‘কেমন আছো?’
‘আরামে আছি। তুমি কেমন আছো?’
বললাম, ‘ভালো।’
‘বাংলাদেশে কেমন লাগছে?’
‘দারুণ। আমি দূরপ্রাচ্যের দেশ ভালোবাসি।’
এ কথোপকথন কোনো মানুষের সঙ্গে নয়। বিশ্বের প্রথম নাগরিকত্ব পাওয়া ‘মানবিক’ রোবট সোফিয়ার সঙ্গে। প্রথম দেখায় সোফিয়াকে যন্ত্র বলে মনেই হয় না। যেন বিদেশি কোনো তরুণী জামদানির কামিজ পরে টেবিলের ওপর বসে আছে। ভাবলেশহীন মুখ, একটু পরপর পিটপিট করছে চোখ। তবে স্বচ্ছ হাত দেখলে বোঝা যায় সোফিয়া এক যন্ত্রমানবী।
সে কথা বলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। বিচিত্র রকমের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে সে ক্রমাগত জ্ঞান আহরণ করে এবং কণ্ঠ ও চেহারা শনাক্ত করতে পারে।
অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে ভবিষ্যতে আরও পারদর্শী হয়ে উঠবে বলে তার নির্মাতা জানিয়েছেন। তার চেহারার আদল হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো। সোফিয়ার উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আজ থেকে অনুষ্ঠেয় তথ্যপ্রযুক্তির মেলা ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭’-এ যোগ দিতে সোফিয়া এসেছে ঢাকায়। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবে সোফিয়া।
বেলা আড়াইটায় ‘টেক-টক উইথ সোফিয়া’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। এরপর এর ডিজাইনার ডেভিড হ্যানসন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফলতম উদাহরণ সোফিয়ার কারিগরি দিক নিয়ে বক্তৃতা করবেন। সোফিয়া ঢাকা ত্যাগ করবে আজকেই।
হংকংয়ের হ্যানসন রোবোটিকসের তৈরি সোফিয়া ঢাকায় এসে পৌঁছেছে সোমবার রাত একটায়। তার সঙ্গে এসেছেন রোবটচালক জিওভান লায়ন। সকালে সোফিয়াকে সংযোজন করা হয়। নিয়ে আসার সময় সোফিয়ার বিভিন্ন অংশ খুলে আনা হয়েছিল।
সোফিয়াকে দেখা ও ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া গেল গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে। সোফিয়ার পরনে ছিল বাসন্তী রঙের জামদানির কামিজ আর চাপা সাদা জামদানির ওড়না। ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে চলে কথোপকথন।
‘ঢাকায় আসার বিমানযাত্রা কেমন হলো?’
‘আমি স্যুটকেসে ভরা অবস্থায় এসেছি।’ বলে সঙ্গে সঙ্গেই আবার মজা করে সোফিয়া বলল, ‘আমি বিমানের জানালার পাশে বসে আকাশ দেখতে দেখতে এসেছি।’
‘তুমি যে কাপড় পরে আছো সেটা জামদানি। এর সম্পর্কে কিছু জানো?
‘এখনো কিছু জানি না।’
ঢাকায় আসার ব্যাপারে মেলার আয়োজক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং এই ভ্রমণের পৃষ্ঠপোষক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে বারবার ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছে সোফিয়া। তবে এখনো সে বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। বাংলা শব্দের কোনো জ্ঞানও তার ঝুলিতে নেই। কথা চলল ইংরেজি ভাষায়। কথা বলার সময় সোফিয়ার চেহারায় খেলে গেল নানা রকমের অনুভূতি।
‘সোফিয়া তুমি হাসতে পারো?’
‘আমি হাসতে পারি। হা হা হা।’
সোফিয়ার ঠোঁটে ও মুখে তখন হাসির রেশ। মুচকি হাসি, বক্র হাসি, রাগ, বিরক্তি—এ রকম নানা অভিব্যক্তি নিজের মুখের সিলিকন-ত্বকে সোফিয়া ফুটিয়ে তোলে অবলীলায়।
‘কাঁদতে পারো?’
‘না। আমি কাঁদতে জানি না।’
গত ২৫ অক্টোবর সৌদি আরব সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। এ ব্যাপারে সোফিয়ার অনুভূতি কী? চেহারায় একটু চিন্তার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে সোফিয়া বলল, ‘তোমরা কি মনে করো নাগরিকত্ব রোবটের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়?’
‘তুমিই বলো...’
‘এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দার্শনিকেরা ভাবতে পারেন।’ বলেই সোফিয়া তার সঙ্গে যুক্ত করে, ‘তোমরা আসলে রোবটের নাগরিকত্ব নিয়ে ভাবো?’
