নাসিম মুমতাজী
তরুণ আলেম ও প্রাবন্ধিক
হিন্দুস্তানের বাজারে এক সময় বিভিন্ন জায়গার হরেক রকম মালামাল পাওয়া যেতো ৷ রোম, পারস্য, চীন ও আরবসহ আরো অনেক দেশের বণিকদল এখানে বাণিজ্যকাফেলা নিয়ে আসতো ৷ নিজ নিজ দেশের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে হিন্দুস্তানি পণ্য তথা ডাব, নারিকেল, মসলাপাতি, মৃগনাভী (সুগন্ধি জাতীয়) প্রভৃতি মালামাল ক্রয় করে নিজদেশের নিয়ে যেতো ৷
পারস্য তখন বিশ্বের একক পরাশক্তি৷ এজন্য পারসিকদের পণ্যের মূল্যায়ন করা হতো খুব ৷ দাম দেয়া হতো বেশি ৷ বণিকদেরও করা হতো সম্মান ৷ রোমানদের পূর্বেতিহাস স্মরণ করে তাদের পণ্যেরও বিশেষ কদর করা হতো ৷ বণিকদের দেখা হতো মর্যাদার চোখে ৷ চৈনিক দ্রব্যের মূল্যও ছিলো তদৃশ ৷ আর আরব্য পণ্যের চাহিদা ছিলো খুবই কম ৷ ওদের প্রতি কারো তেমন কদর ছিলো না ৷ আরবজাতিকে তখন বিশ্ববাসী তুচ্ছ করতো ৷ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতো ৷ তাদের ঘৃণা করা হতো ৷ গোত্রীয় বিভেদ ও হিংস্রস্বভাবের দরুন তাদের অসভ্য ও বর্বর হিসেবে গণ্য করা হতো ৷
আরবের মরুতে তখনও শিক্ষা-দীক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটেনি ৷ গ্রাম্য মূর্খ আরববাসী তখনও সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি ৷ তাদের মাঝে তখনও ‘মহামানব’ পদার্পণ করেননি ৷ আত্মঘাতি ভ্রাতৃযুদ্ধে তারা লিপ্ত ছিলো ৷ খুনাখুনি ও রক্তপানে মগ্ন ছিলো ৷ সে অন্ধকার যুগ থেকেই তারা ব্যবসা বাণিজ্যের লক্ষ্যে হিন্দুস্তানে যাতায়াত করতো ৷ তাদের কারো কারো এ দেশ ভালো লাগায় এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলো ৷
সময়ের পরিবর্তনে এক সময়ের মূর্তিপূজারী আরববাসী এখন স্বর্গীয় ধর্মের অনুসারী ৷ ঐশীগ্রন্থের অনুগামী ৷ গোত্রীয় বিবাদে লিপ্ত জাতি এখন বিশ্বজয়ী ৷ পৃথিবী তাদের এখন ভিন্ন নজরে দেখে ৷ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে রাখে ৷ তারা এখন সম্মানিত ৷ সর্বমহলে সমাদৃত ৷ বিশ্বের দৃষ্টিতে মর্যাদাবান ৷ তদানিন্তন বিশ্বের পরাশক্তি রোম-পারস্য করতলগত করায় ও অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভেঙে দেয়ায় তাদের সম্মানের চোখে দেখা হয় ৷ দেয়া হয় অন্যের তুলনায় বেশি মর্যাদা ৷ তখন স্বভাবত হিন্দুস্তানে বসবাসরত পিতৃভূমির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে ৷ সাথে সাথে নতুন ধর্ম সম্পর্কে জাগে ব্যাপক কৌতূহল ৷
ইতোমধ্যে সেখানে এক আরবদল বাণিজ্যকাফেলা নিয়ে এলো ৷ তারা সে নতুন ধর্মের অনুসারী ৷ তারা শুধু জাগতিক বাণিজ্যের উদ্যেশেই আসেনি, এসেছিলো পরকালীন বাণিজ্যের নিয়তেও ৷ তাদের অমায়িক ব্যবহার ও সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দুস্তানে বসবাসরত আরবসহ স্থানীয় আরো অনেক অধিবাসী ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন৷
