■ সুহাইল আবদুল কাইয়ূম
আমি একজন জীবনী লেখক হিসাবে বলছি, এটা আত্মপ্রশংসা নয়, বরং আমার কথার ওজন বৃদ্ধি করার জন্য বলছি, আল্লাহ পাকের তাওফিক ও অশেষ মেহেরবানীতে আমার লেখালেখির অন্যতম বিষয়বস্তু হচ্ছে, জীবনী লেখা।
আমার সৌভাগ্য, আমি বুযুর্গানে দীনের জীবনী অনেক পড়েছি। আরবিতেও, ফারসিতেও এবং উর্দূতেও। এ সব বুযুর্গানে দীন, আল্লাহর দরবারে যাদের মাকবূলিয়্যাত ও গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সকলে একমত। যাদের এ উম্মতের হীরা ও মণি-মুক্তা বললেও তাদের অসম্মান হবে। বলা যায় তারা উম্মতের গর্ব। এরা উম্মত ও দীনের সত্যতার দলীল ও প্রমাণ।
এই ভারত উপমহাদেশে সাইয়িদ আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর নাম নিলে খাযা নেযামুদ্দীন আউলিয়া রহ. এর নাম এমনিতেই এসে যায়। আমি কেবল তাদের দুজনের নামের উপরই যথেষ্ট করছি।
এই দুই বুযুর্গের জীবনী আমি পড়েছি।
আমার সম্পর্ক যেহেতু নদওয়াতুল উলামা লখনৌ এবং এর কুতুবখানার সাথে যেখানে তাদের জানার নির্ভরযোগ্য অনেক গ্রন্থ রয়েছে সেহেতু তাদের সম্পর্কে আমার পড়া-শুনার সুযোগ হয়েছে, যা বড় বড় ফুযালাদেরও সুযোগ হয় না।
সেই দুই বুযুর্গের ব্যাপারে বলতে পারি, তাদের জীবন গড়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তাদের মমতাময়ী মা-দের তরবিয়ত।
তখনকার সময়ে বাগদাদ সারা ইসলামী বিশ্বের শুধু খেলাফতের মারকাযই ছিলো না, বরং সেখানে ছিলো বড় বড় দারুল উলূম ও দারুল ইলম। ছিলো রূহানিয়্যাতের মারকাযও।
ছোটদের মুরশিদ ও মুরব্বী সেখানে পাওয়া যেতো। সেখানে এমন শিক্ষাব্যাবস্থা ছিলো, যা অন্য কোথাও ছিলো না। সেখানে ছিলো খেলাফতের প্রতিচ্ছবি ।
এই ঘটনা ইতিহাসগ্রন্থে লেখা আছে, সাইয়িদুনা হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ. বাগদাদের উদ্দেশে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে তার মা তাকে বললেন, বেটা! লক্ষ্য করো, আমি তোমাকে একটি নসীহত করছি, জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলবে না।
যখন কাফেলা চলতে লাগলো, রাস্তায় সে কাফেলার উপর ডাকাতদলের আক্রমণ হলো। ডাকাতেরা কাফেলার প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্নভাবে জিজ্ঞেস করছিলো, তোমার কাছে কী আছে? তোমার কাছে কী আছে?
প্রত্যেকেই বলছিলো, আমার কাছে কিছুই নেই। আমার পকেট একদম শূন্য। অতঃপর তারা খুঁজে স্বর্ণ-মুদ্রা পেয়ে তা তারা ছিনিয়ে নিচ্ছিলো। সাথে বোনাস হিসাবে শাস্তি ও অপমান তো ছিলই।
পর্যায়ক্রমে যখন কয়েকজন লোক হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো-
তোমার কাছে কিছু আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার কাছে কিছু আশরাফী আছে, যা আমার মা আমাকে দিয়েছেন।
ইতিহাসগ্রন্থে লেখা আছে, শুধু এই একটি বাক্যেই তাদের সকলের জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়ে গেলো। তারা বলতে লাগলো, আশ্চর্য বালক তো! সবাই যেখানে মিথ্যা বলছে, সে সেখানে সত্য বলছে।
সে ইচ্ছা করলে তাদের মতো বলতে পারতো, আমার কাছে কিছুই নেই। তার পোশাক-আশাক ও চেহারা-সূরতে মনে হচ্ছে না, সে বড় ঘরের কোনো ছেলে। কিন্তু সে তা না করে সাফসাফ বলে দিলো, আমার কাছে এত মুদ্রা আছে।
কেবল দলীল প্রমাণাদীর মাধ্যমে নয়। কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমেও তাদের শিখাতে হবে আল্লাহর একাত্ববাদের কথা। শৈশবে তাদের সামনে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ. এর ঘটনা বর্ণনা করতে হবে।
এই ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে তারা তাকে মুদ্রাও ফেরত দিলো। খারাপ পথও ছেড়ে দিলো এবং সবার ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলো।
এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আপনি প্রায় সকল বুযুর্গের জীবনীতেই দেখবেন, তাদের বড় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো তাদের মা-দের কিংবা তাদের বড় বোনদের অথবা ঘরের অন্য কারোর।
রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সাথে তার নাম নেয়া, তার নামে জীবন উৎসর্গ করার স্পৃহা ইত্যাদি এসবই ঘরোয়া পরিবেশ থেকে বাচ্চারা শিক্ষা পায়।
কারো মন না ভাঙ্গা, বেইনসাফী ও অন্যায় না করা, বুযুর্গ ও বড়দের সাথে বেয়াদবী না করা এবং শরীআত বিরোধী কোনো কাজ না করা এসব গুণাবলী দর্শন শাস্ত্র পড়ার দ্বারা সৃষ্টি হয় না। বরং ঘরের পরিবেশ থেকেই সৃষ্টি হয়। মা-বাবার কথাবার্তা শুনে বাচ্চাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়।
শিক্ষা দীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ববহ হচ্ছে, তাদের অন্তরে যেন র্শিক ও গায়রুল্লার প্রতি নফরত ও ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয়। কোনো অবস্থাতেই যেন গায়রুল্লার প্রতি আস্থা নির্ভরতা সৃষ্টি না হয়। গায়রুল্লাহকে যেন ক্ষমতাধর ও লাভ লোকসানের নিয়ন্ত্রক মনে না করে।
কেবল দলীল প্রমাণাদীর মাধ্যমে নয়। কথাবার্তা ও কাজকর্মের মাধ্যমেও তাদের শিখাতে হবে আল্লাহর একাত্ববাদের কথা। শৈশবে তাদের সামনে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ. এর ঘটনা বর্ণনা করতে হবে।
তাদের বলতে হবে তিনি সর্ব ধরনের র্শিক প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা পছন্দ করেছেন। আল্লাহ তাআলা তার জন্য সে আগুনকে রহমত বানিয়ে দিয়েছেন।
তার ঘটনা এমনভাবে শুনাবে, যেন বাচ্চার অন্তরে তা অংকিত হয়ে যায় এবং শিরকের প্রতি তাদের নফরত ও ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও চেষ্টা করতে হবে, যেন তাদের অন্তরে বিদআতের প্রতি ঘৃণা, ইসরাফ ও অপব্যয়ের প্রতি ঘৃনা ও মন ভাঙ্গার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়।
আমি পরিস্কার বলছি, বর্তমান যামানায় যে খুন খারাপি হচ্ছে, এর প্রধান কারণ তাদের সে তালীম দেয়া হয়নি। তাকে দেয়া হয়নি ঈমানী ও নৈতিক তরবিয়ত। কোলের বাচ্চার জেহেনে যা বদ্ধমূল হয় যৌবনেও তাই বদ্ধমূল থাকে।
শৈশবে যদি তাদের অন্তরে পবিত্র জিনিস রাখা যায় তাহলে তাদের মধ্যে খুন খারাপি ও যুলুম অত্যাচারের প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হবে।
আমার শৈশবে যে দুটি জিনিসের প্রতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, তা হচ্ছে- ১. কোনো হারাম লুকমা যেন আমার পেটে না যায়। ২. আমার দ্বারা যেন এমন কোনো কাজ বা কথা প্রকাশ না পায়, যার দ্বারা কারো অন্তরে ব্যথা লাগে।
আলহামদু লিল্লাহ আমি এখনো এর স্বাদ অনুভব করি। আজ আমাদের সমাজে ভদ্রতা ও মানবতা বিবর্জিত যে দৃশ্যপট প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, এর সবই ঘরোয়া শিক্ষা দীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে।
আজ আমরা আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষা দীক্ষাকে স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। আমরা মনে করি, বাচ্চারা যা শেখার স্কুল কলেজে শিখবে।
হাতেগুনা কিছু পরিবার পাওয়া যাবে, যাদের ঘরে শৈশবকাল থেকেই বাচ্চাদের আকিদা শেখানো হয়, আল্লাহর প্রতি ভয়, রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি ভালোবাসা, মানুষের সম্মান, মিথ্যা ও ধোঁকা বর্জনের শিক্ষা দেয়া হয়।
আজ আমরা আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষা দীক্ষাকে স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। আমরা মনে করি, বাচ্চারা যা শেখার স্কুল কলেজে শিখবে।
সব ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে চাওয়া, আল্লাহ তাআলাকে সবকিছুর কর্তা মনে করা, মানুষ যে ধর্মেরই হোক তাকে সাহায্য করা ইত্যাদি গুণ, যা আজ আমাদের সমাজ থেকে বিলুপ্ত প্রায় এর সব-ই ঘরোয়া তরবিয়ত থেকে হয়।
এ যামানায় এমন ঘটনা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন, কোনো বাচ্চা নিজের ক্ষুধা ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অন্যকে খাবার দিয়ে দিয়েছে। এমন ইসার ও প্রাধান্য দান তো খানকা ও তাবলীগ জামাতে হবে। এটাই সমকালীন লোকদের ধারণা।
মা বোনদেরদের জেনে রাখা অনিবার্য যে, তারা একটি নতুন প্রজন্মকে তরবিয়ত দিচ্ছে, এজন্য তাদের মধ্যে যথাযথ আকিদা বিশ্বাস তৈরি করা, সুঅভ্যাসে গড়ে তোলা, তাদের সুমেজাজ তৈরি করা মা-বোনদের নৈতিক দায়িত্ব। একজন আদর্শ মা তার সন্তানকে আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তোলে একটি আদর্শ সমাজ উপহার দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
লেখক: শিক্ষাসচিব, জামি‘আ ইসলামিয়া ঢাকা
১৬, উত্তর কুতুবখালী, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা