কাউসার লাবীব: দাওয়াত ও তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. নিজে হক্কানি আলেম ছিলেন এবং আলেমদের সব সময় কদর করতেন। দাওয়াতি কাজে তিনি সব সময় উলামায়ে কেরামের পরামর্শ নিতেন। সেই সঙ্গে তাবলিগ সংশ্লিষ্টদের সব সময় আলেমদের পরামর্শ মেনে চলারও উপদেশ দিতেন। হজরতজির এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
আলেমদের সমালোচনা করা অন্যায়
হজরতজি বলেন, একজন সাধারণ মুসলমানের প্রতিও অকারণে কুধারণা করা ধ্বংস টেনে আনে। আর আলেমদের সমালোচনা তো অত্যন্ত গুরুতর বিষয়।
আরও বলেন, আমাদের তাবলিগের নিয়মে মুসলমানের ইজ্জত ও আলেমদের সম্মান মৌলিক বিষয়। প্রত্যেক মুসলিমকে ইসলামের কারণে সম্মান করা উচিত এবং ইলমের কারণে আলেমদের অনেক সম্মান করা উচিত।
[মালফুজাতে ইলিয়াস রহ. : ৫৬]
মুবাল্লেগগণ ‘আলেম ও আহলে জিকির’ এর সোহবতে উপকৃত হবে
হজরত আরও বলেন, ইলম ও জিকিরের কাজ এখন পর্যন্ত আমাদের মুবাল্লেগদের আয়ত্তে আসেনি। এটি আমাকে অনেক চিন্তিত করে। তা অর্জনের পথ হলো, এদের আলেম ও আহলে জিকিরের কাছে পাঠাতে হবে। তাহলে এরা তাদের তত্ত্বাবধানে তাবলিগ ও করবে এবং তাদের ইলম ও সোহবতে উপকৃতও হবে। [মালফুজাতে ইলিয়াস রহ. : ৫৬]
(যেমন-আমরা ছয় সিফতের ‘ইলম ও জিকিরের সিফতের’ আলোচনায় বলি, ফাযায়েলের ইলম আমরা তালিমের হালকায় বসে শিখি আর মাসায়েলের ইলম আমরা হক্কানি আলেমদের কাছে গিয়ে শিখি।)
হজরত থানভি রহ. অনেক বড় কাজ করেছেন
হজরত মাওলানা থানভি রহ. এর সঙ্গে হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সে কারণেই তিনি থানভি রহ. এর শিক্ষা ব্যাপক করতে চাইতেন।
তিনি একবার বলেন, হজরত মাওলানা থানভি রহ. অনেক বড় কাজ করেছেন। আমার মনে চায়, শিক্ষা তো হজরত থানভি রহ. এর হবে। কিন্তু তাবলিগ পদ্ধতি হবে আমার। এতে তার শিক্ষা প্রসার লাভ করবে।
[মালফুজাতে ইলিয়াস রহ. : ৫৮]
হজরত থানভি রহ. এর সাথীবর্গ ও তার কিতাবসমূহ দ্বারা উপকৃত হওয়া
হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. ‘মেওয়াতের সাথীদের’ একটি চিঠি লিখে কিছু বিষয়ে উপদেশ দিলেন। সেই চিঠিতে এটিও ছিল-
“হযরত থানভি রহ. এর জন্য ‘ইছালে সওয়াবের’ অনেক ইহতিমাম করবে। সব রকমের নেক কাজ দ্বারা তাকে সওয়াব পৌঁছাবে। বেশি পরিমাণে কুরআন শরিফ খতম করবে। সবাই এক স্থানে জড়ো হয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। বরং সবাই একাএকাভাবে পড়াই অতি উত্তম। তাবলিগে বের হওয়ার সওয়াব সবচেয়ে বেশি। এ জন্যে এভাবে সওয়াব বেশি করে পৌঁছাবে।
তিনি চিঠিতে আরও লিখেন, হজরত থানভি রহ. থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য প্রয়োজন তার মুহাব্বত থাকা এবং তার সাথীদৃন্দ ও তার রচনাবলির মোতালাআ বা অধ্যয়ন করে উপকৃত হওয়া। তার কিতাবগুলো পড়ার দ্বারা ইলম আসবে এবং তার সাথীদের দ্বারা আসবে আমল। [মাকাতিবে ইলিয়াস রহ. : ১৩৭-১৩৮]
(মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর এসব বাণী দ্বারা ভালোভাবে বুঝা যায়, হক্কানি আলেমগণ ও মাশায়েখের কিতাব পড়া উপকার থেকে খালি নয়।)
উম্মতের যে সকল শ্রেণি বা মহল দীনি আখলাক থেকে বহু দূরে সরে গেছে তাদেরও হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. উপেক্ষা করতে চাইতেন না একারণেই জনসাধারণ ও ওলামায়ে কেরামের সম্পর্কহীনতা ও দূরত্ব কিছুতেই তার বরদাশত হতো না।
এটাকে তিনি উম্মতের বিরাট দুর্ভাগ্য, ইসলামের ভবিষ্যতের জন্য বিরাট খাতরা (ক্ষতি) এবং ধর্মহীনতা ও ধর্মদ্রোহীতার পূর্বলক্ষণ মনে করতেন। মাওলানা তার দাওয়াতি মেহনতের বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন। (এবং কিছু সুলক্ষণও ফুটে ওঠেছিল) যে, এ কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনসাধারণ ও ওলামায়ে কেরাম পরস্পর কাছাকাছি হতে পারবেন এবং এক অপরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারবেন।
মাওলানা একদিকে ওলামায়ে কেরামকে দাওয়াতের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে যাওয়ার এবং জনসাধারণের প্রতি দরদি হওয়ার তাগিদ করেতেন। অন্যদিকে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতেন, যেন তারা ওলামায়ে কেরামের কদর ও মর্যাদা বুঝে এবং উসুল আদব রক্ষা করে তাদের খেদমতে হাজির হয় এবং প্রয়োজনীয় ইলম হাসিল করে।
তাদের তিনি ওলামায়ে কেরামের জেয়ারত ও মোলাকাতের সওয়াব এবং তাদের খেদমতে হাজির হওয়ার উসুল আদব শেখাতেন। ওলামায়ে কেরামকে দাওয়াত দেওয়ার , তাদের থেকে ফায়দা হাসিল করার এবং তাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার হেকমত ও তরিকা বলতেন।
ওলামায়ে কেরামের কোনও কথা বা কাজ বুঝে না এলে তার সুব্যাখ্যা গ্রহণ, সুধারণা পোষণের অভ্যাস তাদের মাঝে গড়ে তুলতেন। তাদের তিনি ওলামায়ে কেরামের খেদমত পাঠাতেন এবং ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করতেন, কীভাবে গিয়েছো? কী করেছো? কী বলেছো? ইত্যাদি।
তারপর প্রয়োজনে তাদের (আপত্তিকর ) সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়ার সংশোধন করতেন এভাবে বণিক শ্রেণিকেও ওলামায়ে কেরামের এতো কাছে নিয়ে এসেছিলেন, বিগত বহু বছরে (সম্ভবত খেলাফত আন্দোলনের পরে) এমনটি কখনও দেখা যায়নি।
হজরতজি মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী রহ. সম্পর্কে ১০ তথ্য
অন্তর্দর্শী ওলামায়ে হকের খেদমতে তার প্রতি সংশোধনের সজাগ দৃষ্টি রাখার সকাতর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলতেন, আমার মধ্যে অহংকার বা আত্মতুষ্টির লেশ যদি ধরা পড়ে তাহলে আমাকে সতর্ক করুন।
শাইখুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. এবং মাজাহিরুল উলুম মাদরাসার শিক্ষাসচিব মাওলানা হাফেজ আব্দুল লতিফ সাহেবকে এক পত্রে লিখেন-
প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় হযরত শাইখুল হাদিস এবং মোহতারাম শিক্ষাসচিব, আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
