আবদুল্লাহ আল মাসুদ
বিশ্বব্যাপী ইসলামি আইন শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ যে চারটি ধারা রয়েছে তার মধ্যে ফিকহে হানাফি অন্যতম। এটি বর্তমান বিশ্বে সবচে বেশি মানুষের অনুসরণীয় ফিকহ। এই ফিকহের আলোকেই প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিধিবিধান পালন করে আসছে।
ফিকহে হানাফির আলোকে রচিত ইসলামি আইন শাস্ত্রের অনেক গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। দলিলভিত্তিক ফিকহগ্রন্থ ও দলিলহীন ফিকহগ্রন্থ। ফিকহগ্রন্থ রচনার এই দুটি ধারা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।
ফিকহে হানাফির দলিলহীন অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত যেসব গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে পঠন-পাঠনের গৌরব অর্জন করেছে তার মধ্যে ‘মুখতাসারুল কুদুরি’ অন্যতম। একে সংক্ষেপে ‘আল-কিতাব’ও বলা হয়। ফিকহে হানাফির কোনও গ্রন্থে সাধারণভাবে ‘আল-কিতাব’ বলতে এই বইটিকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বিষয়টি থেকেই গ্রন্থটির গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
অতি সম্প্রতি যাত্রাবাড়ি জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসার উলুমুল হাদীস বিভাগের ছাত্রদের গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে মুখতাসারুল কুদুরির দলিলসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ ।
‘আদিল্লাতুল ক্বারী আলা মুখতাসারিল কুদুরী’। গ্রন্থটিতে ছাত্ররা শাইখুল হাদীস আল্লামা মাহমুদুল হাসান এর দিকনির্দেশনায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিটি মাসআলার সঙ্গে দলিল সংযুক্ত করেছেন। যা অত্যন্ত মূল্যবান ও দীর্ঘদিনের প্রয়োজন অনুভূত হওয়া একটি কাঙ্খিত খেদমত।
সংক্ষেপে বইটির কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি
এক. বইটিতে প্রধান যে কাজটি করা হয়েছে তা হলো, প্রতিটি মাসআলার সঙ্গে দলিল সংযুক্ত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা অনেক শ্রমসাধ্য একটি খেদমত। প্রতিটি দলিলকে তার সূত্রসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে করে চাইলেই একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠক মূল উৎসগ্রন্থ থেকে দলিলটি মিলিয়ে দেখতে পারেন।
দুই. দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ দলিল এড়িয়ে শক্তিশালী ও আপত্তিমুক্ত দলিল উপস্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে কুরআন-সুন্নাহ ও আসারের মাধ্যমে দলিল পেশ করার জন্য। যদি তা না পাওয়া যায় তখনই কেবল যুক্তিভিত্তিক দলিলের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে।
তিন. হাদীস উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তার শুদ্ধাশুদ্ধির মান তুলে ধরা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যদি বুখারি-মুসলিমের হাদীস হয় তবে সেখানে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। আর যদি অন্য কোনও গ্রন্থের হাদীস হয় এবং লেখক নিজেই হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য করে থাকেন তবে সেটা উদ্ধৃত করা হয়েছে।
যদি সেটা না হয় তবে পরবর্তী বিজ্ঞ মুহাদ্দিসরা সেই হাদীসের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা পেশ করা হয়েছে। এটাও যদি না পাওয়া যায় তবে নিজেদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে হাদীসটির মান সম্পর্কে নির্ভুল সিদ্ধান্ত প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে।
