হাফেজ মুফতি রিদওয়ানুল কাদির
মুহাদ্দিস, জামিয়া টেকনাফ
সুহৃদ! আজকে আপনাদের একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা শোনাবো। একটা দুইটা নয়, পরপর তিনটা গুলি করার পরও গুলি যার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি, এমন একজন আলেমের ঘটনা বলছি।
গাজী মাওলানা কামালুদ্দীন বিন অলি আহমদ। বার্মার একজন মজলুম মুহাক্কিক আলেমে দ্বীন। তার বাবাও অলি আহমদও একজন গ্রহণযোগ্য আলেম ছিলেন।
জন্ম
মাওলানা কামালুদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ১৯৬১ সালে। বাবা মাওলানা অলি আহমদ রহ.। বার্মায় তাদের স্থায়ী নিবাস ছিলো উত্তর মংডুর বড় গজরবিল এলাকায়। পারিবারিকভাবে তারা ছিলেন যথেষ্ট স্বচ্ছল। পুরো এলাকায় সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবে তাদের বেশ নামডাক ছিলো।
পড়ালেখা
পড়ালেখা করেছেন বার্মার বিভিন্ন স্বনামখ্যাত মাদরাসায়। মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের বিশেষ নজর ছিলো তাঁর ছিলো। সর্বশেষ ১৯৯০ সনে পড়ালেখার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায় হাদীস সমাপ্ত করেন বার্মার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ আল জামিয়াতুত তাওহিদিয়া, মগনামা, উত্তর মংডু থেকে।
শিক্ষকতা
জামিয়া তাওহিদিয়ায় পড়ালেখার সর্বোচ্চ স্তর সমাপ্ত করার পর সেখানেই সিনিয়র শিক্ষ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেখানে যথেষ্ট সুনামের সাথে প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
বার্মায় মুসলমানদের ধর্মীয় দুরবস্থা কাটানোর মহান ব্রত নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আল জামিয়া আল ইসলামিয়া মদিনাতুল উলুম বড় গজরবিল। মাদরাসার প্রতিষ্ঠা সন ২০০১ সন। অল্প সময়ের ভেতর মাদরাসাটি জামিয়ায় রূপান্তরিত হয় এবং পুরো বার্মার প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত জামিয়াটিতে ছাত্রসংখ্যাও ছিলো বেশ সন্তোষজনক। প্রায় ৩৫০ জন। দাওরায়ে হাদীসে ছাত্রসংখ্যা থাকতো গড়ে ২৫-৩০ জন।
মিলিটারীদের হাতে গ্রেফতার এবং...
বার্মার সাধারণ মুসলমানরা খুবই সুখে-শান্তিতে কালাতিপাত করছিলো। হঠাৎ করে তাদের উপর নেমে আসে রাজ্যের বিভীষিকা। পুরো বার্মায় মুসলমানদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিমরুলার। শুরু হয় ব্যাপকহারে গণগ্রেফতার।
সেসময়ের ঘটনা। ১২ নভেম্বর ২০১৬ ঈসায়ী। হঠাৎ করে সেদিন তাদের গ্রামের উপর বার্মিজ মিলিটারিদের বিমান টহল দিতে শুরু করে এবং উপর থেকে বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। পুরো এলাকায় হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। সবাই এলোপাথাড়ি দৌড়াতে থাকে। হঠাৎ করে কয়েকজন মিলিটারি এসে মাওলানা কামালুদ্দীনসহ চার জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
শুরু হয় তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন। আটদিন তিনি জেলে বন্দী ছিলেন।
মিলিটারিদের নৃশংসতা
বার্মিজ মিলিটারিরা যে কতবড় অমানুষ, তার কিছুটা আঁচ করা যায় মাওলানা কামালুদ্দীনের বয়ানে। তার মুখেই শুনি...
