আবদুল্লাহ তামিম: জাতিসংঘের হিসাব মতে চীনের তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে প্রায় এক মিলিয়ন মুসলিমকে আটক করে রাখা হয়েছে।
এই তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ কেন্দ্রে আটক বেশীরভাগই হচ্ছেন উইগুর মুসলিম। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া কিছু ব্যক্তি গণমাধ্যম কর্মিদের বলেছেন, মাসব্যাপী পরিচালিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে ইসলাম পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়, তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে তাদের নিজস্ব বিশ্বাসের সমালোচনা করতে হয়।
প্রতিদিন প্রায় ১ ঘন্টা করে প্রোপাগান্ডামূলক কমিউনিস্ট পার্টির গান গাইতে হয়। এসব তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্র সম্পর্কে আরো তথ্য রয়েছে, মুসলিমদের জোর করে শুকরের মাংস এবং অ্যালকোহল খেতে বাধ্য করা হয়, এমনকি সেখানে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
গত বছর থেকে চীনে এসব তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্র চালু করা হয় এবং বর্তমানে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শহর জিনজিয়াংয়ে এসব কেন্দ্রের দ্রুত প্রসার হচ্ছে। চীনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এসব ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্র হচ্ছে বিশ্বের সবচাইতে বড় সংখ্যালঘু নির্যাতন কেন্দ্র।’
প্রাথমিক অবস্থায় বেইজিং প্রধানত উইঘুর চরমপন্থিদের এসব দীক্ষা দান কেন্দ্রে আটক করে রাখত। তবে বর্তমানে এসব কেন্দ্রে সাধারণ উইঘুরদেরও আটক করে রাখা হচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা এসব দীক্ষা দান কেন্দ্রের একজন চীনা কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এখানে রাজনৈতিক দীক্ষা দান কেন্দ্রের মত কোনো কিছুই নেই’, বরং তিনি দাবী করেন এগুলো মূলত অপরাধীদের জন্য একধরনের শিক্ষামূলক বিদ্যালয়।
রেডিও ফ্রি এশিয়া গত বছর চীনের সোস্যাল মিডিয়া উইচ্যাটে উইঘুরদের সম্পর্কে চীনা একজন কমিউনিস্ট নেতার কথপোকথন ফাঁস করে দেয়।
‘জনগণের মধ্য থেকে যেসব লোকজনকে ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক রাখার জন্য বাছাই করা হয় তারা সকলেই আদর্শগত দিক থেকে অসুস্থ। তারা ধর্মীয় চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসী মনোভাবে আক্রান্ত, এবং তাদেরকে একজন রোগী হিসাবে হাসপাতালে রাখা দরকার।
ধর্মীয় চরমপন্থা একপ্রকার বিষাক্ত রোগ, যা জনগণের মন মস্তিষ্ককে অসার করে ফেলে। যদি আমরা মূল থেকেই এসব চরমপন্থা উৎখাত না করি, তবে এসব সন্ত্রাসীদের ধ্বংস লীলা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা একটি টিউমারে রুপান্তরিত হবে।’
জর্জটাউন বিশ্বাবিদ্যালয়ের চীনা ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক জেমস মিলওয়ার্ড বলেন, ‘চীনে ধর্মীয় বিশ্বাসকে একটি বিকারগ্রস্ত বিশ্বাস হিসাবে দেখা হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘সুতারাং এ জন্য তারা ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্র চালু রেখেছে যেগুলোকে তারা হাসপাতাল বলে চালাচ্ছে যাতে বিকারগ্রস্তদের চিন্তাধারা বদলে দেয়া যায়।
তারা এই প্রক্রিয়া পুরো উইঘুর মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করছে যাতে করে তারা চরমপন্থার জীবানুগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু আসলে এটি সেইরকম কিছু নয়, এটি হচ্ছে উইঘুর মুসলিমদেরকে মাসব্যাপী একটি খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে আটক রাখা।’
মেডিকেল তত্ত্ব প্রচার করে চীন চাচ্ছে বিশাল গোষ্ঠীকে ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক করে রাখাকে বৈধতা দিতে। তারা উইঘুর পুরো জাতির বিরুদ্ধে এসব প্রয়োগ করে চলছে।
বর্তমানে তাদের ভাষায় আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকেই জীবানুনাশক দিচ্ছে না বরং পুরো উইঘুর জাতির বিরুদ্ধে এর প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এসব করার মাধ্যমে চীন আরেকটি কৌশল খাটাচ্ছে আর তা হচ্ছে উইঘুরদের গ্রেপ্তার করার যে কোটা রয়েছে তা এড়ানো। অঞ্চলটির একজন পুলিশ অফিসার রেডিও ফ্রি এশিয়াকে এটা নিশ্চিত করে বলেছে যে, যখন ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটকের জন্য তারা অভিযান চালান তখন তাদের উপর সুনির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিকে আটক করার নির্দেশ থাকে।
তিনি এও বলেন যে, স্থানীয় জনসংখ্যার ৪০ শতাংশকে ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক করে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
রেড়িও ফ্রি এশিয়ার ধারণ কৃত আরেকটি উইচ্যাট বার্তায় একজন কমিউনিস্ট নেতা এভাবে ব্যাখ্যা করেনঃ
