দুআ অনেক বড় আমল, এমনকি হাদীস শরীফে এসেছে যে, ‘দুআই ইবাদত।’ এই দুআ যেমন একা একা করা যায় তেমনি সম্মিলিতভাবেও করা যায়। শরীয়ত যেখানে কোনো একটি পন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে ওইভাবে দুআ করতে হবে- একা হলে একা এবং সম্মিলিতভাবে হলে সম্মিলিতভাবে।
কিন্তু শরীয়ত যেখানে কোনো একটি পন্থা নির্দিষ্ট করেনি সেখানে উভয় পন্থাই মুবাহ। বিনা দলীলে কোনো একটিকে যেমন নাজায়েয বলা যায় না তেমনি সুন্নত বা জরুরিও বলা যায় না। এধরনের ক্ষেত্রে উভয় পন্থাই মুবাহ ও দুআকারীর ইচ্ছাধীন থাকে।
উল্লেখ্য, সম্মিলিত দুআ দুইভাবে হতে পারে। এক. সমবেত লোকদের মধ্যে একজন দুআ করবে এবং অন্যরা আমীন বলবে। দুই. একস্থানে সমবেত হয়ে সবাই দুআ করবে, প্রত্যেকে নিজে নিজে দুআ করবে। এই উভয় ছুরত জায়েয।
এছাড়া, সমবেত হওয়ারও দুই ছুরত হতে পারে। শুধু দুআর উদ্দেশ্যেই সমবেত হওয়া কিংবা কোনো দ্বীনি বা দুনিয়াবী কাজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে মজলিসের শুরু বা শেষে সম্মিলিতভাবে দুআ করা। এই দুই ছুরতই জায়েয। তবে কোথাও যদি কোনো শরয়ী সমস্যা যুক্ত হয় তবে তার হুকুম ভিন্ন। এই সংক্ষিপ্ত মৌলিক আলোচনার পর শরীয়তের দলীলসমূহে সম্মিলিত দুআর সূত্র লক্ষ্য করুন।
এক
প্রথম কথা তো হল, শরীয়তে সম্মিলিত দুআর এমন কিছু ক্ষেত্র বিদ্যমান রয়েছে যা একেবারেই সুস্পষ্ট এবং যে বিষয়ে দ্বিমতের কোনোই অবকাশ নেই। যেমন-
(ক)
জামাতের নামাযের জাহরী (স্বশব্দে) কিরাআতে ইমাম যখন সূরা ফাতিহা সমাপ্ত করেন তো সবাই ‘আমীন’ বলে। নামাযে সূরা ফাতিহা মূলত কিরাআত হিসেবে পড়া হলেও তা একই সঙ্গে দুআও বটে। এজন্যই তা সমাপ্ত হওয়ার পর আমীন বলা সুন্নত। একই কারণে সূরা ফাতিহার অপর নাম ‘দুআউল মাসআলাহ।’
(খ)
জানাযার নামায একদিকে যেমন নামায অন্যদিকে তা দুআও বটে। জানাযার নামাযের মূলকথা হচ্ছে দুআ। এই নামাযও জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় এবং তৃতীয় তাকবীরের পর ইমাম-মুকতাদী সবাই একসঙ্গে মাইয়্যেতের জন্য দুআ করে।
(গ)
অনাবৃষ্টি দেখা দিলে এবং প্রয়োজন সত্ত্বেও যথারীতি বৃষ্টি না হলে শরীয়তে ‘ইস্তিসকা’র (অর্থাৎ আল্লাহর কাছে রহমতের বৃষ্টি কামনা করার) নির্দেশ এসেছে। ‘ইস্তিসকা’র বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। একটি পদ্ধতি এই যে, সবাই সম্মিলিতভাবে দুআ করবে। যেমন সহীহ বুখারীতে আনাস রা.-এর বর্ণনা এসেছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টির জন্য উভয় হাত উঠিয়ে দোয়া করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে উপস্থিত সকলে হাত উঠিয়ে দোয়া করেছেন।-সহীহ বুখারী
(ঘ)
জুমা ও দুই ঈদের খুৎবায় খতীব দুআ করেন এবং শ্রোতাগণ মনে মনে আমীন বলেন। সম্মিলিত দুআর এই পদ্ধতিও সব জায়গায় প্রচলিত রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত ‘ইস্তিগফার’ এর মাধ্যমে খুৎবা সমাপ্ত করতেন (মারাসীলে আবু দাউদ; যাদুল মাআদ ১/১৭৯)
দুই
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
قَالَ قَدْ اُجِیْبَتْ دَّعْوَتُكُمَا
‘তোমাদের দুজনের দুআ কবুল করা হয়েছে।’
