আওয়ার ইসলাম: যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে।
অনেকে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও দোষীদের ফাসি দাবী।
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিমও তার ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট দিলেন নুসরাতের পক্ষে। তার স্ট্যাটাসটি হুবুহ তুলে ধরা হলো-
“নুসরাত, তোমার অগ্নিদগ্ধ শরীর, অসীম সাহসিকতার সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, ব্যান্ডেজে বাধা শরীরের মাঝে বেরিয়ে থাকা ফুটফুটে সুন্দর মুখ আর পা-জোড়া, তোমার “ডায়িং ডিক্লারেশন”– এর দৃপ্ত উচ্চারণ –“এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো”- আবারো এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করলো যে সমাজের বিবেক এখন লাইফ সাপোর্টে, তুমি নও। তুমি বরং লাইফ থেকে এই অচল সমাজের অমানবিকতাকে প্রতিবাদ করতে বলে, শান্তির জগতে চলে গেছ।
নারী-শিশু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনা এখন সড়ক-দুর্ঘটনার মতোই কেবল সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে। এটি হতে দেয়া যাবে না। মাদ্রাসা-অধ্যক্ষের বিরু্দ্ধে শ্লীলতাহানির প্রচেষ্টার অভিযোগ করার জন্য তোমার ভাষ্যমতে, মিথ্যা কথা বলে কয়েকজন সহপাঠী তোমাকে ছাদে নিয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দিলে-তুমি তাতে রাজী না হয়ে “এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো” বললে তোমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তুমি তাদের ‘নারী কন্ঠে’র কথা বলেছ।
‘কাক’-এর মাঝে ‘নারী-কাক ’ বা ‘পুরুষ-কাক’-এমন লিঙ্গ বিভাজন করি না আমরা। কিন্তু মানুষ বিভাজিত হয়ে যায় নারী ও পুরুষে। একটি কাক বিদ্যুৎপৃষ্ট হলে মারা গেলে অনেক কাক কোথা থেকে যে এসে জড়ো হয় ! তাড়স্বরে আওয়াজ করে। ওরা কি চিৎকার করে, না কাঁদে জানি না। কিন্ত কিছু একটা করে। আর আমরা?
যখন তোমার ডায়িং ডিক্লারেশনে তুমি কয়েকজন নারী তোমার গায়ে আগুন দিয়েছে বলো-তখন মনে হয় মানুষ কি কাকের মতো হতে পারে না? মানুষ নাই হোক। কারণ আমরা মানুষতো নই-ই, কাকও নই। তুমি যখন তোমার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে, তখন অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা তোমার পক্ষে লড়ে গেলে তুমি শক্তি পেতে।
যখন ফায়ার সার্ভিসের লড়াকু সোহেল জীবন বাঁচাতে জীবন দেয়, জসিম নামের মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি যে চারতলার গ্রিল বেয়ে উঠে এক নারীর জীবন বাঁচায় আগুন থেকে তখনই একদল মানুষ আরেক নারীর গায়ে আগুন দেয়। এত ছোট একটি জীবন কেবল মানুষের ভালো করার জন্যই বড় সংক্ষিপ্ত-সেই জীবনে এত হিংসা, এত লোভ, এত প্রতিহিংসা, এত অমানবিকতা, এত পাষন্ডতা !
নুসরাত, তুমি বলেছ- প্রতিবাদ করে যাবে, তোমার কাজ তুমি করেছ। তোমার কাছ থেকে শিখে, এবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের প্রতিবাদ করার পালা। শেষ থেকে শুরু হোক, নতুন করে পুরনো প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে তোমার সহযাত্রী হবে-বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট।”
আজ সকাল ৯টায় নুসরাতের লাশ মর্গে নেয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য। এছাড়া ইতোমধ্যে নুসরাতের সুরতহাল প্রতিবেদন সম্পন্ন করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ।
এর আগে, বুধবার রাত ৯টা ৩০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা মারা যান ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে রাফিকে যৌন হয়রানি করেন। এ অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে রাজি না হওয়ায় তার এ করুণ পরিণতি বলে জানা যায়।
গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে রাফি আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান। এ সময় মাদরাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারধর করছে- এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় যান।
সেখানে মুখোশ পরা চার-পাঁচজন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাফি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সোমবার রাতে এজাহারে অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা সহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। অন্য আসামীরা হলেন পৌর কাউন্সিলর মাকসুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের।
ইতিমধ্যে ওই মামলার তিন আসামী সহ অন্তত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা সহ ৭ জনকে রিমান্ড দিয়েছে আদালত। এছাড়া তাকে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কর্তব্য অবহেলার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকেও প্রত্যাহার করা হয়। মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এমএম/