পাঁচ.হাদীস তাখরিজের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ততা অবলম্বন করা হয়েছে। তবে কোথাও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিলে সেটা টীকাতে পেশ করা হয়েছে। যাতে করে মূল দলিল অতিরিক্ত বক্তব্যমুক্ত থাকে।
ছয়. দলিল উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ফিকহে হানাফির মৌলিক সূত্রগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য প্রসিদ্ধ সূত্রগুলো থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি গ্রন্থটির মান অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
ছয়. প্রতিটি অধ্যায়ের প্রত্যেক মাসআলাকে আলাদা নম্বর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে একেক অধ্যায়ে কতগুলো মাসআলা রয়েছে সেটা সহজেই অবহিত হওয়া যায়। এবং এভাবে উপস্থাপনার ফলে ছাত্রদের জন্যও মাসআলাগুলো মুখস্ত করে নেওয়া অনেক সহজ হয়েছে।
সাত. প্রচলিত কুদুরির যেসব জায়গায় মুদ্রণবিভ্রাট রয়েছে সেগুলো সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। এই কাজটি করার জন্য মূল কুদুরিকে কাসেম ইবনে কুতলুবুগা রাহ. এর নুসখার সঙ্গে মিলিয়ে নিরীক্ষা করা হয়েছে। যেসব জায়গায় আরবি মূলপাঠে কমবেশ হয়েছে সেগুলো পাঠকদের জ্ঞাতার্থে টীকাতে তুলে ধরা হয়েছে।
আট. কুদুরির মূল আরবিপাঠকে বন্ধনির মাধ্যমে মোটা অক্ষরে স্পষ্টভাবে পৃথক করে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে করে দলিল উপস্থাপনার সঙ্গে মূল গ্রন্থের আরবিপাঠ হযবরল না হয়ে যায়। এবং মূল আরবিপাঠকে ইরাবযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কোথাও মূলগ্রন্থের বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হলে এখান থেকে ইরাব দেখে সমস্যাটা দূর করা সম্ভব হবে।
নয়. শুরুতে সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ একটা ভূমিকা যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উসুলে হাদীস, আমলে মুতাওয়ারাস, ফিকহে হানাফির নানান প্রয়োজনীয় বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমার মনে হয়েছে, এই বই যে মানের, তাতে ভূমিকাটা আরেকটু বড় ও আরো তথ্যবহুল হতে পারতো।
দশ. ফতোয়া গ্রন্থের সূত্র না দিয়ে সরাসরি কুরআনের আয়াত, হাদীস বা আকলী দলিল পেশ করার ফলে ফিকহে হানাফীর উপর আপত্তি তোলা অনেকের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। বিশেষত যারা মনে করেন, ফিকহে হানাফির মাসআলা হাদীস দ্বারা অতোটা প্রমাণীত নয় তাদের জন্য।
মুখতাসারুল কুদুরি অনেক প্রাচীন ও বিখ্যাত গ্রন্থ হলেও সে অনুপাতে এর তেমন সহজ-সরল ব্যাখ্যা গ্রন্থ পাওয়া যায় না। আদিল্লাতুল ক্বারী যদিও ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়, বরং শুধু মুখতাসারুল কুদুরির একটি দলিলসমৃদ্ধ উপস্থাপনা, তবুও এর মাধ্যমে অনেকক্ষেত্রে সহজ-সরল ব্যাখ্যাগ্রন্থের অভাবটি পূরণ হবে বলে আমার বিশ্বাস।
গ্রন্থটি লেখা হয়েছে ফিকহের প্রতি অনুরাগী সবশ্রেণির ছাত্র শিক্ষক ও ইলমপিপাসুদের জন্য। আমাদের দেশে আরবি ভাষায় বর্ণনার নিজস্বতায় অনন্য গ্রন্থটি। বিশেষ করে কুদুরিপাঠে সব ধরনের জটিলতা দূর করার জন্য খুবই সৃজনশীল একটি কাজ ‘আদিল্লাতুল ক্বারী আলা মুখতাসারিল কুদুরী’।
গ্রন্থটি কুদুরি অধ্যয়নের সময় সহযোগী গ্রন্থ হিসেবে আবশ্যকীয়ভাবে পাশে রাখার মতো।
আদিল্লাতুল ক্বারী আলা মুখতাসারুল কুদুরি
সংকলন ও গ্রন্থনা : উলুমুল হাদীস বিভাগ
সম্পাদনা ও তাহকীক : মুফতি মাহমুদুল হাসান জামশেদ
দিকনির্দেশনা ও তারতীব : মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান
প্রকাশনা : মজলিসে ইলমী
মূল্য-৭০০/-
যোগাযোগ
মজলিসে ইলমী
জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া
দক্ষিণ যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪
মোবাইল : ০১৯২৩-৫৪৮৫১১