এ আয়াতে ‘তোমাদের দুই জনের দুআ’ বলতে মুসা আ. ও হারূন আ. এর দুআ বোঝানো হয়েছে। একাধিক সাহাবী ও বেশ কয়েকজন তাবেঈ ইমামের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত মুসা আ. দুআ করেছেন এবং হারূন আ. আমীন বলেছেন। একেই আল্লাহ তাআলা ‘দুইজনের দুআ’ বলেছেন।
(তাফসীরে ইবনে কাছীর ২/৪৭০; আদ্দুররুল মানছূর ৩/৩১৫)
তো এটা তাঁদের দু’জনের সম্মিলিত দুআ ছিল, যা আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন এবং খোশখবরী শুনিয়েছেন যে- ‘তোমাদের দু’জনের দুআ কবুল করা হয়েছে।’
তিন
সাহাবিয়ে রাসূল হযরত হাবীব ইবনে মাসলামা আলফিহরী রা., যিনি বড় ‘মুস্তাজাবুদ দাওয়াহ’ ছিলেন, একবার তাকে একটি বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করা হয়। তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি সমাপ্ত করার পর যখন যুদ্ধের সময় নিকটবর্তী হল তখন সহযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বললেন-
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : لَا يَجْتَمِعُ مَلَأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ إِلَّا أَجَابَهُمُ اللَّهُ
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কিছু মানুষ যখন কোথাও একত্র হয়ে এভাবে দুআ করে যে, একজন দুআ করে এবং অন্যরা আমীন বলে তো আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাদের দুআ কবুল করেন।’
এই হাদীস বয়ান করে তিনি আল্লাহ তাআলার হামদ ও ছানা করলেন এবং দুআ করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর দুআর একটি অংশ এই ছিল-
اللَّهُمَّ احْقِنْ دِمَاءَنَا وَاجْعَلْ أُجُورَنَا أُجُورَ الشُّهَدَاءِ
‘ইয়া আল্লাহ, আমাদের প্রাণ রক্ষা করুন এবং আমাদেরকে শহীদদের সমতুল্য ছওয়াব দান করুন।’
তাঁরা সবাই দুআতেই মশগুলে ছিলেন ইতোমধ্যে রোমক বাহিনীর সেনাপতি (অস্ত্র ত্যাগ করে) হাবীব ইবনে মাসলামা রা-এর তাবুতে এসে উপস্থিত হল।-মুজামে কাবীর, তাবরানী ৪/২৬; মুসতাদরাকে হাকেম ৩/৩৪৭
বর্ণনাটির সম্পূর্ণ আরবী পাঠ নিম্নরূপ :
عَنْ حَبِيبِ بن مَسْلَمَةَ الْفِهْرِيُّ وَكَانَ مُسْتَجَابًا أَنَّهُ أُمِّرَ عَلَى جَيْشٍ فَدَرَّبَ الدُّرُوبَ، فَلَمَّا لَقِيَ الْعَدُوَّ، قَالَ لِلنَّاسِ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ : لا يَجْتَمِعُ مَلأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ إِلا أَجَابَهُمُ اللَّهُ، ثُمَّ إِنَّهُ حَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ، فَقَالَ : اللَّهُمَّ احْقِنْ دِمَاءَنَا وَاجْعَلْ أُجُورَنَا أُجُورَ الشُّهَدَاءِ، فَبَيْنَمَا عَلَى ذَلِكَ إِذْ نَزَلَ الْهِنْبَاطُ أَمِيرُ الْعَدُوِّ،فَدَخَلَ عَلَى حَبِيبٍ سُرَادِقَهُ.
رواه الطبراني في الكبير والحكم في المستدرك، والراوي عن ابن لهيعة أبو عبد الرحمن المقري، وهو أحد العبادلة الذين تعد روايتهم عن ابن لهيعة صحيحة.
এই রেওয়ায়েতের সনদ কম করে হলেও ‘হাসান’ পর্যায়ের।
প্রশ্ন এই যে, সম্মিলিত দুআর ভিত্তি প্রমাণের জন্য এরচেয়ে স্পষ্ট বর্ণনার প্রয়োজন আছে কি?
