মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী
অতিথি লেখক
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলাদেশের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির তাড়নায় ছিনিয়ে আনা বিজয়। একটি সবুজ ভূখণ্ড। একটি বাংলাদেশ। শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই অর্জন।
৪৭ বছর একটি নবজন্মা দেশের জন্য খুব বেশি সময় না হলেও কম সময় নয়। লাল-সবুজের এমন একটি পতাকা পেয়েছি, যে পতাকাটি পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের পতাকার চেয়ে সুন্দর, যেমন সুন্দর এখানকার চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন একটি ভূখণ্ড পেয়েছি যে ভূখণ্ডটি এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিধিজুড়ে।
এখানকার মানুষ অসম্ভব পরিশ্রমপ্রিয়, অল্পে তুষ্ট। আমরা পেয়েছি একটি উর্বর ভূমি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপম বাংলাদেশ। এই ভূখণ্ডকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার কমতি নেই, এখনো এক বুক আশা বুকে চেপে বেঁচে থাকার সোনালি স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ।
নানা ধরনের ঘৃণ্যতর চক্রান্তের পদাঘাতে দেশ আক্রান্ত হলেও দেশের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও পরিশ্রম প্রিয়তার কারণে এখনো আশা জাগায়, মানুষ স্বপ্ন দেখে। রাজনীতিবিদরা দেশের উন্নয়নের চেয়েও নিজেদের আখের গোছানোর সিঁড়ি হিসেবেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে তিলে তিলে দেশকে গড়তে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে।
স্বাধীনতার মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের প্রত্যেকের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল- আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি বাংলাদেশ পাবো। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সুদৃঢ় ঐক্যের বাংলাদেশ। থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন; থাকবে অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তি। বন্ধুর অবয়বে আমাদের কোনো শত্রু থাকবে না। এ দেশের প্রতি চোখ তুলে তাকাতে পারবে না কেউ খবরদারির। থাকবে শুধু বন্ধুত্ব ও পরস্পর সহযোগিতার সম্পর্ক।
কিন্তু ৪৭ বছর পরও আমাদের ভাবতে হয়, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কতটুকু নিরাপদ। প্রতিনিয়ত সীমান্তবর্তী মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। একটি জাতির জন্য ৪৭ বছর কম সময় নয়। এই লম্বা সময়ে দেশ যতটা সামনে আগানোর কথা ছিল, ততটা আগায়নি।
বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা হলো দরিদ্রতা। দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা ও কর্মসংস্থান। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও কতটুকু অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। শাসকদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে, কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় না অভাগা জনগোষ্ঠীর।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট যেন সমগ্র জাতি। বৈদেশিক মুদ্রার আয় আমাদের রাজস্ব আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ পাড়ি জমায়, তারা অধিকাংশ অশিক্ষিত-স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিক। দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে আমাদের দেশের বাইরের কাজের পরিধিও প্রত্যাশিত পর্যায়ে বাড়ছে না।
অন্যদকে আভ্যন্তরীণভাবে দুর্নীতির অতল গহিনে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের অতি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই দুর্নীতির কবলে পড়ে সেই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এমন ব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়া একটি রাষ্ট্রের জন্য সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তরা দেশকে এর চাইতে ভালো কি উপহার দিতে পারবে?
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাঠামো বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকেই দেশ পরিচালনা করতে হয় এবং যেখানে জনমত প্রতিফলিত নয়। এখনও একটা সুষ্ঠু, সুন্দর ও দেশের মালিক জনগণের ভয়হীন অংশগ্রহণের পরিবেশের জন্য হাহাকার করতে হয়।
একটি দেশের বয়স যত বাড়তে থাকে তার ঐক্য, সংহতি, গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রপরিচালনা সুদৃঢ় হতে থাকে দেশের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর। মূলতঃ সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অভাবই এখানে প্রধান।
৪৭ বছরে অসংখ্য দুর্যোগের ঘনঘটা আর নানা অপ্রাপ্তিতে আমরা বেদনাহত হই, মুষড়ে পড়ি। এরপরও অজানা এক শক্তিতে বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আমাদের তাড়িত করে। ১৭ কোটি মানুষকে যদি জাগাতে পারি, ঘুণে ধরা সমাজের সকল অনাচার যদি শুধরে নিতে পারি, নৈতিক শিক্ষার বলে বলীয়ান করতে পারি, সর্বোপরি একটি দেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা অনৈক্যের বিষবাষ্প থেকে যদি বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে হয়তো স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ সুখ পাবে জাতি।
আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি, কারণ আমাদের তরুণরা মেধাবী ও সাহসী। তাদের যদি আজ সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া যায়, তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে স্থান করে নেবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক: মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ডটকম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।