মাস ও বৎসরের আকারে সময় বয়ে চলতে লাগলো ৷ ততোদিনে হিন্দুস্তানে অনেক মুসলমান ৷ একবার হিন্দুস্তানের মুসলমানগণ স্ত্রী ও বাচ্চাদের রেখে হজব্রত পালনে গেলেন ৷ সমুদ্রের বুক চিড়ে তরতর করে এগিয়ে চললো তাঁদের জাহাজ ৷ কিন্তু বিধি রাম! মাঝপথে সমুদ্রঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজ ডুবে যায় ৷ সকলেরই সলীলসমাধী হয় ৷
উমাইয়া খেলাফত আমলের তৎকালিন ইরাকের ভাইসরয় ‘হাজ্জাজ বিন ইউসুফ’ জাহাজ পাঠিয়ে দিলেন আরব্য নারী-শিশুদের আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ৷ তাদের নিয়ে জাহাজ রওনা দিলো ৷ সাথে স্থানীয় রাজার এক সরকারি জাহাজ ৷ সেটি উপঢৌকনবোঝাই ছিলো ৷ যা ‘লঙ্কারাজ’ পাঠাচ্ছিলেন ইরাকশাসকের নিকট ৷
আপনগতিতে জাহাজ দু’টি চলতে লাগলো ৷ কিন্তু ‘দেবল বন্দর’ (বর্তমান করাচি বন্দর) অতিক্রমকালে সিন্দুরাজের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসকের তত্বাবধানে তা লুণ্ঠিত হয় ৷ উপঢৌকন সব কুক্ষিগত করে নারী-শিশুদের বন্দী করা হয় ৷ আবদ্ধ রাখা বয় ভূগর্ভস্থিত গোপন কুঠুরিতে ৷
হাজ্জাজের নির্দেশে মাকরানশাসক ক্ষতিপূরণ ও বন্দীদের মুক্তিদাবী করেন ৷ কিন্তু শোষক রাজার দরবার হতে তা ঘৃণিতভাবে অগ্রাহ্য হয় ৷ পরিণামে রাজা ‘দাহিরে’র বন্দিশালা হতে হিন্দুস্থানী আরব্য মুসলিমদের মুক্ত করার অভিলাষে ছুটে এলেন তরুণ বীর, কিশোর সেনাপতি ‘মুহাম্মদ ইব্ন কাসিম আস-সাকাফী’ ৷ সিন্ধুরাজ্য পেরিয়ে মুলতান পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন তিনি ৷ উড্ডীন করলেন তাওহীদি ঝাণ্ডা ৷
এক এক করে অনেক দিন কেটে গেলো ৷ বছরকে বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো ৷ সিন্ধুনদ বেয়ে হাজার-কোটি গ্যালন পানি গড়িয়ে গেলো ৷ হিন্দরা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ওঠে পড়ে লাগলো ৷ রাজা ‘জয়পাল’ ‘খায়বার গিরিপথ’ পাড়ি দিয়ে ‘কা’বা’ পর্যন্ত মূর্তিস্থাপনের প্রতিজ্ঞা করলো ৷ শুধু কি তাই! হিন্দুস্তানস্থ মুসলমানদের হিন্দুধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে লাগলো ৷ যারা ধর্মত্যাগ করে রামের দীক্ষা নিতো না, হত্যা করা হতো তাদের ৷ সে অত্যাচারিত রক্ষা করতে ও হিন্দুস্তানকে মূর্তির নাগপাশমুক্ত করতে এগিয়ে এলেন ‘সুলতান মাহমুদ গজনভী’ ৷
সুলতান গজনভীর মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের অযোগ্যতা ও অথর্বতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়ালো পৌত্তলিক সম্প্রদায় ৷ পূর্বসূরিদের প্রেতাত্মা চাপলো পৃত্থিরাজের ঘাড়ে ৷ পুরুত-ঠাকুরের কুপরামর্শে আধ্যাত্মিক সম্রাট মুঈনুদ্দীন চিশতি রহ. ও তাঁর অনুসারিদের সে উৎপীড়ন করতে লাগলো ৷ আর তখনই সেনাভিযানের মাধ্যমে তাদের রামরাজ্য গড়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিলেন ‘সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরী’ ৷
লোদি বংশের শাসনামলে রাজনৈতিক বিশৃংখলার সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলো হিন্দু রাজপুতরা ৷ ঠিক তখনই পানিপথের যুদ্ধে লোদিদের পরাজিত করে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর’ ৷
