আমিন আশরাফ
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, যুক্তি পসরা উপোড় করে দিয়ে বলছেন- কুরবানিতো মুসলিমদের একটা ত্যাগের উৎসব, পশুত্ব কুরবানি করার উৎসব। কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া গরিব দুস্থ মানুষের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। মানুষকে মানবিক হতে শিক্ষা দেয়। তাহলে গরু কেনার সেই টাকা উত্তরাঞ্চলে বন্যার্তদের মাঝে বিলিয়ে দিলে ক্ষতি কি?
তাদের জন্য কিছু খাবার ওষুধ কিনে দিলেতো আরো বেশি ত্যাগের প্রমাণ দেওয়া হতো।
মুক্তমনা ও সেক্যুলার গোষ্ঠী বা অনেক পোর্টাল ইসলাম সম্পর্কে না জেনে অজ্ঞতাবশত প্রচার করছে, কুরবানি করারচে বেশি মানবিক কাজ হবে কুরবানির টাকা বন্যা দুর্গত এলাকায় দেয়া। বিষয়টি আসলেই কতটা যৌক্তিক?
কুরবানি অবশ্যকরণীয় একটা কাজ। মহান আল্লাহ কুরবানি সেসব ব্যক্তিদের উপর ফরজ করেছেন, যাদের কুরবানির করার সামর্থ আছে। আর যাদের সামর্থ আছে তাদের বানভাসি মানুষদের সাহায্য করারও সামর্থ আছে। কুরবানি ১ লাখ বা ২ লাখ টাকা দামের পশুতে করতে হবে এমনটা জরুরি নয়। লোক দেখানো পাঁচ লাখ টাকা দামের উট কুরবানি করাটাও বাধ্যতামূলক নয়। এ ক্ষেত্রে বিশ বা দশ হাজার টাকা দামের ছাগল কুরবানি করে আপনার ফরজ আদায় করতে পারেন। বাকি টাকা বন্যা দুর্গত লোকদের সহায়তা করতে পারেন।
এমন বিকল্প পথ থাকতে কুরবানি বাদ দিয়ে সেই টাকা বন্যার্তদের দেয়ার আহ্বান পুরোই বোকামির পরিচয় এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ।
আবেগে টইটম্বুর অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী কুরবানির টাকা বন্যা দুর্গত এলাকায় দান করার ঘোষণা আসছে পত্রিকায়। গতকাল নিউজে দেখলাম, মৌসুমী অমর সানী, সোহানা সাবা, শামীমা তুষ্টি, আদনান ফারুক হিল্লোলসহ এমন আরো অনেকে বেশ কোমল স্বরে, কৌশলে দাবি জানাচ্ছেন, ঘোষণা দিচ্ছেন, কুরবানির টাকাগুলো যেনো বন্যার্তদের ত্রাণ তহবিলে দান করা হয়।
প্রত্যেক বছর কুরবানি নিয়ে একশ্রেণির মানুষ উঠে পড়ে লাগে। কুরবানি বন্ধ করতে বিভিন্ন ছুঁতো খোঁজে। এবার তারা পেয়েছে বন্যা ইস্যু। ইসলাম এমন এক ধর্ম যা মানুষকে মানবতার জন্য সেক্রিফাইস করার উৎসাহ দেয়। আর ইসলামে এমন কোনো আদেশ নেই যা মানবতার জন্য অকল্যাণকর।
যারা কুরবানি না করে বন্যার্তদের সাহায্য করতে বলছেন, তারা কি এটা জানেন, বানভাসী মানুষ গরু ছাগল বিক্রি করে জীবন-সংসার চালিয়ে থাকে। সারা বছর চাতক পাখির মতো ওরা কুরবানির অপেক্ষা করে থাকে। কুরবানির পশু বাজারে সেগুলো বিক্রি করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে এসব বানভাসী মানুষ। একবার ভেবে দেখুন কুরবানি না করলে ওরা পশুগুলো বিক্রি করবে কার কাছে? বানভাসীদের সাহায্য করতে চাইলে তাদের পশুগুলো ক্রয় করেও সাহায্য করা যায়। কুরবানির মাংস বণ্টন করে তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারেন।কিন্তু এতকিছু না ভেবে কুরবানি না করার ঘোষণা বড়ই আশ্চর্যের।
আমরা প্রতিদিন হাজারও টাকা অপচয় করি। হোটেলে, বারে বা পার্লারে খরচ করি হাজার হাজার টাকা। সত্যিকার মানবপ্রেমী হলে এসব অপচয় বন্ধ করার কথা না বলে কেন একটি ইসলামের অমোঘ বিধানকে বাদ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এর থেকে সহজেই বোঝা যায় বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
কুরবানি জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। মহান আল্লাহ তায়ালার অত্যন্ত পছন্দনীয় ইবাদাত।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তীও না হয়।' [সহিহ ইবনে মাজাহ, হাদিস নং:২৫৩২]
পবিত্র কুরআনুল কারিম আর হাদিসে নববির অসংখ্য রেফারেন্সে, হাওয়ালাতে এটা দ্ব্যার্থহীনভাবেই বলে দেয়া হয়েছে, প্রত্যেকটা সামর্থবান ব্যক্তিকে অবশ্যই অবশ্যই কুরবানি দিতে হবে।
একটা সময় কুরবানি করাকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে অপপ্রচার করতো একশেণির মানুষ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাদের এসব অপপ্রচারের জবাব দিয়েছেন বড় কঠোর ভাষায়-
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যগ্রহ', শক্তির উদ-বোধন,
দুর্বল! ভীরু চুপ রাহো, ওহে খামোকা ক্ষুদ্ধ মন।
জাতীয় কবি তাঁর কবিতায় এভাবেই কুরবানির তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলেছে। কুরবানি শুধু পশু জবাই নয় এটি 'সত্যগ্রহ' এবং নব শক্তির উদ্ভোধন।
এছাড়াও সবার জেনে রাখা উচিত: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে পষ্টভাবে সূরা নিসার ৮৫ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন- وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
যে লোক জীবন পদ্ধতির (কোন অংশে) নিয়ামক হিসেবে ইসলাম (ইসলামের পূর্নাঙ্গ বিধান) ছাড়া আর কোন পন্থাকে কামনা করবে বিচারদিবসে সে হবে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত।
আসুন আমরা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধান মেনে পূণ্যবানদের কাতারে শামিল হই। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পরিচালিত করুন। আমীন।
পশু কুরবানি মুসলিমদের ধর্মীয় ঐতিহ্য: মাওলানা বুখারী