বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বনশ্রীতে আলোচনা সেমিনার শুক্রবার আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের জোড় ও শেখবাড়ি জামিয়ার মহাসম্মেলন আগামীকাল  হুমকির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ইসলামি দলগুলোর উদ্বেগ আলেম ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিশেষ ধন্যবাদ জানালেন উপদেষ্টা মাহফুজ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালাস পেলেন খালেদা জিয়া আল্লাহকে রাজি-খুশি করতেই চরমোনাই মাহফিল প্রতিষ্ঠা হয়েছে: চরমোনাই পীর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম চাটমোহরে বিস্ফোরক মামলায় দুই আ.লীগ নেতা গ্রেফতার চরমোনাইয়ে চলছে আধ্যাত্মিক মিলন মেলা ঢাকায় চুরি হওয়া ১৩ মোবাইল নোয়াখালীতে উদ্ধার, যুবক গ্রেফতার

অাল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরীর ভাষায় ‘দেওবন্দিয়াত’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

উবায়দুল্লাহ আসআদ
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।
দেওবন্দিয়াত কী? তার আলোচানা পাল্টা আলোচনার যেন শেষ নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আলোচনায় আসে বার বার। গত কয়েক দিন অাগে উম্মুল  মাদারিসখ্যাত ভারতের দারুল  উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস ও সদরুল মুদাররিসীন হজরত আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি দাওরা হাদিসের দরসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওবন্দিয়ত বিষয়ে আলোচনা করেন। আওয়ার ইসলামের পাঠকদরে জন্য তা তুলে ধরা হলো।

হজরত পালনপুরি বলেন, ‘আজ কাল অনেক আলেম জানেনা, এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দ পড়ুয়ারাও জানেনা যে দেওবন্দিয়ত কী?  শুনে রাখো, দেওবন্দ তো এক শহরের নাম।সবাই জানে কিন্তু দেওবন্দিয়াত কী আমাদের জানতে হবে।

তিন বস্তুর নাম দেওবন্দিয়াত
এক. ইহয়ায়ে সুন্নাত। তথা সুন্নাত জীবন্ত করণ।
দুই. ইমহাউল বিদআহ। যাবতীয় বিদআতের মুলোৎপটন।
তিন. তালাক্কি আনিস সালাফ। সালাফে সালেহিন থেকে (দীনের বিষয়) গ্রহণ করা।

ইহয়ায়ে সুন্নাত
শিরক-বিদআতের উর্বর স্থান উপমহাদেশে তাওহীদ-সুন্নাহর পূণ:জীবনে আসলাফ-আকাবীররা প্রতিষ্ঠিত করেন 'দেওবন্দিয়াত মিশন'! এবং এই দেওবন্দিয়াতে না আছে বাড়াবাড়ি না আছে শিথিলতা। কুরআন -সুন্নাহর মোতাবিক যা হবে তাই দেওবন্দিয়াত , কুরআন -সুন্নাহ বিরোধী কিছুরই স্থান নেই দেওবন্দিয়াতে।

ফিকহের মাসায়েল যা সুন্নাহনুযায়ী তারই নাম দেওবন্দিয়াত, এজন্য ফিকহের কত মাসায়েল উলামায়ে দেওবন্দ গ্রহণ করেনি ।কুরআন -সুন্নাহ বিরোধী হওয়ার কারণে।

ইমহাউল বিদআহ
বিদআতের মুলোৎপটন। দেওবন্দিয়াতে কোন ধরণের বিদআত-কুসংস্কারের জায়গা নেই। 'মধ্যপন্থায় থেকে আকাবীররা বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিদআতের আস্ফালন ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হোন, কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আজ আবারো দুই তৃতীয়াংশ বিদআতে গ্রাস হতে চলছে। আমাদের এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।

জেনে রাখো! দেওবন্দিয়াতের তাসাউফে কুরআন-হাদীস বিরোধী কিছুই নেই। আমাদের আগে নির্ধারণ করতে হবে আমাদের তাসাউফ কার তাসাউফ? হুজ্জাতুল ইসলাম  মাওলান কাসেম নানুতাবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীদের না অমুক অমুকের?