মুঘলরা হিন্দুস্তানে মুসলমানদের নির্ভরতা ছিলো ৷ দীর্ঘদিনব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য বহাল ছিলো ৷ মুঘলদের শেষ সময়ে অযোগ্য অথর্ব সম্রাটদের দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতায় মারাঠি বর্গীদের লুণ্ঠন ব্যাপক আকার ধারণ করলে সাহায্যার্থে ছুটে আসেন ‘আহমদ শাহ আবদালী’ ৷ তবে তিনি হিন্দুস্তানে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেননি ৷
অবশেষে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে কিছু জাতীয় গাদ্দারের চক্রান্তে হিন্দুস্তানের এই পবিত্র ভূমিতে ইংরেজ বেনিয়াদের দখলে চলে যায় ৷
রাজার জাত মুসলমানদের হতে সকল ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয় ৷ নেতৃবর্গ ও শ্রদ্ধাভাজন আলেমদের অনেককেই নির্বাসিত ও শহীদ করে দেয়া হয় ৷ বাকী মুসলমানদের দিন কাটতে থাকে অত্যন্ত পেরেশানি, অতিশয় দুশ্চিন্তা, চরম অস্থিরতা ও সীমাহীন উৎকণ্ঠার সাথে ৷ তারা তখন অভিভাবক ও আশ্রয়হীন ৷
একদিক হতে নিষ্পেষক বৃটিশ বেনিয়া ও ভারতমাতার সন্তান ও অপরদিক হতে আস্তিনের সাপ ভণ্ডপীর, ফেরাকে বাতেলা প্রভৃতির চতুর্মুখী আক্রমণ ৷ তখন আরব থেকে কোনো বিন কাসিম, আফগান থেকে কোনো মাহমুদ গজনভী, হেরাত থেকে কোনো মুহাম্মদ ঘুরী, নিশাপুর থেকে কোনো বাবর, পারস্য থেকে কোনো আবদালী এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্যে ৷ এহেন মুহূর্তে হিন্দুস্তানে ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে ও সাধারণ মুসলমানদের বাঁচানোর লক্ষ্যে তাঁদের উত্তরসূরিরা আযাদির ঝাণ্ডা উত্তোলন করলো ৷ বিশাল বিস্তৃত রক্তসাগর ও বিস্তির্ণ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে একপর্যায়ে তারা ইংরেজ শ্বেতচামড়াঅলাদের স্বদেশে তাড়িয়ে বিজয়নিশান ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলো ৷
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হিন্দুস্তানের মুসলমানরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই স্বাধীন ৷ কোনোকালেই তারা পরাধীন ছিলো না ৷ কোনোযুগেই তাদের মাথা নত হয়নি ৷ তারা রক্ত দিয়েছে, ইজ্জত দেয়নি ৷ শির দিয়েছে, আমামা দেয়নি ৷ জান দিয়েছে, মান দেয়নি ৷ জীবন দিয়েছে, স্বাধীনতা দেয়নি ৷ তাদের উদ্ধত শির কেয়ামত অব্দি কেউ নত করতে পারেনি, ইনশাআল্লাহ! পারবেও না ৷
এযুগের দাবির, জয়পাল, পৃত্থিরাজ ও শিবাজী প্রমুখেরা যদি দুর্বল ভেবে আমাদের আযাদী হরণ করতে চায়, তাদের প্রতিহত করতে আমাদের মধ্য হতেই জন্ম নেবে বিন কাসিম, গজনভী, ঘুরী, বাবর ও আবদালী ৷
সময়ের পরিবর্তন ও ভাগ্যদোষে তখনকার রাজা এখন প্রজা এবং প্রজা হলো রাজা, কিন্তু ধর্মানুরাগ, স্বকীয়তা, দেশপ্রেম, নীতিবোধ ও আত্মমর্যাদায় ব্যবধান হয়নি সামান্যতম ৷
ঈদ না ইদ : একটি অপরাজিত লড়াকু বর্ণের ভালোবাসা