হাফেজ মুফতি রফিকুল ইসলাম সরদার : বিশ্বের অন্যতম বুজুর্গ আলেম, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথিতযশা শাইখুল হাদীস- আল্লামা আব্দুল হক আ’জমী রহ. এর উদ্দেশ্যে সাভারের জামেয়া খাতামুন নাবিয়্যিনে বিশেষ দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হলো। দেশের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য আলেমক তাতে যোগদান করেন।মাহফিলের আয়োজক ছিলেন, জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও শায়খ আব্দুল হক আ’জমী রহ. এর প্রিয় খলীফা আল্লামা আশিকুর রহমান কাসেমী দা. বা.।
বাদ জোহর খানা-দানা ও মেহমানদারির পর্ব চলাকালীন জামেয়ার বেশ কিছু ছাত্র যৌথ কণ্ঠে দারুল উলুম দেওবন্দের সাড়া জাগানো তারানা পরিবেশন করছিল। নিষ্পাপ তালেবে ইলমদের মিষ্ঠি কণ্ঠ আমাকেমুহূর্তের মধ্যে ১৫-২০ বছর আগের সেই তারুণ্যঝরা মধুময় কিছু স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিল। কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম অতীতের সোনালি পাঠে।
অনেক মাহফিল, উস্তাদদের মজলিস আর ছাত্রদের তরবিয়তি জলসায় একাধিকবার এই তারানাটি পরিবেশন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যৌথ পরিবেশনার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমার সাথে কণ্ঠ মিলাতেন প্রিয় সহপাঠী, বন্ধুবর মুফতি আবু সাঈদ ও মুহাম্মাদ আলী ভাই। তারানাটি প্রথম যার সুললিত কণ্ঠে শুনে আপ্লুত হয়েছিলাম, তিনি ছিলেন- খিলগাঁও তালতলা দারুল উলুম মাদরাসার আমার সহপাঠী মাহমুদুল হাসান।
দারুল উলূম দেওবন্দে যারা পড়তে যাচ্ছেন তাদের করণীয়
পরবর্তীতে যার অনুপ্রেরণা ও স্নেহপূর্ণ নির্দেশে দেওবন্দের আসাতিযা ও অতিথিবৃন্দের উপস্থিতিতে বিভিন্ন বরকতি মাহফিলে গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তিনি হলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, বর্তমান জামেয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ, রামপুরার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম- হাফেজ মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম। তিনিই আমাকে তারানাটি সঠিক লাহান আর বিশুদ্ধ উচ্চারণে গাওয়ার জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছেন।
তার নির্দেশনায় চৌধুরীপাড়া মাদরাসার তৎকালীন সিনিয়র শিক্ষক, (বর্তমান মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস) মুহতারাম উস্তাদ মাওলানা আবূ মূসা- এর দ্বারস্থ হলাম আমরা। দারুল উলুম দেওবন্দে থাকাকালীন বিভিন্ন প্রোগ্রামে তিনি অনেকবার এই তারানা আসাতিযা ও ছাত্রদের সামনে পরিবেশন করেছেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি খুব আগ্রহের সাথে আমাদের কয়েকজনকে সুর, ভঙ্গিমা ও উচ্চারণ ঠিক করে দেন। সেই থেকে হুজুরের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী গাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এর মাঝেই উস্তাযে মুহতারাম মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. এর উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সকল ফুজালায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ এর দস্তারবন্দী উপলক্ষে বিশাল ইসলামী মহা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। মাহফিলের স্থান ছিল চৌধুরীপাড়া সবুজ সংঘ মাঠ। উক্ত মাহফিলে দেওবন্দের মুহতামিম- আল্লামা মারগুবুর রহমান রহ. এবং ফিদায়ে মিল্লাত, আওলাদে রাসূল সায়্যেদ আসআদ মাদানী রহ. উপস্থিত থেকে ফুজালাদের পাগড়ি পরাবেন বলে জানানো হয়। তাঁদের উপস্থিতিতে সম্মিলিত কণ্ঠে তারানা পরিবেশনেরও একটি পর্ব রাখা হয়। বলা বাহুল্য, তারানা পরিবেশনের জন্য আমাকে সিলেকশন করা হলো। পরে অবশ্য সময় স্বল্পতার কারণে এ পর্বটি বাদ দিতে হয়েছিল। তাই সেই অনুষ্ঠানে তারানাটি আমার গাওয়া হলো না।
তবে আল্লামা মারগুবুর রহমান রহ. এর সেই সফরেই পরের দিন তালতলা দারুল উলুম মাদরাসায় হযরত রহ. কিছু সময় বয়ান পেশ করেন। সে বয়ানের পূর্বে হযরতের সামনে আমরা ক’জন বিহবল মনে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তারানার সিংহভাগ আবৃত্তি করতে পেরেছিলাম।
এর পরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সায়্যেদ আসআদ মাদানী রহ, হযরত সাঈদ আহমাদ পালনপুরী দা. বা., আরশাদ মাদানী দা. বা., প্রমুখ অতিথিদের সামনে তারানাটি গেয়ে শুনানোর সুযোগ আমার হয়েছিল।
