতে স্বাধীনচেতা পাখিকে যেমন বন্দি করে রাখা যায় না, তেমনি নিজের কুপ্রবৃতির বসে অন্যের মা-বোন বা পরকীয়া চর্চা করতে কুদৃষ্টিরগুলি থেকে একটি দেশ, সমাজ, পরিবার এবং ব্যক্তি ও সামাজিকজীবনকে সামাজিক অবক্ষয় থেকে নিরাপদ রাখা যায় না।
কারণ কালো টাকা যেমন সাদা করার কোনো সুযোগ নেই তেমনি বিধাতা যাকে পাপ বলেছেন তাকে পুণ্যের কাজ বলে ঘোষণা দেবে- সে আবার কে!
মেয়ে হলে ১৮ এর আগে আর ছেলে হলে ২১ এর আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নিষেধ। এটি দেশীয় আইন। বিধাতার আইন হল সামর্থবান ছেলেমেয়েকে যথাসময় বিবাহের ব্যবস্থা করা, অন্যথায় অভিভাবকরা তাদের পাপের শাস্তিভোগ করবেন।
আপনি বাবা হলে আপনার অধীনস্থদের শরিয়ত সম্মত পরিচালনার দায়িত্ব আপনার, আপনি ভাই হলে আপনার বোনদের বেপর্দার মহামারি থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার, আপনি স্বামী হলে আপনার স্ত্রীকে পর্দা- বেপর্দার পরকীয়ার প্রতিরোধ করা দায়িত্ব আপনার।
বলতে পারেন, তারা নেকাব আর বোরকা পরিধান করে পর্দা করছেই তো! তারা নেকাব আর বোরকা পরিধান করে পর্দা করে, আমিও তাই বলছি। তবে দুঃখের বিষয় যেটি সেটিই শিরোনামের উদ্দেশ্য।
এক সময় সব প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা নেকাব আর বোরকা নামক ধর্মীয় পোশাক পরিধান করতো না, কিন্তু এখন! এখন স্কুল, কলেজ আর ইউনিভার্সিটির প্রায় ছাত্রীকে দেখা যায়, তারা ইসলামি পোশাক নেকাব আর বোরকা বেশ পরিধান করছে। তবে গতানুগতিক যে সমস্যার মহামারিতে মেয়েসমাজ দিনাতিপাত করছে তা খুব ভয়ংকর ও অপ্রতিরোধ্য মনে হয়।
তারা ধর্মীয় পোশাকাদি গায়ে দেয়ার পরও কি নিজ নিজ পবিত্র নারীত্ববোধ বহাল রাখতে পারছে, নাকি পশ্চিমা সভ্যতার ভারি বাতাসে তারাও ভেসে যাচ্ছে?
যদি ছাত্রীসমাজ আপন আপন পবিত্র পর্দা রক্ষা করে থাকে তাহলে কেনইবা তারা আজ ধর্ষণ, ইবটিজিং আর ‘কু’ উপসর্গের শিকার হচ্ছে? বলতে পারেন তাদের শরীরে তো ধর্মীয় পোশাকের আচ্ছাদন।
এরপরেও কেন তারা আজ নারীঘটিত দুর্ঘটনার নানা ফাঁদে পা দেয়? তারা কি সেচ্ছাই দেয়, নাকি তাদের দিতে বাধ্য করে, আর নাকি তারা অপারগ হয়েই?
অনেকে ইসলামি পোশাকের ছত্রছাঁয়ায় নিজের পবিত্র যৌবনকে অপবিত্র করছে। তারা ধারণা করে নেকাব আর বোরকা পরিধান করলে পরিবারের কেউ তো আমায় আর দেখছে না। দেখছে তাদের যিনি দেখার। যার অসাধ্য কিছু নেই, যার অগোচরে কিছুই নেই, তিনি সব জানেন আর দেখেন। যদি তারা মনে করে কেউ তাদের দেখছে না তাহলে তারা ভুল সিদ্ধান্তে ভুল পথে পা দিচ্ছে, বাড়াচ্ছে।
এই প্রকারের কারণে ইসলামি পোশাক আজ বদনামের ভাগি হচ্ছে। আর সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ গ্রহণ করে করে ইসলামি পোশাকের নেতিবাচক দিকের লিস্ট তৈরিতে মেতে উঠছে।
ইসলামি পোশাক ‘নেকাব আর বোরকা’ কি আসলে বেপর্দার পোশাক? এমন প্রশ্নের উত্তর বেশ দুঃখজনক। কারণ মানবতার ধর্ম ইসলাম বলে কথা। তা হলে অমানবিক কাজের সহায়ক এমন পোশাক কি ইসলামি পোশাক হতে পারে?! না, পারে না। তা হলে হালচালে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাদি কেন আমাদের কানে আসছে?
