ভারতের অন্যতম ইসলামি স্কলার মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানির লেখা থেকে অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান
মানুষের জন্য দুনিয়ার বিবেচনায় সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জীবন। জীবনের আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে তার জীবনের সব স্বাদ নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই দুনিয়ার সব ধর্ম ও সভ্য সমাজে মানব-জীবনকে হেফাজতের জন্য উৎসাহিত করা হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মা/রূহ মানুষের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। মানুষ প্রাণের মালিক নয়, আমানতদার মাত্র। সে নিজের জীবনকে ধ্বংস করতে পারে না, এমনকি অন্যের জীবন ধ্বংস করার উৎসবে মেতে উঠতে পারে না।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসুল সা. ইরশাদ করেন : مـن قـتـل نـفـسـه بـحـديـدة فـحـديـدتـه فـى يـده يـتـوجـأ بـهـا فـى بـطـنـه فـى نـار جـهـنـم خـالـدا فـيـها أبـدا .
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে অস্ত্রটি তার হাতে থাকবে এবং তা দ্বারা সে পেটে আঘাত করতে করতে চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে। (বুখারি, কিতাবুত তিব, বাবু-শুরবিস সুম্মে ওয়াদ দাওয়ায়ে বিহি, হাদিস : ৫৭৭৮, সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদিস : ৩১৩)
আত্মহত্যার জন্য ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা জরুরি নয়, আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কোনো বিষাক্ত বস্তু ভক্ষণ কিংবা পান করাও নিষিদ্ধ।
হাদিসের ভাষ্য : مـن تـحـسـى سـمـا فـقـتـل نـفـسـه، فـسـمـه فـى يـده يــتـحساه فـى نـار جـهـنـم خـالـدا مـخـلـوا فــيـهـا ابــدا .
যে ব্যক্তি কোনো বিষপানে আত্মহত্যা করে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে সে বিষ তার হাতে দিবেন এবং সে সদা তা পান করতে থাকবে। আত্মহত্যা সর্বোপরি মানব জীবন ধ্বংসকারী।
কোন ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা না করে আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করে, এমন কামনা করাও বৈধ নয়। রাসুল সা. বলেন- لا يــتـمـنـى أحــدكـم الـمـوت امـا مـحـسـنـا فـلـعـلـه يـزداد وامـا مـسـيـئـافــلـعـلـه يـسـتـعـتـب
অর্থাৎ, তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে, সে নেককার হলে হতে পারে বয়স বৃদ্ধি পাবে, গুনাহগার হলে নিন্দিত হবে। (বুখারি, কিতাবুত তামান্নি, বাবু মা ইয়ুকরাহু মিনাত-তামান্নি, হাদিস : ৭২৩৫)
তাই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, ইসলাম ধর্মে অন্যকে হত্যা করার অনুমতি নেই। এমনকি আত্মহত্যারও সুযোগ নেই।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনেক মানবাধিকার দল দাবি করছে, মানুষকে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুবরণ করার অধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে যে ব্যক্তি নিজ সক্ষমতায় চলতে পারে না এবং তার ওয়ারিশগণ তাকে চিকিৎসা করাতে অক্ষম। এমন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য মৃত্যু বরণের অধিকার থাকা চাই।
অসুস্থ ব্যক্তি এবং তার নিকটাত্মীয়গণ যদি মৃত্যুর জন্য ডাক্তারের সাহায্য কামনা করে তাহলে ডাক্তারদের সে কাজে সাহায্য করার অনুমতি থাকা চাই। এমন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণকে ইংরেজিতে Euthanasia, Painless-killing, Mercy killing তথা আরামের মরণ, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু ঘটানো বলা হয়।
আরবিতে قـتـل بـدافـع الـشـفـقـة বলা হয়। উর্দূতে قـتـل بـه جـذ بـه رحـم বলা হয়। Euthanasia দু’ধরনের হয়। ১. Active Euthanasia, ২. Passive Euthanasia.
