রকিব মুহাম্মাদ
আওয়ার ইসলাম
ফিলিস্তিনিদের ধরপাকড়
১৬ বছরের ফিলিস্তিনি কিশোরী আহেদ তামিমি। ইসরায়েলি সেনাদের গালে থাপ্পড় মেরে ফিলিস্তিনিদের সাহস ও প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেছেন। ফেসবুকে সেই ভিডিও প্রচার করার পর মুহুর্তেই তা ভাইরাল হয়। ইসরাইলি সেনারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আহেদ তমিমিকে গ্রেফতার করে। তামিমির মা নরিমন তামিমির বিরুদ্ধেও আনা হয়ে সামাজিক মাধ্যমে উস্কানির অভিযোগ।
আরেকজন ফিলিস্তিনি নাগরিক দেরেন তাতুর। তাকে গ্রেফতার করা হয় ফেসবুকে ‘সহ্য করো ভাইয়েরা, সহ্য করো’ শিরোনামে কবিতা পোস্ট করার জন্য। তাতুরের গ্রেফতারের পর আন্তর্জাতিক লেখক, শিল্পী আর গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
অক্টোবরে ইসরায়েলের পুলিশ এক ফিলিস্তিনিকর্মীকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ ছিল ‘সন্ত্রাসী হামলার হুমকি’ দিয়ে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন তিনি। পরে জানা যায়, ওই শব্দগুচ্ছের সঠিক অর্থ ‘শুভ সকাল’ বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে দেয়।
ইসরায়েলের কারাগারে আটক ব্যক্তিদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠী আদামিরের আইনজীবী মাহমুদ হাসান বলেছেন, ২০১৭ সালে ফেসবুক পোস্টের কারণে তিনশোরও বেশি ফিলিস্তিনির আটক হওয়ার ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত (২০ জানুয়ারি ২০১৭) ৪৭০ জন ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সামাজিক মাধ্যমে উস্কানি দেওয়ার।
ইসরাইলের ক্ষোভ ও ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ
সামাজিক মাধ্যমগুলোর পোস্টের কারণে ফিলিস্তিনিদের সরাসরি গ্রেফতার, মামলা ও কারাদণ্ড দেওয়াতেই থেমে থাকেনি ইসরায়েল। সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুককে তারা বাধ্য করেছে ‘ইসরায়েলবিরোধী’ যে কোনও পোস্ট, ভিডিও মুছে ফেলার এবং সংশ্লিষ্ট পেজ বা অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তাদের করা পোস্ট ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মুছে ফেলছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের ইহুদিবাাদী প্রধানমন্ত্রী নিজেই ফেসবুকে ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে পোস্ট করে চলেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানী এক প্রতিবদনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
ফেসবুককে ইসরাইলের হুমকি
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্ট-এর বরাত দিয়ে বাংলা ট্রিবিউন বলছে, ফেসবুককে বাধ্য করতে যে কৌশল নিয়েছিল ইসরায়েল সে বিষয়ে ইন্টারসেপ্ট একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত ইসরায়েল অভিযোগ করে আসছিল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ‘পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ’ ফেসবুক। এক পর্যায়ে তেল আবিব ফেসবুককে হুমকি দেয়। আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখায় তারা।
ইসরায়েল ফেসবুককে জানায়, আইন প্রণীত হলে উত্তেজনা ও উস্কানি সৃষ্টিকারী ফিলিস্তিনি অ্যাকাউন্ট বন্ধে ব্যর্থতার বিপরীতে ফেসবুককে জরিমানা করা হবে। প্রণীত আইনের মাধ্যমে গোটা ইসরায়েলে ফেসবুক নিষিদ্ধ করারও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এইসব হুমকির কারণেই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতায় আসে।
যদিও বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ফরচুন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানায়, ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউব ইসরায়েলের অনুরোধের মুখে ফিলিস্তিনিদের কনটেন্ট মুছে ফেলার হার ৯৫ শতাংশ।
ইসরাইলের সঙ্গে ফেসবুকের আতাত
গত বছর সেপ্টেম্বরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন ইসরায়েলের কট্টরপন্থী আইনমন্ত্রী আয়ালেত সাকেদ। এতে ফিলিস্তিনিদের ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এছাড়া ইসরায়েল গুগলের সঙ্গেও একই ধরনের বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকগুলোর ফল এখন স্পষ্ট হচ্ছে। খবর গ্রিনওয়াল্ড-এর।
ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যারা অনেকদিন ধরে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের উপর ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সেন্সরশিপ চালাচ্ছে ফেসবুক। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে গর্ব করে বলেন, ফেসবুক তাদের নির্দেশ মানতে কতটা অনুগত।
বৈঠকের পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফিলিস্তিনি তথ্য কেন্দ্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানায়, ২০ লাখ ফলোয়ারসহ আরবি ও ইংরেজি পেজের অন্তত ১০ জন অ্যাডমিনের অ্যাকাউন্ট বাতিল করেছে ফেসবুক। এর মধ্যে ৭ জনের অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গত মার্চেও ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল ফাতাহর লক্ষাধিক ফলোয়ারের পেজ বন্ধ করে করে দেয় ফেসবুক। কারণ হিসেবে বলা হয়,‘সাবেক নেতা ইয়াসির আরাফাতের রাইফেল হাতে একটি পুরাতন ছবি পোস্ট দেওয়া’। এছাড়া বন্ধ করা হয় জনপ্রিয় ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের কর্মী, সংবাদমাধ্যম ও সংস্থার পেজ।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ
ফিলিস্তিনিদের দমনে ফেসবুক ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে কিন্তু ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে যা খুশি তাই পোস্ট করতে পারে। এমনকি ফেসবুকে ফিলিস্তিনিদের হত্যার আহ্বানও জানায় তারা। এরপরও তাদের কোনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় না। গত বছর আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘হিব্রু ভাষায় পোস্ট করা উস্কানিমূলক লেখার প্রতি ফেসবুক এবং ইসরায়েলি প্রশাসনের খুব কম মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।’
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১ লাখ ২২ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী সরাসরি খুন, হত্যা, পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক পোস্ট লিখেছে। আরবদের প্রতি সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে। এরপরও সেন্সর করার জন্যে ফেসবুকের চেষ্টা চোখে পড়েনি। এমনকি ফিলিস্তিনি কোনও নেতার সঙ্গেও দেখা করেনি তারা। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেই সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও উত্তেজনা ছড়ানোর আহ্বান জানিয়ে নিয়মিত পোস্ট দেন।
এসএডিএ’র মতো সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সমস্যা চিহ্নিত করতে কাজ করা সংগঠনগুলো কয়েকদিন আগে ‘প্যালেস্টাইন ডিজিটাল অ্যাকটিভিজম ফোরাম’ নামে রামাল্লায় এক সম্মেলনে মিলিত হয়। এতে ফিলিস্তিন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী, সরকার ও সামাজিক মাধ্যম কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ছিলেন ফেসবুকের প্রতিনিধিও। সেখানে বেশ সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন ফেসবুক প্রতিনিধি।
সূত্র : আল-জাজিরা, বাংলা ট্রিবিউন/ আরএম/