আসল কথা হল ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত আর সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত যারা, তাদের অনেকে আজ ইসলামি পোশাকের ধোঁয়াটে ধারণায় ধাঁ ধাঁয়, যেকারণে তারা নিয়মিত প্রতারণা আর ধোঁকার শিকার।
লক্ষণ চিহ্নিতকরণ আর সমস্যার উত্তরণ: বোরকা আর নেকাপই একমাত্র ইসলামি পোশাক, এ ধারণা মোটেই ঠিক নই। নেকাব আর বোরকা ইসলামি পোশাকের একটি রূপরেখা মাত্র।
ইসলামি পোশাক হল, নারীসমাজের এমন পোশাক পরিধান, যেটি গায়ে দিলে আপাদমস্তক তার উঁচানিচা কিছুতেই বুঝা যায় না এবং ভেসে উঠে না, সেটিই একমাত্র ইসলামি পোশাক।
যা পরিধান করলে একজন মেয়ে, মহিলা আর নারী শিক্ষিত অশিক্ষিত বখাটের কুদৃষ্টি থেকে পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকবে, সেটিই পরিপূর্ণ ইসলামি পোশাক।
আর কুদৃষ্টিই হল ব্যভিচারের প্রথম সিঁড়ি। হযরত মাওলানা আশরফ আলি থানভি (রাহমাতুল্লা আলায়হি) বলেন, কুদৃষ্টি যতোই দেয়া হোক, চাই হাজারো নারী-পুরুষ দর্শন করা হোক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই সন্ধানে ঘুরে বেড়াক, তার পরিতৃপ্তি আসবে না। কুদৃষ্টি এমন পিপাসা লাগায়, যা কখনো নিবারণ হয় না। পানিশূন্যতার রোগী এই পরিমাণ পানি পান করুক যে তার পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম তবুও সে পরিতৃপ্ত হবে না।
হাফিজ ইবনুল কাইয়্যুম (রাহমাতুল্লা আলায়হি) বলেন, কুদৃষ্টির তীর নিক্ষেপ করলে নিক্ষেপকারী প্রথমে বিদ্ধ হয়। কারণ দৃষ্টি নিক্ষেপকারী আরেকটি দৃষ্টিকে তার ক্ষতের ওষুধ বলে মনে করে। অথচ তা ক্ষতকে আরো গভীর করে।
বর্তমান বিশ্বে এমন কিছু বোরকা আর নেকাবের স্রোতে বিশ্ব মুসলিমনারী ভেসে যাচ্ছে, যার পরিধান নষ্ট পথের পাথেয় যোগাই। তথাকথিত ইসলামি যে পোশাকটা একজন পুরুষকে কুপ্রভাবে প্রভাবান্বিত করে, তা কীভাবে ইসলামি পোশাক হয়!
এমনকি একজন জেনারেল শিক্ষিত আর আলিয়া শিক্ষিত শিক্ষকও নিজেকে সংযত রাখতে পারছেন কি? যদি পারতো তাহলে সেইদিনের (৩০.০৬.১৯) দৈনিকে ধর্ষিত ছাত্রী ২০ জনেরও বেশি! এই শিরোনাম হত না।
আর মাদরাসার কথাও আজ বেশ কানে আসছে, তবে সব সমস্যার একই কারণ, তা হল নিজেদের অধীনে থাকা ছেলেমেয়ে আর নারীপুরুষদের পর্দার নামে বেহায়াপনার প্রতিরোধ না করা। আরব হোক আর অনারব হোক সব দেশের একই দুরবস্থা।
ব্রিটিশী কারিকুলামে সহশিক্ষা যেকদিন চলবে ততদিন আপনার আমার মেয়ে শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ থাকবেনা, বরং দিনরাতের পরিবর্তন যেমন সত্য, আরও বেশি সত্য সহশিক্ষায় নারীসমাজের অনিরাপত্তার তিক্ত সত্যতা।
গত কয়েক বছর আগেও সব পরিবারে নেকাব আর বোরকা তেমন একটা দেখা না গেলেও এখন কিন্তু প্রায় পরিবারে তার দেখা মিলে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল আগের তুলনাই এখন পরকীয়ার হার অনেক বেশি।
একদিনের ঘটনা। প্রসিদ্ধ লেখক সাইমুম সাদী ভাইয়ের সাথে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের পাশে নাস্তা করছিলাম। এই ফাঁকে চোখেআঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরকীয়ার কী বেহাল অবস্থা।
এখানে অবস্থাই ফায়েল বা কতৃকারক। রেস্টুরেন্ট। সন্তানকে নিয়ে স্কুলে এসেছে মিসেস। এই সুযোগে পরকীয়ার সুযোগ নিল আর এই বলে উঠেগেল যে, এ-ই, মেয়ের স্কুল ছুটি হয়ে এখন। যাই এখন। রীতিমত বেশ ভাবনাযুক্ত হয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
আচ্ছা, মহিলাটির মেয়ে শিশু যদি কোনোদিক দেখে ফেলে অথবা কিছু একটা বুঝে ফেলে সেও কি তার মায়ের পরকীয়াবাদ থেকে কিছু হলেও শিক্ষা নিবে! তবে এক্ষেত্রে যারা সাংসারিক তাদের একটি পোশাক নির্বাচন করতে হবে তাদের পবিত্র পরিবারের জন্য, অন্যতাই অপবিত্রের কাতারে শামিল হবে পবিত্রা সেও।
পোশাকটি হবে এমন, 'প্রাপ্তবয়স্ক আর বিবাহিত লোক যেপোশাকিকে দেখলে ইতস্ততবোধ করে আর কুপ্রকৃতির শিকার হয়ে আত্মরক্ষা করতে হিমশিম খায়' এমন পোশাক থেকে নিজের পরিবারকে রক্ষা করলে পরকীয়ার হার কমে আসবে।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন, হে নবী! ঈমানদারদের বলুন, তারা যেন তাদের চোখ সংযত রাখে আর লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। নিশ্চয়, আল্লাহ্ তা'আলা তাদের কাজ সম্পর্কে জানেন। (সূরা নুরা-৩০) আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ হল নবি সা. এর পবিত্র স্ত্রীগণ আমাদের মায়েরাই।
-এটি