প্রথম প্রকার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, অসুস্থ ব্যক্তিকে এমন ওষুধ দেয়া হবে কিংবা ইনজেকশন পুষ করা হবে যা তড়িৎ তাকে মৃত্যুর ঘুম এনে দেবে। আর দ্বিতীয় প্রকার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া হবে। চিকিৎসার অভাবে যেন ধীরে ধীরে তার মৃত্যু এসে যায়।
যেমন কোন ব্যক্তি লাইফ সাপোর্ট-এ অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় ছিলো। তার মস্তিস্ক সক্রিয় ছিলো। এমতাবস্থায় অক্সিজেন সরিয়ে নেয়ার কারণে তার মৃত্যু তরান্বিত হবে।
বৌদ্ধ ধর্মে স্বেচ্ছায় মৃত্যু ঘটানোর অনুমতি আছে। তবে, মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণকারী ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে এমন মৃত্যু ঘটানোকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আধুনিককালে নেদারল্যান্ড এবং আমেরিকার Orgon প্রদেশে স্বেচ্ছায় মৃত্যু ঘটানোর অনুমতি রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে কিছু সময়ের জন্য অনুমতি সাপেক্ষে এই ধরনের মৃত্যুর অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই আইন বাতিল করা হয়েছে।
পৃথিবীর সর্বত্র আইনগত ভাবে Euthanasia নিষিদ্ধ। ভারতে অরুণা নামের এক মহিলা ৪২ বছর বয়সে মৃত্যুশয্যায় থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টে মার্সি-কিলিংয়ের অনুমতি প্রার্থনা করে একটি রিট করা হয়।
২০১১ সালে মে মাসে ভারতের সুপ্রিমকোর্টে স্বেচ্ছায় মৃত্যু ঘটানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে আদালতের পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝা যায়, তারা অন্যের দ্বারা ঘটানো মৃত্যুকে বৈধ মনে করে এবং এ সংক্রান্ত বৈধতার রায় প্রদানের পক্ষে বিচারকদের মতামত চাওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্তের পর বুদ্ধিজীবি, স্কলার, সমাজ সেবিদের মধ্যে এ নিয়ে গুঞ্জন হতে থাকে। এমন আত্মহত্যা ও নিরাপদ মৃত্যু ঘটানো বৈধ কি অবৈধ?
কিন্তু ২০১৮ সালের ৯ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট তাদের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তের বিপরীতে মার্সি কিলিং তথা- যন্ত্রণাহীন মৃত্যু ঘটানোকে বৈধ ঘোষণা করে। প্রধান বিচারপতি Justick dipak misra নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারক প্যানেল এমন মৃত্যু ঘটানোর পক্ষে রায় প্রদান করে।
সেই রায়ের সারমর্ম হলো- কোন অসুস্থ ব্যক্তি যদি মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে কষ্ট ভোগ করে, সেক্ষেত্রে রোগীর ইচ্ছা, আত্মীয় স্বজনদের অনুরোধ কিংবা ডাক্তারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুগীকে চূড়ান্ত মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যাবে।
রায়ের স্বপক্ষে মত পেশ করা হয় এভাবে, এ মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্য রুগীকে কষ্ট দেয়া নয়। বরং তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া। তাই এটি বৈধ হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত: মানুষ তার আত্মার মালিক, তাই তার জন্য নিজেকে নিজে নিঃশেষ করে দেয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ স্বীয় জীবনের মালিক নয়। বরং জীবন মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে তার কাছে আমানত। তাই তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগের কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত: মানুষের জীবনের সাথে শুধু তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নয় বরং অন্যান্য হকদারদের স্বার্থও সংশ্লিষ্ট।
আত্মহত্যা সর্বদিক বিবেচনায় নিষিদ্ধ। কেননা, এতে অন্যদের স্বার্থ ও হকসমূহ নষ্ট করা হয়।