আশা করি কুশলেই আছেন। রমজানপূর্ব সময়ে অন্তরে একটা বিষয়ের খুবই গুরুত্ব ছিল। কিন্তু নিজের মানবীয় ও ইমানি দুর্বলতার কারণে তা একবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা এই যে, আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে বর্তমানে কাজের উত্তরোত্তর উন্নতি ও জনপ্রিতার এতো ব্যাপকতা দেখে নিজের প্রতি আমি খুবই শঙ্কাগ্রস্ত। কে জানে কখন এ দুষ্ট নফস অহংকার ও আত্মতুষ্টির শিকার হয়ে পড়ে।
সুতরাং আমি আপনার মতো হক্কানি আলেমদের কঠোর শাসন ও নেগরানির ভীষণ মুখাপেক্ষী। আপনারাও আমাকে আপনাদের সার্বক্ষনিক নেগরানির মুহতাজ মনে করবেন। কাজের কল্যাণের বিষয়ে দৃঢ় থাকার এবং অকল্যাণকর বিষয় পরিহার করার জন্য আমাকে কঠোরভাবে তাগিদ করবেন।
[২২ রমজান ৬২হিজরি, ২৩ সেপ্টেম্বর ৪৩ ইংরেজি]
মুফতি কেফায়েতুল্লাহ রহ. মাওলানা থানভী রহ. মাওলানা মাদানি রহ. মাওলানা রায়পুরী রহ. সাহারানপুরী রহ. সকলের সঙ্গে মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর গভীর সম্পর্ক ছিল। বড় বড় আকাবিরের খেদতে দীনি বিষয়ে হাজিরা দেওয়া ইলিয়াস রহ. এর জীবনের মামুল (অভ্যাস) ছিল।
দ্বীনি কাজে পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও মহব্বত
তাবলিগের মেহনত শুরুর আগেও যেমন এটা ছিল , কাজ শুরু করার সময়ও তা ছিল। বরং তখন তো তিনি বারবার দেওবন্দ ছুটে যেতেন।
তাদের অনুমতি ও দোয়া নিয়েই এই মেহনতকে আবার চালু করেন। কাজ শুরু করার পরও বারবার বড় বড় ওলামা হযরতদের কাজের কারগুজারি শোনাতেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নিতেন। বড়দের নিজামুদ্দীনেও বারবার নিয়ে যেতেন এবং কাজের বাস্তব চিত্র দেখিয়ে দিকনির্দেশনা নেওয়ার চেষ্টা করতেন।
হযরত বলতেন- “আলেমদের বলতে হবে তাবলিগ জামাতের চলাফেরা ও চেষ্টা সাধনার দ্বারা সাধারণের মাঝে শুধু দীনের মর্যাদা ও আগ্রহ তৈরি করা যায় এবং তাদের দীন শেখার জন্য উৎসাহী করা যায়। ভবিষ্যতে দীনের তালিম ও তারবিয়তের কাজ আলেম ও সালেহদের সুদৃষ্টির দ্বারাই হতে পারে। এজন্য আলেমদের সুদৃষ্টি বা নেক নজর খুবই প্রয়োজন।” [মালফুজাতে ইলিয়াস রহ. : ১৭০]
মাওলানা ইলিয়াস রহ. মুফতি কেফায়েতুল্লাহসহ ওই সময়ের বড় বড় আলেমদের কাছে কাজের উসূলের বিষয়ে বারবার ছুটে গিয়েছেন। দারুল উলুম দেওবন্দে হাজির হয়ে ছয়টি গুণের কথা যখন প্রস্তাব করেন, তখন একটি গুণ ছিল, ‘একরামুল ওলামা’।
মুফতি কেফায়েতুল্লাহ রহ. দেখেশুনে বললেন, ইলিয়াস! তুমি ‘একরামুল ওলামার’ পরিবর্তে ‘একরামুল মুসলিমিন’ রাখো। এতে বেশি ফায়দা হবে। ইলিয়াস রহ. আনন্দচিত্তে তা গ্রহণ করে নিলেন। তখন মুফতি সাহেব নিজ হাতে ‘একরামুল ওলামা’ কেটে ‘একরামুল মুসলিমিন’ রেখে দিলেন।
[সুত্র: মুফতি হাবিবুর রহমান খায়রাবাদী , প্রধান মুফতি- দারুল উলুম দেওবন্দ] (দাওয়াতের মেহনত ও তবলীগের মুরুব্বিদের ভারসাম্যপূর্ণ আমল গ্রন্থ থেকে)
কাউসার লাবীব: শিক্ষার্থী আওয়ার ইসলাম সাংবাদিকতা বিভাগ