২০০৩ সালে মালিবাগ জামেয়ায় ভর্তি হওয়ার পর পড়া-লেখার অত্যধিক চাপের কারণে তারানাটি কোথাও গাওয়ার ইচ্ছে না হলেও এর মরমী আবেদন হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সবসময়। মালিবাগ জামেয়া থেকে তাখাস্সুস (ইফতা) শেষে মাদরাসা অঙ্গণের ইল্মী বাগিচা থেকে অনিবার্য বিদায়ের পর দরসী খিদমাতের জন্য আপাতত যোগদান করলাম খিলগাঁও শাহী মসজিদ মাদরাসার কিতাব বিভাগে।
নানা সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ এক বেদনা বিধুর ও বিরহকাতর মনে মাদরাসা ভবনের চার তলার দক্ষিণ পাশের জানালানঘেষা খাটে বসে প্রায় দিনই ইশার পরের কিছু সময় দিগন্তের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতাম। নীচে আধারে ঢাকা পৃথিবী আর উপরে দূর সীমানায় হারিয়ে যাওয়া তারকামণ্ডিত মহাকাশ। আপন মনে গুন গুন করে গাইতে থাকতাম তারানায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ।
আশাহত ভগ্ন হৃদয়টি এক পবিত্র ভাবাবেগে যেন টইটুম্বুর হয়ে উঠতো। প্রতিটা শব্দের ফাকে ফাকে আর বাক্যগুলোর মজবুত গাথুনীর বাকে বাকে খুঁজে পেতাম যেন নিজের আত্মপরিচয় ও উম্মতের প্রতি সীমাহীন ভালবাসার বিরল এক গৌরব গাথা ইতিহাস। এক অসীম টানে ছুটে যেতে মন চাইতো সব বাধা অতিক্রম করে। টপ টপ করে ঝরে পড়তো দু’গন্ড বেয়ে দু’ফোটা তপ্ত অশ্রু।
দারুল হাদীসের সালানা ইমতিহানের পর পাগল পাগল হয়ে একবার প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছিলাম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে যাওয়ার জন্য। পাসপোর্টও করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মাওলানা নিয়ামতুল্লাহ দা. বা. (মাদানীনগর মাদরাসার শিক্ষক) ঝুকি নিয়ে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তাই আর যাওয়া হল না ওপারে।
আমাদের সে বছরের সাথী ফয়জুল্লাহ আমান, বশিরুল্লাহ, নজরুল ইসলাম, আহমদ শফীসহ অনেকেই চলে গেলেন দেওবন্দে। দেখে আসলেন নিজেদের ইতিহাস ঐতিয্যের নন্দিত ঠিকানা। কিন্তু আমার যাওয়া হলো না।
গুন গুন করে গাইতে গাইতে একবার এক আবেগঘন মুহুর্তে খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লাম তারানাটির অনুবাদ-ভাবার্থ লেখার জন্য। ঢাল-তলোয়ার (ইল্ম ও ইসতি’দাদ) বিহীন কোন আবেগী যুবকের গভীর রাত পর্যন্ত খালি মাঠে মরণপণ এক মহাযুদ্ধ শুরু হল যেন। তবুও নিরন্তর সাধনার ফলস্বরূপ বেশির ভাগ ছন্দেরই মোটামুটি একটা অনুবাদ দাঁড়িয়ে গেল আরকি! খেয়াল হল- দেওবন্দী আদর্শের প্রতিচ্ছবি, আকাবিরীনদের নকশা ও নমুনা, বাংলার প্রথিতযশা মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদীস আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. কে অনুবাদটি দেখাবো।
আজ যাই কাল যাই করে বিলম্ব হওয়ার চেয়েও শায়খের কাছে কথিত ’অনুবাদকর্ম’টি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মনের দুর্বলতাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল। না জানি কত ভুল ধরা পড়বে! না জানি শায়খের গোলাপী অবয়বে উপচে পড়া নূরানী আভায় এক রাশ বিরক্তির ছাপ পরিলক্ষিত হবে! যেই না চুনোপুটি, সে আবার লিখতে গেছে তারানায়ে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুবাদ!
তাঁর মত বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে নগণ্য এই আমি অনুবাদটি দেখাতে সাহস পেলাম না। পত্রগুলি নিজের কাছেই আগলে রাখলাম। হেফাজত করলাম ফাইলবন্দী করে। আজও সেভাবেই রয়ে গেলো। পৃথিবী চললো তার আপন গতিতে। অতপর ১৫ জুলাই, ২০১৩, সোমবার সন্ধ্যায় শায়খ বিদায় নিলেন এ নশ্বর ভুবন ছেড়ে। নাওয়ারাল্লাহু মারক্বাদাহু।
কালের ঘুর্ণিপাকে আমি এখন সাভারের মাটিতে। ১০ বছর হল ব্যাংক টাউন জামে মসজিদ ও আনন্দপুর দারুল উলুম মাদরাসায় দীনি খিদমাতে সহায়ক হয়ে আছি। সাভারের উলামায়ে কেরাম আমায় প্রাপ্তির চেয়েও বেশি স্নেহ করেন, ভালবাসেন। তাঁদের এই ঔদার্যের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
সে মায়ার টানেই জামেয়া খাতামুন নাবিয়্যিনে আসতে পারা। দুপুরের খাবার খেতে বসে নবযুগের নবীন শিল্পীদের নতুন কন্ঠে নতুন বছরে নতুন করে তারানাটি শুনে এভাবেই অতিত স্মৃতিতে ডুবে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ব্যাংক কলোনী মাদরাসার মুহতারাম প্রিন্সিপাল শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ সাহেব হুজুর স্নেহমাখা ধমকে আমায় বলছেন- ‘কী ব্যাপার মাওলানা, খাবার নিচ্ছেন না কেন? প্লেট খালি কেণ?’ চকিত হয়ে খাবার কাজে ব্যস্ত হলাম ঠিকই, ভেজা চোখ দু’টি আড়াল করতে দ্রুত উঠে হাত ধোয়ার জন্য চলে যেতে হল পশ্চিমের ঐ অজুখানার দিকে।
লেখকের কণ্ঠে তারানায়ে দারুল উলুম
https://www.facebook.com/rafik.alkhatib.5/videos/847608705380449/