তৃতীয়ত: এ ধরনের হত্যার দ্বারা সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা, অনেক সময় ওয়ারিশগণ মাওরিস-এর দ্রুত মৃত্যু কামনা করবে এবং তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কিংবা ওয়ারিশদের চেষ্টা থাকবে যেন অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসায় বেশি অর্থ খরচ না হয়।
যদি এমন মার্সি কিলিংয়ের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে আত্মহত্যার আইনগত বৈধতার পথ উন্মুক্ত হবে। সুপ্রিম কোর্ট অসুস্থ ব্যক্তি, তার ওয়ারিশ ও ডাক্তারকে এ কাজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে।
এ ধরনের অনুমতি জাতির জন্য মহা বিপদজনক, উপরোক্ত হাদিস ও বর্ণনার আলোকে বুঝা যায়, এ ধরনের মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
ফুকাহায়ে কেরামের মতে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও আত্মহত্যা বৈধ নয়। ফুকাহায়ে কেরামের ভাষায় لـوأ صـابـه مـر ض لا يـطـيـقـه لـفـرط ألـمـه لـم يـجــز قـتـل نـفـسـه
অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি এমন রোগে আক্রান্ত যে ব্যথার যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছে না, তার জন্যও আত্মহত্যা বৈধ নয়। (কাওয়ায়েদুল আহকাম : ৮৫)
কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় নিজেকে হত্যা করার জন্য অন্য মানুষকে অনুমতি প্রদান করে তবুও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য তাকে হত্যা করা বৈধ হবে না। কেউ যদি এরকম হত্যা করে তার ওপর কেসাস ওয়াজিব হবে না। তবে দিয়াত ওয়াজিব হবে। -রদ্দুল মুহতার : ১০/২৫৫
হ্যাঁ নিম্নোক্ত সুরত হত্যার সাদৃশ্য হয়। যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা বর্জন করা হয়। সরাসরি হত্যা নয় এমন EUTHANASIA -পন্থা অবলম্বন করা হয়। কেননা চিকিৎসা করানো মুবাহ, ওয়াজিব নয়। তাই এ পদ্ধতি বৈধ হওয়ার কথা।
বাস্তব কথা হলো, চিকিৎসা করানোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য চিকিৎসা বন্ধ করানো বৈধ নয়। রাসুল সা. রুগ্ন ব্যক্তিকে চিকিৎসা করানোর জন্য উৎসাহিত করেছেন।
তিনি ইরশাদ করেন يـاعـبـاد الـلـه تـداووا فـان الـلـه لـم يـضـع داء الا وضـع لـه شـفـاء ـ
অর্থাৎ, হে আল্লাহর বান্দা! চিকিৎসা গ্রহণ কর, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার করেছেন। (সুনানে তিরমিযি, কিতাবুত তিব্ব, ২১৭২)
এখন কথা হলো চিকিৎসা করানো মুবাহ। যে জিনিস মুবাহ হয় তা লক্ষ্যের অনুগামী হয়।
শরিয়ত বিরোধী কোন কাজে তা ব্যবহার গুনাহের শামিল। যেমন বাজারে যাওয়া মুবাহ। তবে মদপানের লক্ষ্যে বাজারে যাওয়া হারাম। যে জিনিস জায়েজ বা মুবাহ, তার হুকুম মাকসাদ তথা উদ্দেশ্যের আলোকে নির্দিষ্ট হবে।
وامـا الـمبـاحـات فـانـهـا تـخـتـلـف صـفـتـهـا بـاعـتـبـار مـا قـصـدت لاجـلـه ـ
আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের : ১/৭৪
যেমন, খাবার ভক্ষণ করা। স্বাভাবিক অবস্থায় আহার করা ওয়াজিব নয়; মুবাহ। কোন ব্যক্তি যদি তীব্র ক্ষুধার সময়ও আহার না করে এবং মুত্যর মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও রোযা না ভাঙ্গে, এমতাবস্থায় ফকিহদের মতে সে গুনাহগার হবে।
কেননা, নামান্তরে সে আত্মহত্যা করেছে। ফকিহদের ভাষায়- مـن ا مـتـنـع أكـل الـمـيـتـة حـال ا لـمـخـمـصـة أم صـام ولـم يـأكـل حـتـى مـات اثـم لانـه اتــلـف نـفــسـه.
(মাজমাউল আনহুর : ৫২৪২)
মুসলিম স্কলারদের সর্বসম্মত মতে সর্বাবস্থায় EUTHANASIA নিষিদ্ধ। এমন মৃত্যুর অনুমতি প্রদান মানবতার জন্য মহা বিপদজনক।
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ; ভয়াবহ সঙ্কটের আশঙ্কায় বিশ্ব
-আরআর