আওয়ার ইসলাম : পুলিশের এএসপি হয়েছেন। মা-বাবা, স্বজন, গ্রামবাসীর আনন্দের শেষ নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে স্কুলশিক্ষক পিতা বলেছিলেন, ‘পুলিশে ভালো মানুষের দরকার আছে। মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করিস বাবা।’ পিতার সেই বাক্যটি অগ্নিমন্ত্রের মতোই কাজ করছে।
সেই আদর্শে অটুট থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মো. মনিরুজ্জামান। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি একজন পুলিশবন্ধু। জঙ্গি, সন্ত্রাস দমনে একটি গৌরবের নাম মনিরুজ্জামান। পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নানাক্ষেত্রে রয়েছে তার পদচারণা। সাহিত্য, গবেষণা, দর্শন, আইন ও ইতিহাসের বইয়ে সমৃদ্ধ তার অফিসকক্ষ। সময় পেলেই বই থেকে জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, দিনটি ছিল ১৯৯৮ সালের ৩০শে জুন। ওইদিন ১৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশ পায়। একটি পত্রিকায় নিজের রোল খুঁজতে গিয়ে বুকটা কাঁপছিলো। মুহূর্তের মধ্যেই রোল নম্বর খুঁজে পান। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আব্বার স্বপ্ন সত্যি হলো। স্কুলশিক্ষকের সন্তান, নানা আর্থিক টানাপড়েনে অন্য আট-দশটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আমার বেড়ে ওঠা। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার আগেই প্রথম চেষ্টাতেই বিসিএসে কাঙ্ক্ষিত ক্যাডারে চাকরি পেলাম।
এটা তো আমাদের মতো ছেলেদের জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। উত্তীর্ণ হওয়ার খবরটি ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনদের জানালেন। কিন্তু মা-বাবাকে না জানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। তখন তো এরকম মোবাইলফোন ছিল না। তাই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করলেন। গাবতলী থেকে রাতের বাসে যশোরে। সকাল তখন সাড়ে ৮টা।
পথেই পিতার সঙ্গে দেখা হয় মনিরুজ্জামানের। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারেন না। পিতার মুখের দিকে তাকান। পুত্রকে দেখে পিতার চোখে-মুখে কেমন যেন আনন্দের ঝিলিক। পথেই পিতার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। নীরব সে মুহূর্তে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। শিক্ষক পিতার আর বুঝতে বাকি নেই তার ছেলে সফল হয়েছে। নিজ থেকেই বললেন, সারাজীবন পরের ছেলেপুলে মানুষ করেছি। স্বপ্ন ছিল আমার ছেলেও একদিন বড় কিছু হবে।
তারপর পুত্রের হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে থাকেন। মনিরুজ্জামান জানান, এরমধ্যেই খবর ছড়িয়ে গেছে গ্রামজুড়ে। স্কুলশিক্ষকের টিনশেড ঘরের সামনে তখন উপচেপড়া ভিড়। মনিরুজ্জামান বলেন, গ্রামের মানুষ বিসিএস, সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপি বুঝে না। তাদের মুখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিলো- মাস্টার সাহেবের ছেলে এসপি হয়েছে।
এআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, সেদিন দেখেছি বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের আনন্দাশ্রু। বাড়িতে তখন অনেক মানুষ। গ্রাম ও আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। তাদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে।
এদিকে মাসেরও শেষ দিন। আব্বার পকেটে টাকা নেই। তাই এত আনন্দের মাঝেও আব্বার মুখে মলিনতার ছাপ। তখন ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে গেলেন মা। দশ টাকা, পাঁচ টাকা, দু’টাকা, এক টাকা, দু’য়েকটা একশ’ টাকার নোট মিলিয়ে বের করে আনলেন যক্ষের ধন। একটা গহনার ব্যাগে জমানো টাকা। গুনে দেখা গেল প্রায় দেড় হাজার টাকা। বাড়িতে এতো লোক যে ওই টাকায় মিষ্টি কিনে সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব না। মা-বাবা চিন্তামগ্ন। ছেলে এতোবড় চাকরি পেয়েছে জিলাপি খাওয়ানোও ঠিক হবে না। নিদেনপক্ষে চমচম তো খাওয়াতেই হবে। এ বিবেচনায় একে একে ভাইবোনেরা তাদের ঈদের বকশিশ, বৃত্তির টাকা, কবুতর বিক্রির টাকা ইত্যাদি বের করতে শুরু করলো। এভাবে আরো প্রায় এক হাজার টাকা পাওয়া গেল। এই টাকা দিয়ে এক মণ চমচম কিনে সবাইকে খাওয়ানো হলো। মনিরুজ্জামান বলেন, সেদিনের সেই দৃশ্যপটগুলো এখনো চোখে ভাসে।