হজরত কাসেম নানুতাবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী হলে দেওবন্দি তাসাউফে কোনো ধরণের অভিযোগ উত্তাপিত হবেনা। আর যদি বলি : অমুক-অমুকের তাসাউফ দেওবন্দী তাসাউফ, তাহলে হাজারো অভিযোগ আসবে। যা নিজেদের কিতাবে লেখা আছে। এর জবাব আমাদের দিতে হবে।

তবে অবশ্য আমাদের তাসাউফ হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতাবী,মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীর তাসাউফ। তাঁদের তাসাউফে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কিছুই ছিলনা। এটাই দেওবন্দী তাসাউফ।

দেওবন্দ ও বেরলভীদের মাঝে তাসাউফে কী পার্থক্য আছে?
দেওন্দিয়াত ও বেরলভিয়াতের মধ্য পার্থক্যকারী কয়েকটি মূল বিষয়াদির মধ্য একটি হল 'তাসাউফ'। ওরা পীর-মুরীদীকে ফরজ মনে করে,-তা তাদের বিনা পুঁজীর ব্যবসা - পীরকেই মুক্তির মাধ্যম মনে করে। কিন্তু দেওবন্দিরা শুধু 'মুসতাহাব' মনে করে।

কিন্তু আজ তাসাউফের ক্ষেত্রে অনেক দেওবন্দি দেওবন্দিয়াতে নেই। এক্ষেত্রে তারা বেরলভীদের কোলে উঠে বসে আছে। আজীব, আজ খেলাফত ও মুরীদ বাড়ানোর ধান্ধায়। পীররা দেশ-বিদেশে চাঁদা কালেকশন করে মুরীদের ফ্রি খাওয়ান, যাতে মুরীদ সংখ্যা বাড়ে! অথচ আমাদের আকাবীররা কখনো ফ্রিতে খাওয়ান নি। নিজের ইসলাহ করবে, পীর খাওয়াবে? তা কেমনে?

থানবী রাহিমাহুল্লাহ এর খানকায় ১২মাস লোক থাকত। নিজে খানা-পিনার ব্যবস্থা করেন নি বরং নিজের পকেটের খেয়ে লোক ইসলাহ করতে আসত। এমনি 'খিলাফত'নিও আজ বাড়াবাড়ি চলছে, ভালো মানের এজেন্ট দেখে খিলাফত দেওয়া হয়, এবং একই স্লোগান 'অমুক অমুক সাহেবের খলিফা' এমনকি অনেকে আমার কাছে মুলাকাতের জন্য আসে। সাথে নিয়ে আসে কাউকে। পরিচয়কারী হিশাবে, সে বলনে :তিনি অমুক সাহেবের খলিফা। কিন্তু কোথাকার খিররীজ বা ফারেগ ইত্যাদি বলে পরিচয়দান করেনা। এর মানে কী?

অথচ আমাদের আকাবীর কাসেম নানুতাবী রাহি. কাউকে খেলাফত দেন নি, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহি.মাত্র ৩/৪জনকেই খেলাফত দেন। কিন্তু আজ! আকাবীররা কোনো তালেবে ইলমকে বাইয়াত করেন নি, কিন্তু আজ মুরীদ সংখ্যা বাড়াতে তা অহরহ করা হচ্ছে।

মাজার: দেওবন্দিয়াত ও বেরেওলভিয়াত
দেওবন্দিয়াতকে বেরলভীদের থেকে পার্থক্যকারী আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘মাজার।’  ওরা মাজারকেই সবকিছু মনে করে। আউলিয়াদের পুঁজা করে, সাজদা করে, মানত করে, কবর পাকা করে ইত্যাদি। কিন্তু দেওবন্দিয়াতে এসব কিছুই নেই।

আমি যখন দেওবন্দ থেকে পড়া শোনা শেষ করে যাই, কাসিমী কবরিস্থানে কোনো কবরে 'নেমপ্লেট' ছিলনা। কিন্তু ৪/৫বছর পর যখন উস্তাদ হয়ে আসি, তখন কয়েকটি কবরে প্লেট লেগে যায়। ধীরে ধীরে বহু কবরে লেগে যায়। আজ যত বড় হযরত, তত বড় প্লেট, ধীরে ধীরে আর নতুন কবরের স্থান থাকবেনা!

বেরেলীরা সাজদা করে, আমরা মাথা নত করি। অতিবশীঘ্রই মাথা জমিনে লাগতে শুরু করবে।
আজ হাজারও লোক শুধু মাজারে মাজারে চলছে!

আমার কাছে অনেক আসে, জিজ্ঞেস করি কেন আসলেন? বলে : যিয়ারতে। বলি: যাও মাজারে, এখানে কী? যিয়ারত তো হয় মৃতদের। জীবিতদের হয় তো মুলাকাত। হাদীসে যে আছে,  কবর যিয়ারতে মৃত্যুভয় সৃষ্টি হয়।

এর দ্বারা উদ্দেশ্য : বাপ-দাদা আতত্নীয়দের কবর যিয়ারত করা। পীর-আওলিয়াদের নয়। নিজের বাপ-দাদার কবরে গেলে তো মৃত্যুভয় হয়। চিন্তাশীল হবে ঐ আমার বাবা, দাদা, মা, ভাই শুয়ে আছে, আমিও তো এখানে আসতে হবে।
কিন্তু প্রচলিত পীর-ওলীদের কবরে মৃত্যুভয় দূরের কথা, হাসি-আড্ডা ছাড়া আর কী!

একবার মাওলানা সায়্যিদ আসআদ মাদানী কুদ্দিসা সিররুহু আমাকে নিয়ে 'আজমীর' গেলেন, আমাকে বললেন, সেখানের অবস্থা দেখে কিছুই বলবেন না। গিয়ে আমরা কিছু সুরা কালাম পড়লাম। আমি ৫মিনিট পড়ে আর বরদাস্ত করতে পারিনি। সম্মুখেই লোক সাজদা করছে! কিন্তু মাওলানা নিরব তিলাওয়াত করছেন।

বললাম, মাওলানা 'ইবনে তাইমিয়া যা বলেছেন, এজন্যই তো'?  জবাবে বলেন: 'বাল হুয়া আশাদ্দু মিনহু'। আমাদের আকাবীররা মাজারে গিয়ে দূর থেকে কিছু তিলাওয়াত করে আসতেন। কিন্তু আজকের অবস্থা  তো খুবই করুণ।

কবর জিয়ারতে হাত তুলে দুআ করতে নেই। যদি করতে হয়, কিবলামুখী হয়ে কর।

আমার উস্তাদ আল্লামা ইবরাহীম বলইয়াভী রাহিমাহুল্লাহ। আমি তাঁর খাদীম ছিলাম। মাঝে মধ্যে বলতেন,চল সাঈদ হযরতুল উস্তাদের (মাদানী) যিয়ারত করে আসি। যেতাম তো হযরত কাসেমী কবরিস্থানের গেইটে দাড়িয়ে কিছু তিলাওয়াত করে ফিরে আসতেন।

কেন সামনে বাড়েন না? একদিন জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘সাঈদ!উস্তাদজির কাছে যেতে আমার ভয় লাগে।’ একথা তো লোক দেখানো। যেমনি হাতির দেখানোর দাঁত আলাদা। খাওয়ার আলাদা। আসল কারণ হল  যিয়ারতের নিয়ম এটাই।

মঞ্জুর নু'মানীর বাণী:
হযরত মাওলানা মঞ্জুর নু'মানী রাহি. (সাবেক সদস্য, মজলিসে শুরা দারুল উলুম দেওবন্দ) যিনি প্রস্তাব দিয়ে আমাকে দেওবন্দে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। গভীর সম্পর্ক ছিল। যিনি সারাটা জীবন বেরেলীদের মুখোশউন্মোচে নিজেকে বিলীন করেছিলেন এবং বেরলভী উর্বর 'রায়বেরেলী' থেকে মাসিক পত্রিকা 'আল-ফুরকান' বের করতেন।  আমাকে বলেছিলেন, এখন দেওবন্দ ও বেরেলীদের মধ্য মাত্র আধা হাত পার্থক্য রয়েগেছে। অতিবশীঘ্রই তাও থাকবেনা। আমি বলব, এখন কিছু কিছু দেওবন্দি বেরিলিদের একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে। তাই দীনের ব্যাপারে খুব সতর্ক  হও।প্রকৃত দেওবন্দী হও।