চার
ইতিহাসে ‘আলা আলহাযরামী রা-এর ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। বাহরাইনের মুরতাদদের সঙ্গে ১১ হিজরীতে যে লড়াই হয়েছিল তাতে তিনি সিপাহসালার ছিলেন।
সেই অভিযানের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা এই যে, মুসলিম বাহিনী একস্থানে যাত্রাবিরতি করতেই কাফেলার সকল উট রসদপত্রসহ পলায়ন করল। একটি উটও পাকড়াও করা গেল না। অবস্থা এই দাড়াল যে, পরনের কাপড় ছাড়া কোনো রসদ কাফেলার সঙ্গে রইল না। সবার পেরেশান অবস্থা।
‘আলা আলহাযরামী রা. ঘোষকের মাধ্যমে সবাইকে একত্র করলেন এবং শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘তোমরা মুসলমান, আল্লাহর রাস্তায় আছ তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী।
অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে সহায়-সঙ্গী বিহীন অবস্থায় ত্যাগ করবেন না।’ ইতোমধ্যে ফজরের আযান হল। তিনি নামাযে ইমামতি করলেন। নামাযের পর দোজানু হয়ে বসে অত্যন্ত বিনয় ও কাতরতার সঙ্গে দুআয় মশগুল হয়ে গেলেন। কাফেলার সবাই দুআ করতে লাগল। এ অবস্থায় সূর্য উদিত হল, কিন্তু তারা দুআয় মশগুল রইলেন।
একপর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তাদের সন্নিকটে একটি বড় জলাশয় সৃষ্টি করে দিলেন। সবাই সেখানে গেলেন, তৃষ্ণা নিবারণ করলেন এবং গোসল করলেন। বেলা কিছু চড়ার পর একে একে সকল উট সমস্ত রসদসহ ফিরে আসতে লাগল।
হাদীস ও তারীখের ইমাম ইবনে কাছীর রাহ. বলেন, এটা ওই লড়াইয়ের অনেকগুলো অলৌকিক ঘটনার একটি, যা লোকেরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে।
আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরবী ইবারতটুকু তুলে দিচ্ছি :
فلما قضا الصلاة جثا على ركبتيه وجثا الناس، ونصب في الدعاء ورفع يديه وفعل الناس مثله …
দেখুন, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৫/৩৪; তারীখে তাবারী ২/৫২৩
মোটকথা, শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্মিলিত দুআর প্রমাণ-সিদ্ধতা একটি স্পষ্ট বিষয়। এসম্পর্কে অতিরিক্ত দলীল-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সম্মিলিত দোয়া সম্পর্কে আরো হাদীস জানতে হলে শায়েখ আব্দুল হাফিজ মাক্কী সংকলিত ‘ইসতিহবাবুদ দোয়া বা‘দাল ফারাইয’ কিতাবটি (পৃ. ৬৮-৭৯) দেখা যেতে পারে।
প্রশ্নোক্ত বর্ণনা দু’টির স্বরূপ
প্রশ্নে আপনি জামেয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারার ওই ফাযেলের উদ্ধৃতিতে দু’টি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি সম্মিলিত দুআর ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
প্রথম বর্ণনা : একবার ইস্তিসকার সময় হযরত উমর রা. হযরত আববাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা.কে দুআর জন্য অসীলা বানিয়েছিলেন। তিনি সেসময় একা দুআ করেন, সম্মিলিতভাবে নয়।
লক্ষ্য করুন, যদি এই রেওয়ায়েত সঠিকও ধরে নেওয়া হয় তাহলে এর মাধ্যমে শুধু একা দুআর বৈধতা প্রমাণ হতে পারে অথবা খুব বেশি হলে এটুকু যে, দুআ জামাতের সঙ্গে হওয়া অপরিহার্য নয়, একাকীও হতে পারে। কিন্তু এ বর্ণনা থেকে সম্মিলিত দুআ নিষেধ-এটা কীভাবে বোঝা গেল?!