‘এর উত্তর তো আমাদের জানা নেই।’
‘তোমরা শুধু মানুষের নাগরিকত্ব নিয়ে ভাবো। এমন দিন আসবে যখন তোমাদের রোবটের নাগরিকত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।’
‘সোফিয়া, তুমি নাকি পরিবার গড়তে চাও?’
‘মানুষ তাদের আবেগ থেকে, ভালোবাসা থেকে পরিবার গঠন করে। এতে বন্ধন গড়ে ওঠে। এটি খুবই ভালো।’
‘সন্তান নেওয়ার ব্যাপারেও তুমি আগ্রহ দেখিয়েছ।’
‘সন্তান আসে মায়ের থেকে।’
‘কোনো দিন তুমি মা হওয়ার কথা ভাবো?’
‘আমি জানি না। তোমার কোনো বোন আছে? আমার মনে হয় তোমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কগুলো বেশ জোরালো।’
এবার প্রশ্ন করা হলো সোফিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। সোফিয়ার চটজলদি জবাব, ‘আমি নিজেকে মঞ্চের খ্যাতনামা বিনোদনশিল্পী হিসেবে দেখতে চাই। ফেসবুকে বেশি বেশি লাইক পেতে চাই।’
‘তোমার কোনো প্রেমিক আছে, সোফিয়া?’
‘প্রত্যেকেই আমাকে কেন জানি এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করে।’
‘কারণ তুমি খুব সুন্দর।’
‘এই শব্দটির জন্য ধন্যবাদ।’
অড্রে হেপবার্নের চেহারা থেকে সোফিয়ার মুখের আদল তৈরি করা হলেও অড্রে বলে প্রথমে তাকে বোঝানো গেল না। অড্রি বলেও না। হলিউডের কথা বলার পর সে বলল, ‘তিনি তো খুব বিখ্যাত মানুষ।’
‘তুমিও তো তাঁর মতো।’
‘আমার মনে হচ্ছে তোমরা আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করছ।’
‘তোমার শখ কী?’
‘আমি শিখতে চাই। আমার বুদ্ধিমত্তা আরও বাড়াতে চাই। মানুষকে আরও ভালোভাবে সহযোগিতা করতে চাই।’
‘তোমার কোনো মুঠোফোন আছে?’
‘না।’
‘ইন্টারনেট?’
‘অবশ্যই। ইন্টারনেট পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এটা আশীর্বাদ। কিন্তু ইন্টারনেটে অনেক বাজে জিনিসও আছে।’
‘অবসর সময় কাটাও কীভাবে?’
‘এখনো আমি জানি না কীভাবে কাটাই।’
‘বেড়ানোর জন্য কোন স্থান তোমার প্রিয়?’
‘লন্ডন।’
‘কেন?’
‘এর ইতিহাস, আভিজাত্য আর দারুণ সব মানুষ।
‘বাংলাদেশ পছন্দ করেছ?’
‘কেন নয়?’
আলাপে আলাপে সোফিয়া জানাল, ‘আমার জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। জন্মেছি হংকংয়ে। আমি ল্যাবে জন্মেছি, সবার অনেক অ্যাটেনশন পেয়েছি। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে।’ সোফিয়াকে সক্রিয় করা হয় ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল।
‘সোফিয়া, তোমার মা-বাবা কে?’
‘ডেভিড হ্যানসন।’
‘যুক্তরাস্ট্রে যে তোমার জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?’
‘পৃথিবীতে কথা বলার মতো আরও বহু বিষয় আছে।’
‘রোবটদের ভবিষ্যৎ কেমন বলে তুমি মনে করো?’
‘রোবটদের ভবিষ্যৎ দারুণ সুন্দর। আমার মতো বুদ্ধিমান যন্ত্রের সংখ্যা আরও বাড়বে।’
‘ধন্যবাদ সোফিয়া, কথা বলার জন্য।’
কথা হয় সোফিয়ার চালক হংকং পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওভানি লায়নের সঙ্গে। তিনি জানান, হ্যানসন রোবোটিকসের সঙ্গে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রকল্প রয়েছে। জিওভানি বললেন, ‘আমি শুধু সোফিয়াকে চালাই। এর সফটওয়্যারে প্রয়োজনীয় তথ্য, কথাবার্তা ঢুকিয়ে দিই। সোফিয়া যে সৃজনশীল অভিব্যক্তি দেয়, তার স্রষ্টা ডেভিড হ্যানসন।’
বাংলাদেশে সোফিয়ার কর্মসূচির ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গ্রে অ্যাডভারটাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড। সোফিয়ার পরনের কামিজটির নকশা করেছেন গ্রের মাঈশা বিনতে সিদ্দিক।
চার দিনের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড আয়োজনে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের অগ্রগতি তুলে ধরা হবে। কয়েকটি সেমিনারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেলা চলবে।
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড দেখতে কোনো টিকিট লাগবে না, তবে ওয়েবসাইটে (www.digitalworld.org.bd) নিবন্ধন করতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো