সাজ্জাদ আকবর : দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে সীমাহীন আলোর ঝলক নিয়ে ওঠে ঈদের চাঁদ। আকাশের ফিরোজা পর্দা ছিন্ন করে গ্রহ তারার মাহফিল জমিয়ে হেসে ওঠে শাওয়ালের একফালি বাঁকা চাঁদ। নিয়ে আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টির সওগাত। ঈদের সেই চাঁদ দেখে আমরা হর্ষিত হই। সারা বছরের দুঃখবিভেদ ভুলে জড়াই ভালোবাসার আবেগময় পরশে।
ঈদ মানেই তো নবজীবনের স্পন্দন, সম্প্রীতির বন্ধন। ঈদ মানেই আত্মস্বার্থের বলিদান, পরার্থপরতার কৃচ্ছ্রতাসাধন। ঈদ মানেই ভ্রাতৃত্বের সৌরভে মৌ মৌ করা ঈদগাহ। ঈদ মানেই পাঁচতলার আয়েসীজন গাছতলার রিক্তজনের সাথে একাকার হয়ে যাওয়া। যতো গান আছে জীবনে ছড়ানো, যতো প্রীতি আছে হৃদয়ে জড়ানো, যতো গীতি আছে আনন্দ ভরানো-পবিত্র এই ঈদে সবই ছলকে ওঠে। ঝলকে ওঠে বিদ্যুতের মতো।
আচ্ছা,কার জন্য পবিত্রতম এই ঈদ? ভোগের পেয়ালায় ঠোঁট ভিজিয়েছে যে-তার জন্য? সাহরি ইফতারের পবিত্রতার স্পর্শ যে গ্রহণ করেনি যে, তার জন্য? না,বরং ঈদ শুধু তাদের জন্যে, যারা দিন কাটিয়েছে সিয়ামে আর রাত কাটিয়েছে কিয়ামে। রোজাকে বানিয়েছে ঢাল। আর ঢালকে করেছে দৃঢ় থেকে সুদৃঢ়। যারা সামর্থ্যের হাত ভরে বিলিয়েছে মানুষকে। গরিবকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার পাওনা।
ঈদ তাদের জন্য নয়, যারা সিয়াম পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ঈদ নয় কোনো শিল্প সঙ্গীতের আসর। ঈদ নয় টিভি সিনেমার সস্তা বিনোদন মহড়াও। ঈদ হলো,দীর্ঘ সিয়াম সাধনা শেষে আল্লাহর সমীমেপ বিনীত উপস্থিতি। ঈদ হলো তাঁর স্তুতিগানে মুখরিত একদল বিনম্র মানুষের ঈদগাহের দিকে ছুটে যাওয়া। তাঁর মহিমা কীর্তনে উচ্ছ্বসিত হয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশে বাতাসে তাঁর বড়ত্বকে ছড়িয়ে দেয়া।
তবে হাসিখুশি আর আনন্দই ঈদের সারকথা নয়। বরং আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে মানবচিত্তকে উজ্জীবিত ও প্রসারিত করাই ঈদের মর্মবাণী। জাতীয় এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত আছে সম্পদের সুষম বণ্টনের অনিবার্যতা। আছে জাকাতের অপরিহার্য প্রাসঙ্গিকতা এবং ধনীদের সঙ্গে গরিব দুখী ও দুস্থরা জাতীয় আনন্দে সমান অংশীদার হয়ে ওঠার অনুষ্ঠান এ ঈদ। ঈদ সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুমহান প্রণোদনা।
এই সাম্য আর ভ্রাতৃত্ব মূলত ইসলামের দর্শন। নিছক আনন্দ আর ভোগের নামই নয় জীবন।ইসলামপূর্বযুগে আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামে দুটি বার্ষিক উৎসব প্রচলিত ছিলো। সেই সব উৎসবে সামর্থ্যবানরা যথেচ্ছ ফূর্তি করতো। এই উৎসব তাই নবীজির কাছে পছন্দ হলো না।যেখানে ত্যাগ নেই, যেখানে সামাজিক সাম্য অবিদ্যমান, সেখানে আনন্দ উৎসব কেবল একশ্রেণির মানুষের ভোগের জাহান্নামকে লেলিহান করে আর অপর শ্রেণির দীর্ঘশ্বাস ও বঞ্চনার করুণ ক্রন্দনকে বেসামাল করে তোলে।
এ কারণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের লক্ষ্যহীন আনন্দ-উৎসবের সেই পদ্ধতির পরিবর্তে মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির পবিত্র স্পর্শমণ্ডিত ও বহুবিধ কল্যাণপ্রসূ ঈদুল ফিতর ও আযহার ঘোষণা করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন-'লিকুল্লি কাওমিন ঈদুন, হা -যা ঈদুনা।'
অর্থাৎ, প্রত্যেক জাতির জন্য আনন্দ ও উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের জন্য ঈদের দিন হলো সেই আনন্দের দিন, উৎসবের দিন।
সৌহার্দ্য ও সাম্যের অভিনব এই জীবনব্যবস্থা দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম বলেছে উৎসবঘন এ ঈদের মাঠে প্রত্যেকে ঝেড়ে ফেলবেন পূর্বশত্রুতা, মনোমালিন্য ও বিবাদ বিসংবাদ। সবার মধ্যে নিজেকে বিরাজ করতে দেখবেন। নিজের মধ্যে দেখবেন সব মানুষের উপস্থিতি। চিন্তা ও কর্মের সীমানা থেকে অসততাকে বের করে দিবেন আর দুর্নীতির বীজসমূহকে দূরীভূত করবেন মনের আঙিনা থেকে।
নবতর এই বিশ্বায়ন রয়েছে ঈদের শিক্ষায়। যেখানে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব চলবে না। সব মানুষই আল্লাহর দাস। সে কেবল আত্মসমর্পণ করবে আল্লাহর সার্বভৌম পবিত্রতার সমীপে।
আজকের পৃথিবীতে যখন ইনসাফ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দাপুটে অন্যায়ের সামনে, তখন ঈদ এসেছে ন্যায়ের জয়ধ্বনি নিয়ে। যখন মানবাধিকারকে লাশে পরিণত করে তার কবর খোঁড়া হচ্ছে মহাউৎসবে, তখন ঈদ এসেছে সাম্য ও সমতার তাকবির হেঁকে। যখন উম্মাহ মিলিত তাসবীহকে ছিন্নভিন্ন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে পরস্পরের শত্রু হয়ে বসে আছে,তখন ঈদ এসেছে ঐক্যের বন্ধনে ঘুরে দাঁড়াবার আহ্বান নিয়ে।
পবিত্র সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাপন করি ঈদের আনন্দ। নয়া জমানার মিনারে মিনারে হাঁক দিই নবুওয়তের পয়গাম। যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদবে না। যেখানে নিশ্চিত হবে সত্যিকার মানবতা ও মানবাধিকার। পুণ্যে পুণ্যে ভরা ঈদ উৎসবে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
বায়তুল মুকাররমে ৫টি ঈদ জামাত; ইমামতি করবেন যারা
এসএস