ওইদিন রাতে পিতার সঙ্গে খেতে বসলেন মনিরুজ্জামান। গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, হারিকেনের আলো। হারিকেনের আলোয় কাঁটা দেখা যাচ্ছে না। মাছের মাথাটা ছেলের পাতে তুলে দিলেন পিতা। সুবোধ বালকের মতো পিতার স্নেহ গ্রহণ করলেন তিনি। আনন্দিত পিতা সেদিন খেতে খেতে বিসিএস ক্যাডার পুত্রকে বলেছিলেন, শুধু মেধা থাকলেই এগুলো হয় না, আল্লাহর রহমত, মানুষের দোয়া লাগে। তোকে আল্লাহ রহমত করেছেন। তোর সঙ্গে মানুষের দোয়া আছে। উৎসুক মানুষের ভিড়ের কথা উল্লেখ করে পিতা বলেছিলেন, সারাদিনে দেখেছিস হাজার হাজার মানুষ নতুন করে তোকে দেখতে এসেছে। পুলিশের চাকরি, মানুষে নানা কথা বলে। আমি মনে করি দেশে ভালো পুলিশ খুব দরকার। মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করিস বাবা।
বড় কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন সম্পর্কে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই ১৯৯১ সালের ২৪শে অক্টোবরের রাতে যশোর থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বাসে ঘুমাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে পিতার মায়ামায়া ডাকে ঘুম ভাঙে মনিরুজ্জামানের। পিতা বললেন, ডানে তাকা। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলেন, কুয়াশার চাদরে ঢাকা সাদা নিয়ন আলোয় লেখা ‘বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি)।’ তিনি বললেন, তোকে ঢাকা নিয়ে এলাম। দিয়ে যাবো এই ঢাকা শহরেই। নিয়ে যেতে চাই এখান থেকেই। তখন পিএটিসি কি জানতেন না মনিরুজ্জামান। শিক্ষক পিতা বললেন, বাংলাদেশের সকল বড় অফিসারদের এখানেই প্রশিক্ষণ হয়। এখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারি কাজ পরিচালনা করে।
পিতার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন মনিরুজ্জামান। পুলিশে যোগ দিয়ে দুই দু’বার জাতিসংঘ শান্তিপদক, বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম), দু’বার ‘প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম)’ পদক পেয়েছেন তিনি। তবে এতকিছুর পরও পদকের চেয়ে তার কাছে মানুষের ভালোবাসা গৌরবের। বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে এআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এদেশে জঙ্গিবাদ দমনে মনিরুজ্জামানের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর প্রায় ২১টি জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নেপথ্যের গুরু হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মনিরুজ্জামান। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে এসব অভিযান সফল করতে তার তৎপরতার শেষ নেই। শুধু তাই নয়, পলাতক জঙ্গিদের ডাটাবেজ তৈরি ও ফলোআপ করার বিষয়টিও হচ্ছে তার দক্ষ নেতৃত্বে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের ভূমিকা প্রশংসনীয়। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তিতেও ভূমিকা রয়েছে এআইজি মনিরুজ্জামানের।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি’র দায়িত্ব পালনের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার (এসপি), ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সহ অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কসোভো এবং সুদানে উচ্চপরিসরে কাজ, ইন্টারপোলসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছোটবেলায় নির্দিষ্ট কোনো পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখেননি মনিরুজ্জামান। পিতার কাছ থেকে শিখেছিলেন মানুষ হতে হবে। মানুষ গড়ার কারিগর মনিরুজ্জামানের পিতার স্বপ্ন ছিল সন্তান ভালো মানুষ হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। সেই স্বপ্ন ছুঁতেই একে একে মেধার লড়াইয়ে জিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
১৯৮৯ সালে যশোরের নাভারনের বুরুজবাগান হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯১ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পিতা খান কবির আহমেদ, মা সালেহা বেগম। দুজনেই পৃথিবীতে নেই। আছে তাদের সন্তান ও স্বপ্ন। মা-বাবার স্বপ্নের পথ ধরেই হাঁটছেন মনিরুজ্জামান। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মনিরুজ্জামানের সংসার। পিতা হিসেবে তিনিও স্বপ্ন দেখেন তার সন্তানরা দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করবে। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরের চাকরি জীবনে মানুষের ভালোবাসাই তার বড় প্রাপ্তি। এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। চোখের জলে তাকে বিদায় জানিয়েছিলেন সেখানকার মানুষ। স্থানীয় একটি পত্রিকা সেদিন ‘পুলিশ সুপার বিশেষ সংখ্যা’ প্রকাশ করে তা জানান দিয়েছিলো।
সূত্র : মানব জমিন