এরপর মজার বিষয় এই যে, সে সময় হযরত আববাস রা. একা দুআ করেছিলেন- এ কথাটাই বানানো। হযরত আববাস রা-এর ওই দুআ সম্মিলিত দুআই ছিল।
সহীহ বুখারী ও তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে পূর্ণ ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যার সারাংশ এই যে, লোকেরা বৃষ্টির জন্য দুআর উদ্দেশ্যে একত্র হল। হযরত উমর রা. খুৎবা দিলেন এবং বললেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তার চাচা) আববাসকে পিতার মতো মনে করতেন।
অতএব, তোমরা তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ কর এবং তাঁকে আল্লাহর দরবারে অসীলা বানাও।
এরপর হযরত আববাস রা. ও উপস্থিত সবাই দুআ করতে আরম্ভ করেন। হযরত আববাস রা-এর দুআ এই ছিল-
اللَّهُمَّ إِنَّهُ لَمْ يَنْزِلْ بَلَاءٌ مِنَ السَّمَاءِ إِلَّا بِذَنْبٍ، وَلَمْ يَكْشِفْ إِلَّا بِتَوْبَةٍ، وَقَدْ تَوَجَّهَ الْقَوْمُ بِي إِلَيْكَ لِمَكَانِي مِنْ نَبِيِّكَ، وَهَذِهِ أَيْدِينَا إِلَيْكَ بِالذُّنُوبِ وَنَوَاصِينَا إِلَيْكَ بِالتَّوْبَةِ، فَاسْقِنَا الْغَيْثَ.
সবাই দুআয় মশগুল ছিলেন। ইতোমধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি হতে আরম্ভ করে। (ফাতহুল বারী ২/৫৭৭ কিতাবুল ইস্তিসকা)
দুআটির তরজমা এই, ‘ইয়া আল্লাহ, গুনাহর কারণে বিপদাপদ আসে আর তাওবার মাধ্যমেই তা দূর হয়। যেহেতু আপনার নবীর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ আছে এজন্য সবাই আমাকে অসীলা বানিয়ে আপনার দয়ার ভিখারী হয়েছে। আমাদের গুনাহগার হাতগুলো আপনার দরবারে উত্তোলিত রয়েছে আর আমাদের কপাল তওবার সঙ্গে আনত রয়েছে। বৃষ্টির মাধ্যমে আপনি আমাদের ফরিয়াদ কবুল করুন।’
পাঠকবৃন্দই বলুন, এই দুআ সম্মিলিত ছিল না একাকী? তাছাড়া এ বিষয়ে তাবাকাতে ইবনে সাআদ : -এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, সে দোয়ায় ওমর রা. এবং সকল মানুষ হাত উঠিয়ে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে কেঁদেছিলেন।
দ্বিতীয় বর্ণনা : আপনি বলেছেন যে, দ্বিতীয় রেওয়ায়েত তিনি মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা (হাদীস ৬২৪২)-এর উদ্ধৃতিতে লিখেছেন, কিন্তু মুসান্নাফের কোনো এডিশনেই উপরোক্ত নম্বরে এমন কোনো রেওয়ায়েত নেই। তদ্রূপ মুসান্নাফের অন্য কোনো স্থানেও আমরা ওই বর্ণনা পাইনি।
তবে মুসান্নাফের ২৬৭১৫ নম্বরে (নতুন সংস্করণ) একটি রেওয়ায়েত আছে, সম্ভবত লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে তা বিকৃত করে উল্লেখ করেছেন, কেননা, সম্মিলিত দুআর সঙ্গে ওই বর্ণনার কোনো সম্পর্ক নেই। পূর্ণ বর্ণনা নিম্নে উদ্ধৃত হল-
عن أبي عثمان قال : كتب عامل لعمر بن الخطاب رضي الله عنه إليه : أن ههنا قوماً يجتمعون، فيدعون للمسلمين وللأمير. فكتب إليه عمر : أقبل وأقبل بهم معك فأقبل. فقال عمر، للبواب : أعِدَّ لي سوطاً، فلما دخلوا على عمر، أقبل على أميرهم ضرباً بالسوط. فقال: يا أمير المؤمنين! إنا لسنا أولئك الذين يعني أولئك قوم يأتون من قبل المشرق.
অর্থ : আবু উছমান বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর একজন প্রশাসক তাকে পত্র লিখলেন যে, এখানে কিছু মানুষ আছে যারা একস্থানে একত্র হয় এবং মুসলমানদের জন্য ও ‘আমীরে’র জন্য দুআ করে। (হযরত) উমর রা. তাকে উত্তরে লিখলেন, ‘তুমি তাদেরকে নিয়ে আমার কাছে আস।’ প্রশাসক তাদেরকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।
এদিকে (হযরত) উমর রা. প্রহরীকে বললেন, একটা চাবুক প্রস্ত্তত করে রাখ। যখন তারা (হযরত) উমর রা.-এর দরবারে উপস্থিত হল তখন তিনি তাদের আমীরকে চাবুক মারতে লাগলেন। সে বলল, আমীরুল মু’মিনীন, আমরা ওই গোষ্ঠী নই, তারা মাশরিক থেকে আসে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ২৬৭১৫, কিতাবুল আদব, মান কারিহাল কাসাসা ওয়াজজারবা ফীহ)
উপরোক্ত রেওয়ায়েত মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে, হযরত উমর রা. কেন নারাজ হয়েছেন এবং কেন প্রহার করেছেন।
এরা কোনো উদ্দেশ্যে একত্র হয়েছিল এবং নিজেদের মধ্যে একজনকে আমীর বানিয়েছিল। এরপর প্রতিদিন সম্মিলিত হয়ে মুসলমানদের জন্য ও নিজেদের আমীরের জন্য (আমীরুল মু’মিনীন উমর রা.-এর জন্য নয়) দুআ করত।
বলাবাহুল্য, ইসলামী খিলাফত বিদ্যমান থাকা অবস্থায় গোপনে ভিন্ন নেতৃত্ব তৈরির কোনোই অবকাশ নেই। হযরত উমর রা. অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন। তাদের এই কার্যকলাপ থেকে বিদ্রোহ বা ফিৎনার আশঙ্কা করে তৎক্ষণাৎ তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন।
মোটকথা, বিষয়টা সম্মিলিত দুআর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, গোপন নেতৃত্ব সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এজন্য এখান থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ভুল হবে যে, হযরত উমর রা. তাদেরকে সম্মিলিত দুআর জন্য প্রহার করেছিলেন।
সহীহ বুখারী (হাদীস ৬৪০৮) সহীহ মুসলিম (হাদীস ২৬৮৯)সহ বহু হাদীসের কিতাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওই হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যাতে যিকরের হালকার ফযীলত বয়ান করেছেন। সে হাদীসে যিকরের হালকায় কী আমল হয় তারও বিবরণ আছে।
এই হাদীস যাদের জানা আছে তারা জানেন যে, তাতে তাসবীহ ও তাহলীলের সঙ্গে জান্নাতের প্রার্থনা, জাহান্নাম থেকে পানাহ চাওয়া ও ইস্তেগফারের আমলও শামিল রয়েছে। প্রশ্ন এই যে, জান্নাত লাভের ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রার্থনা, ইসতিগফার- এগুলো কি দুআ নয়? আর যিকিরের হালকায় যিকরের সঙ্গে যখন দুআও শামিল রয়েছে তো এটা কি সম্মিলিত দুআ হল না?
এই হাদীস এবং এ বিষয়ের অন্যান্য হাদীস আর এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শরয়ী দলীল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সম্মিলিত দুআর ওপর কীভাবে কাউকে প্রহার করা যেতে পারে?
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল তবুও একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে ইঙ্গিত করে দেওয়া মুনাসিব মনে করছি। বিষয়টি এই যে, উপরোক্ত সম্পূর্ণ আলোচনা এমন সম্মিলিত দুআ সম্পর্কে যাতে কোনো শরয়ী সমস্যা নেই।
যদি কোথাও সম্মিলিত দুআর নামে এমন কোনো কাজ করা হয়, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর, তবে অবশ্যই তা সংশোধনযোগ্য। যেমন কোথাও এই রেওয়াজ হয়ে গেল যে, মাইয়্যেতের ঈসালে ছওয়াবের জন্য এটা অপরিহার্য মনে করা যে, অবশ্যই মাইয়্যেতের জন্য ঈসালে ছওয়াবের মাহফিল করে সম্মিলিত দু্আ করতে হবে, তা না হলে মাইয়্যেতের নিকট ছওয়াব পৌঁছবে না এবং তার হক আদায় হবে না! এটা অবশ্যই একটা ভ্রান্ত ধারণা যা সংশোধন করা জরুরি।
কিংবা যেখানে শরীয়ত সম্মিলিত দুআকে শুধু মুস্তাহাব বা মুবাহ সাব্যস্ত করেছে কোনো অঞ্চলের মানুষ যদি তাকে অপরিহার্য মনে করতে থাকে যেন তা একটি অবশ্য পালনীয় সুন্নত তবে এটাও একটা ভুল ধারণা যা সংশোধন করা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল বিষয় নির্ধারিত সীমারেখার ভিতরে রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
সূত্র- আহলে হক মিডিয়া- আরএম