মজলিসে শুরার আবেদন
আমাকে দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিশে শুরা ২বার প্রস্তাব দিয়েছে যে অন্যরা দূরের কথা দারুল উলুমের ফাজিলরাও (খিররীজ) জানেনা যে 'দেওবন্দিয়াত' কী? অতএব আপনি এই মর্মে কিতাব লিখুন। আমি অপারগতা করি যে বর্তমানে আমি "তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআন" লিখছি। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য বিষয়ে লিখতে পারবনা।

তাদেরকে এই জবাব দিই কিন্তু হাতির দেখানোর দাঁত কিছু, খাওয়ার কিছু! যদি লিখি তাহলে সবাই আমার বিরোধী হয়ে যাবে। তবে 'লিখব, মরার আগে ছাপবনা, যেমনি আবুল কালাম আজাদ পাক-ভারত পৃথকতার নেপথ্যে বিষয়ে বই লিখে ২৫বছর পর পাবলিশ করতে ওসিয়ত করে ছিলেন। আমিও লিখব, সন্তানদের ওসিয়ত করেছি, যেন মরার পরে ছাপানো হয়।

তালাক্কি মিনাস সালাফ: 
শুনে রাখ! সালাফ মানে 'সাহাবা,তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন। বাকি সবাই খালাফ। অর্থাৎ সালাফ থেকে ক্যাচ বা গ্রহণ করা। যেমনি বল মাটিতে পড়ার আগে ক্যাচ করলে ময়লামুক্ত থাকে। পড়ে গেলে ময়লাযুক্ত হয়ে হাতও ময়লাটে হয়।

তেমনি সালাফদের থেকে যে ঘটনাবলি ময়লামুক্ত সহীহ সনদে আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে তাই দলীল। তাই মানার যোগ্য।  বাকি সব মশলা মিশ্রিত, মানার যোগ্য নয়।

বাকি অলি-বুযুর্গদের যত ঘটনাবলী এর ৫০% বানোয়াট। বাকি ৫০% লবণ-মসলা মিশ্রিতকরা। শুনে রাখ! ঘটনাবলী দ্বারা আকায়ীদ প্রমাণিত হয়না, বরং আকায়িদ নষ্ট হয়। অতএব: তোমাদের দেওবন্দিয়াত বুঝে, পড়ে গিয়ে বিদআত-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।

সকল সাহাবী নবী সা.এর হাতে ইসলাহী বাইআত হোন নি। যারা হয়েছেন হাদীসে তাঁদের নামের সাথে উল্লেখ্য করা আছে। পীর-মুরীদী সম্পর্কে বিস্তাররীত জানতে 'তুহফাতুল কারী' ১ম খন্ডে পড়ুন।

উপমহাদেশের মাজার নামক পুঁজামন্ডপের কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এমনকি শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী ও তাঁর ৪সন্তানের কবরও রেহাই পায়নি। এমনকি সেখানের বিশাল কবরিস্থানে কোনো জায়গা নেই সবই পাকা। আমি যখন যাই অবস্থা দেখে কাঁদতে থাকি!

এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন, আল-খাইরুল কাসীর শরহে ফাউজুল কবীর,এর শুরুতে, হযরতুল উস্তাদ মুফতি আমীন পালনপুরী দা.এর লিখিত।
الأجوبة الفاضلة للأسئلة العشرة الكاملة .للإمام عبد الحي اللكنو ي رحمه الله تعالى .طبع بتحقيق الشيخ عبد الفتاح أبي غدة الحلبي رحمه الله تعالى من الحلب .السوريا.

দেওবন্দিয়াত কী? আরো দেখতে পারেন,
علماء ہند کا شاندار ماضی ۔میاں صاحب ديوبندي
اور جواہرات فاروقی ۔شہید ملت ضیاء الرحمن فاروقی علیہما الرحمہ

পরিমার্জন: হাওলাদার জহিরুল ইসলাম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