‘সবসময় একটা আশংকা থেকে যায় যে, এসব অসুস্থতা যেকোনো সময় তার স্বরূপে ফিরে আসতে পারে এবং এটা জনসাধারণের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এই জন্যই এসব অসুস্থদের ‘রাজনৈতিক হাসপাতালে’ ভর্তি করাতে হবে যাতে করে তাদের মস্তিষ্ক থেকে এসব জীবানু দূর করা যায়। যারা ধর্মীয় চরমপন্থা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও দীক্ষা নিতে চায় না তারা এমন একটি রোগে আক্রান্ত যা সময়ানুযায়ী চিকিৎসা পায়নি। এটা ভবিষ্যতে আপনাকে এর নিজস্ব ধাঁচে আক্রমণ করবে, নাকি করবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
‘একজনের ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে যাওয়ার মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া মানে এই নয় যে সে স্থায়ীভাবে সুস্থ হয়ে গিয়েছে।
সুতারাং ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দেয়ার পরে তাদেরকে অবশ্যই সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, তাদের কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি অনুগত হতে হবে এবং নিয়মিত জনসমাবেশে অংশ গ্রহণ করতে হবে যাতে তাদের শুদ্ধতা বজায় থাকে।’
‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে সম্পর্কীয় চীনের সরকারী কিছু নথিপত্রে এমন ভাষার ব্যবহার পাওয়া যায়- ‘এই লোকের মস্তিষ্কে বিষ রয়েছে- এই বিষকে অবশ্যই বের করে নিতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একজন উইঘুর গবেষক তাহির ইমিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক তার পরিবারের অনেক সদস্য রয়েছেন, এবং তিনি তাদের নিকট থেকে শুনেছেন যে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সেখানে একটি রোগের সাথে তুলনা করা হয়।
এতে করে তিনি মোটেও অবাক হননি। তার মতে চীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু উইঘুরদের হান চীনাদের সাথে একিভূত করা। তার মতে, ‘চীন সরকারর মতে যদি কোনো রোগ থেকে থাকে তবে এটি হচ্ছে উইঘুর মুসলিমরা।’
তিনি বলেন, চীনা সরকার হয়ত মনে করছে যে, ‘তারা যেসব লোকদের ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক করে রেখেছে তারা মোটেও চীনা নয়। বরং তারা হচ্ছে অসুস্থ, তারা নিরাপদ নয়, তারা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং তারা সুস্থ জনগণ নয়।’
সবচাইতে খারাপ খবর হচ্ছে, উইঘুর মুসলিমদেরকে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করে চীন মূলত তাদের স্থানীয় এবং বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হিসাবে তুলে ধরছে।
‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক কয়েকজন উইঘুর মানসিক অসুস্থতায় পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। এসব ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’র শিকার হয়ে অনেক উইঘুর অনিদ্রা, হতাশাগ্রস্ত এমনকি অনেকের মস্কিষ্ক বিকৃত হয়েছে।
মুরাত হারি নামের ৩৩ বছর বয়সী একজন উইঘুর মুসলিম, যিনি ২০১০ সালে ফিনল্যান্ডে চলে আসেন তিনি তার পিতামাতা ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক আছে বলে তার আত্মীয় স্বজন থেকে শুনেছেন। তিনি অনলাইনে ‘আমার পিতা মাতাকে মুক্তি দাও’ এরকম একটি প্রচারণা চালিয়েছিলেন কিন্তু এক সময় তিনি জানান যে তিনি মারাত্মকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
দ্যা গ্লোব এন্ড মেইলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উইঘুর একজন নারী যিনি কানাডাতে বসবাস করেন এবং যার বোন ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছি না, আমার মন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। আমি ঘুমোতে পারছি না।’ তিনি আরো জানান, ‘আমি অনেক ওজন হারিয়েছি কারণ আমি আর খেতে পারছিনা।’
২৪ বছর বয়সী উইঘুরের একজন ছাত্র যিনি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন, তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি সবসময় এই ভয়ের ভেতর থাকেন যে তার আত্মীয়-স্বজনদেরকে ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক করা হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আমার পিতার সাথে আমার শেষ যোগাযোগের প্রায় ১৯৭ দিন হয়ে গেছে। ‘আমি আমার পিতার জীবন নিয়ে শঙ্কিত।’ তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন তিনি এমন মনে করছেন, উত্তরে তিনি জানান যে, ‘কারণ আমি বিদেশের একটি বিদ্যালযে ভর্তি হয়েছি।’
‘এখন আমি জানি যদি কখনো আমি বাড়ি ফিরে যাই,’ তিনি যোগ করে বলেন, ‘আমাকে আমার পিতার মতই আটক করে রাখা হবে।’
সূত্রঃ দ্যা আটলান্টিক
আরো পড়ুন-
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর: সুচি
‘বর্তমানে ইসলামিক স্কুল নির্মাণ মসজিদ নির্মাণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ’
রাশিয়া সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া ভস্টক-চালাতে যাচ্ছে
ব্যবসার হিসাব নিকাশ এখন হাতের মুঠোয়- ক্লিক
এটি/আওয়ার ইসলাম