তিনি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলতে শুরু করেন, আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় ভয়ংকর সব নির্যাতন। যা কল্পনা করলে আমি এখনো আৎকে উঠি। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তারা আমাদের মারধর শুরু করে। লাথি-কিল-ঘুষি থেকে শুরু করে এমন কোন মার নেই, যা তারা আমাদের উপর প্রয়োগ করেনি।
বন্দুকের নল দিয়ে আঘাত করে করে আমাদের রক্তাক্ত করে দিতো। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের ২৪ ঘন্টা উপোস রাখা হয়। এক ফোঁটা পানিও দেয়া হয়নি। গাছের সাথে হাত-পা বেঁধে উপর দিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তখন মনে হতো, যেন জান বের হয়ে যাবে। বার্মিজ জালেম মিলিটারিরা আমার নবির সুন্নত দাড়িগুলো পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়। (একথা বলার সময় তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিলেন)
মিলিটারিদের হাত থেকে বেঁচে আসা
মিলিটারিদের হাত থেকে কেমন বেঁচে গেলেন? প্রশ্ন করতেই রাজ্যের দু:খগুলো তার চেহারায় নেমে এলো। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আহ! কী বলবো! আমার সামনেই আমার চার সাথীকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে করুণ দৃশ্যের কথা স্মরণ হলেই এখনো অশ্রু সংবরণ করতে পারিনা।
এরপর যখন আমার পালা এলো, আমি কালিমা পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিজের অতীত জীবনের গুনাহ স্মরণ করে ইস্তেগফার পড়া আরম্ভ করলাম। তখন হঠাৎ গুলির আওয়াজ পেলাম। চোখ মেলে দেখলাম, গুলিটা আমার গা ঘেঁষে চলে গেছে। এরপর আরেকটা গুলি করলো আমার পিঠ লক্ষ্য করে। তাও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। মেজর গোছের একজন একেবারে কাছ থেকে আমার কপাল লক্ষ্য করে গুলি করলো। আল্লাহর কি কুদরত! এতো কাছ থেকে গুলি করার পরও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট।
তখন বার্মিজ মিলিটারিদের চোখ কপালে উঠে গেলো। তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, এ মনে হয় সাধারণ কোন মানুষ নয়, এ দেবদূত মনে হয়। তখন মেজর গোছের লোকটি বললো, একে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও। তখন আমাকে সসম্মানে ছেড়ে দেয়া হলো।
আমি যখন গ্রামে আসলাম, তখন সবাই বলাবলি করতে লাগলো, আমরা তো মনে করেছিলাম, তুমি শহীদ হয়ে গেছ!
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিশেষত আপনাকে গ্রেফতার করার কারণ কী? প্রতুত্তরে তিনি জানালেন, শুধু একটাই কারণ। আমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের সন্তানদের কেন দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত করছি। আল্লাহর কসম! এছাড়া আর কোন কারণ নেই।
পারিবারিক জীবন
মাওলানা কামালুদ্দীন ৫ ছেলে ও চার মেয়ের জনক। সবাইকে নিয়ে তিনি স্বদেশ থেকে হিজরত করে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আসার সময় নিজেদের সবকিছু ছেড়ে কেবল গায়ের জামাকাপড় নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। এখানে আসার পর শুরু হয় কষ্টের জীবন।
যে হাত দিয়ে একসময় গরিবদের দান করতেন, সে হাত দিয়ে এখন দানের টাকা নিতে হচ্ছে। মাঝেমাঝে হতাশায় ভেঙে পড়েন। পরে আবার নিজেকে সামলে নেন। তিনি ভেঙে পড়লে পরবারের বাকিদের কী অবস্থা হবে!
পরিবারের এতগুলো সদস্যে কী অবস্থা হবে! অনেক সময় ভাবনার সমুদ্রে হারিয়ে ফেলেন! পরক্ষণেই আবার রাব্বে কারিমের সে বাণীটির কথা স্মরণ হয়, আমি তোমাদেরকে যেমন রিযিক দিচ্ছি, তদ্রুপ তোমাদের সন্তানের রিযিকের দায়িত্বও আমার উপর।
সর্বশেষ
এই কথাই বলবো, ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জাতিকে আল্লাহ তাআলা হেফাজত করুন। তাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, উন্নত বাসস্থান ও মানসম্মত কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিন। সর্বোপরি তাদের আবার নিজ দেশে স্বসম্মানে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ করে দিন।
কেমন আছেন আরাকানের প্রসিদ্ধ লেখক মাওলানা শিব্বির আহমদ?