মুহাম্মদ আবদুর রহমান তামীম
সৌদি আরব থেকে
লেখাটা শুরু করবো ওইসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে যারা উদ্যোক্তা হতে চান। সব মানুষই আসলে উদ্যোক্তা হয়ে জন্ম নেয়। মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন তারা সবাই ছিল এক অর্থে উদ্যোক্তা। তারা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করত, নিজেদের কাজের সংস্থানও করত। এভাবে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমেই মানব ইতিহাসের সূচনা।
সভ্যতার সূচনালগ্নে বেকার বলে কোনো শব্দ ছিল না। কিন্তু সময় যত পেরিয়েছে, আমরা আমাদের সহজাত উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাবকে তত দমিয়ে ফেলেছি। আমরা উদ্যোক্তা থেকে পরিণত হয়েছি শ্রমিকে। আমাদের মগজে পাকাপাকিভাবে এই ধারণা ঢুকে গেছে যে আমাদের চাকরিই করতে হবে।
হোক না মাদরাসা কিংবা কোন এক প্রতিষ্ঠানে। আমি বলছি না চাকরি খারাপ বা নাজায়েজ বিষয়। দেশ ও জাতিকে জান্নাত বা শান্তির পথ দেখাতে চাইলে, আমাদের সর্ব বিষয়ে দীক্ষা অর্জন করে, সব পথে আমাদের প্রবেশ করার বিকল্প নেই।
আমি কথাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম, কারণ উদ্যোক্তারা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আজ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের অধিকাংশই অভিবাসী কিংবা অভিবাসীদের বংশধর। তাদের পূর্বপ্রজন্ম মহাসাগরের ওপার থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একদিন এই নতুন ভূখণ্ডে এসেছিল। আজ অনেক বড় বড় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, তারা তাদের অর্থে বিশ্ব শাসন করার ও মমুসলিম উম্মাহকে গোলামে পরিণত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে।
তারা একদিন অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা ফেলেছিলেন, তাঁদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন বলতে আজ এটিই বোঝায়, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর মেধার সমন্বয়ে নিজের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎকে নিজের হাতে গড়ে তোলা।
আমরা কওমির সন্তানেরা তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল নিয়ে দশ থেকে পনের বছর সময় ব্যয় করেও নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কিংবা কওমির অঙ্গন ব্যতিত অন্য কোন স্থানে নিজেদের মনমানসিকতা তৈরি করতে বেশ ব্যর্থ।
যারা সাফল্যের পথ অতিক্রম করেছেন তারা উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকেই।
উদ্যোক্তারা হলো সেসব হাতেগোনা মানুষ যারা সমাজের প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজেদের পথ নিজেরাই সৃষ্টি করে নেয়। তাঁরা নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং অন্যদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেন। এর সবকিছুই ইসলাম, সমাজকে এগিয়ে নিতে অপরিহার্য।
এখন বেকারত্বের হার কত একটু ভেবে দেখুন। আজ যদি আমাদের মধ্যে আরও অনেক উদ্যোক্তা থাকতেন, আরও নতুন নতুন ব্যবসা গড়ে উঠত। তা হলে বেকারত্ব দূর করা কোনো ব্যাপারই ছিল না।
হ্যাঁ কওমির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকার খুব একটা নেই বললে চলে, তবে যদি কিছুটা দরদ অন্তরে অনুভব করেন তাহলে অন্য পথহারা বেকার ভাইদের কথা ভাবলে বুঝে আসতে পারে, কেন চুরি করে..? কেন খুন করে মানুষ..?
এই আধুনিক সমাজে ব্যবসায় উদ্যোগ শুধু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আর মানুষের কর্মসংস্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উদ্যোগী মনোভাব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আজ প্রায় সব পেশাতেই দরকার। নিঃসন্দেহে এটি একটি নতুন ব্যাপার।
পৃথিবী এখন বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির কল্যাণে যত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা ইসলাম নিয়ে যথেষ্ট গবেষণায় লিপ্ত কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী মহলও ইসলামকে ধ্বংস করায় সময় ব্যয় করছে। যাদের মধ্য থেকে তারা চয়েস করেন বেকার লোকজন।
গত দশকে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ধাপে ধাপে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলত। কর্মক্ষেত্রে তার কাজের একটি নির্দিষ্ট বিভাগ থাকত, ক্যারিয়ারের পথ ছিল সুনির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। যে জায়গাই কাজ করুক না কেন, সে সেই ছকের ভেতরে থেকেই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেত।
পরিশ্রম এবং কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেলে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু বিশ্বায়ন যেখানে প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে, সেখানে তোমাদের মতো তরুণদের ক্যারিয়ার-ভাবনাও বদলে ফেলতে হবে।
আগে ক্যারিয়ার ছিল একটি সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি, এখন তা পরিণত হয়েছে গোলকধাঁধার মতো এক পাহাড়ি এলাকায়। এখানে ওপরে উঠে যেতে হলে আপনাকে কখনো নিচেও নামতে হতে পারে, অনেক চড়াই-উতরাই পাশ কাটিয়ে যেতে হতে পারে বুদ্ধি করে, কখনো কখনো ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিতেও হতে পারে।
আবার সময়ের প্রয়োজনে হয়তো আপনাকে পাহাড়ের পাদদেশে নেমেও আসতে হতে পারে। হয়তো দেখা যাবে পাহাড়ের গা ঘেঁষে তুমি সুন্দর একটা খেলার জায়গা বানিয়ে ফেলেছ! কিছুই আসলে একরকম থাকবে না, কখনো থাকে না। যা আছে তা বদলায়, কখনো বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু তৈরি হয়, কখনো আগে যা ছিল তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
আধুনিক ক্যারিয়ার, যা তরুণদের জন্য অপেক্ষা করছে, তার এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। ইসলামের মধ্যে হীনতা নেই, আর এই পরিবর্তনকেই তোমাদের একমাত্র স্থায়ী ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে। আশপাশের সবকিছুই বদলে যাবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমার দক্ষতা ও সামর্থ্যকেও দ্রুত বদলে ফেলতে হবে।
বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন কৌশল। আর সেই কৌশলটি হলো, উদ্যোক্তাদের মতো চিন্তা করা। বসে বসে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে জীবন পার করে দিলে চলবে না, কাজে নেমে পড়তে হবে। নিজের কাজ, নিজের ক্যারিয়ার নিজেকেই সৃষ্টি করে নিতে হবে।
তরুণদের মধ্যে খুব কমই নিজের ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান শুরু করে, কিন্তু প্রত্যেকেরই উদ্যোক্তাদের মতো চিন্তা করা উচিত। কীভাবে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবে বা নিজের ভেতরে উদ্যোগী-ভাবনা জাগিয়ে তুলবে, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে।
কিন্তু আমার কাছে যদি একটিমাত্র পরামর্শ চাওয়া হয় এ ব্যাপারে তাহলে আমি বলব, নিজের ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করো। তোমার পরিচিতজনেরাই তোমাকে পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
মাথায় রাখতে হবে সবাই মরনশীল কিন্তু এর মাঝে নিজেকে কি করে স্বরণীয় করে রাখবে সেটা তোমারই কাজ।
তোমার নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী হবে, তুমি তত বেশি তথ্য পাবে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাবে। তোমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরাই তোমাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এমনভাবে সাহায্য করবে, যা তুমি হয়তো চিন্তাও করতে পারবে না।
মানুষের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন, সেটা তোমার সফল হওয়ার পেছনে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তোমার নেটওয়ার্ক থেকে তুমি যেমন মূল্যবান তথ্য আর প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারো, তেমনি আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কঠিন চ্যালেঞ্জ, যা তোমার একার পক্ষে কখনোই মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না, তাও তুমি সামাল দিতে পারো।
অনেক অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা আর দুর্যোগকে তুমি এড়িয়ে যেতে পারো, অনেক নতুন সম্ভাবনাও খুঁজে বের করতে পারো, শুধু তোমাকে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
আমিও দাওরা শেষ করার পর নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করেছিলাম, ছাত্র হিসাবে খুব ভালো না হলেও একদম খারাপ ছিলাম না। যদিও আজ আমি স্বদেশ পরিবর্তন কারী, আজো নতুন উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করতে স্বপ্ন দেখি বেশ।
লেখক: ইসলামিক সেন্টার সৌদি আরব দাম্মাম