ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ব্যাংকটির পর্ষদ অসহায় হয়ে পড়েছে এমন অভিযোগ করে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
যেকোনো সময় পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
‘‘বন্ধুরা ও ইসলামী ব্যাংকের কোটি কোটি সম্মানিত গ্রাহক, আসসালামু আলাইকুম।
গত ৬ মে ২০১৭ ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক, ইসি চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আমার ১ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যাংক। এই ব্যাংক দেশের ৩২ শতাংশ অর্থনীতির উপরে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন গভর্নর বিভিন্ন সময় বলেছেন ইসলামী ব্যাংকের উপর নির্ভর করে উন্নয়নের অর্থনীতি। এবং উন্নয়নের রাজনীতির উপর নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য। ১ কোটি ২০ লাখের বেশি আমানতকারীর সর্বস্ব ১০ লাখ বিনিয়োগ গ্রহীতাকে দেয়া হয়েছে। কাকে দেয়া হয়েছে, তারা ওই টাকা পুনরায় জঙ্গি অর্থায়ন অথবা সরকার-বিরোধী রাজনীতিতে দিয়েছে কি না তা আমরা মনিটর করতে শুরু করি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলাদেশ” বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন “সোনার বাংলাদেশ” সেই ভিশনকে সামনে নিয়ে আমি ও নতুন পর্ষদ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমান ৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষকে ঋণ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করি। আরও ৫ লাখ এসএমই (ক্ষুদ্র মাঝারি) যুবক ও নারী উদ্যাক্তাদের বিনিয়োগ প্রদানের নির্দেশ দিই। যাতে গরিবি হঠানোর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারি। তখনই শুরু হয় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্লাস-মাইনাসের ষড়যন্ত্র। যেহেতু ১ কোটি ২০ লাখ আমানতকারী তাদের আমানত, বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্ট আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন। আমি ও নতুন পর্ষদ যখন তাদেরকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের অর্থনীতির কাজে নেমে পড়ি তখনই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্র-বিরোধী এই ষড়যন্তের সাথে জড়িত আছে ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু সরকারি অফিসার। ষড়যন্ত্রটি এত জটিল যে অনতিবিলম্বে গোয়েন্দাসমূহের সাঁড়াশি তৎপরতা রাষ্ট্রের স্বার্থে অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে শুধু কয়েকটি স্পর্শকাতর বিষয় তুলে ধরা হলো-
প্রথমত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নিয়ে যখন পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয় তখন এ সরকার ইসলাম বিদ্বেষী এবং এই পর্ষদও ইসলাম বিদ্বেষী এ রূপ প্রচারণা সারাদেশে চালানো হয়। এবং এই প্রচারণা সত্য প্রমাণ করার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসলামী ব্যাংকের ক্যালেন্ডার থেকে “শরীয়াহ ভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংক” শব্দটি সরিয়ে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদকে বেকায়দায় ফেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ভোট নষ্ট করার ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়। আমি ও নতুন পর্ষদ এই ষড়যন্ত্রকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও আমাদের অমতে ওই সমস্ত (৫ থেকে ৭ লাখের বেশি) ক্যালেন্ডার বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
দ্বিতীয়ত ইসলামী ব্যাংকের সাড়ে ১৩ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে ৯৯ শতাংশ আদর্শ ও নিবেদিত ব্যাংকার। ইসলামী ব্যাংকিংকে ব্রত হিসেবে নিয়ে সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এদের অনেকে। ইসলামী ব্যাংকটাকে সার্বজনীন ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এই ৯৯ শতাংশ কর্মকর্তা নতুন পরিচালনা পর্ষদকে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ব্যাংকের হাতেগোনা (দুই ডজনের কম) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ও রাষ্ট্র-বিরোধী কাজে মামলা রয়েছে, তারা এসে দখল করে নেয় ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা। প্রথমে তারা পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়। পরবর্তীতে পর্ষদসমূহের সম্পূর্ণ অবাধ্য হয়ে পড়ে। কেবল বিভিন্ন পর্ষদে তাদের দ্বারা উত্থাপিত এজেন্ডার বাইরে কোনো নির্দেশনা পরিপালন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। সরকার-বিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় কর্মচারীদের ভালো ভালো পোস্টিং দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতর সুযোগ করে দেয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকর্তাদের ঢাকার বাইরে অন্যত্র বদলির নির্দেশনা অগ্রাহ্য করা হয়।
তৃতীয়ত বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পরিচালনা পর্ষদকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা অমান্য করা হয়। একইভাবে ২৬ মার্চ যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয় নাই। উপরন্ত শুরু হয়ে যায় ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চে অফিসের পরে গোপন মিটিং, ইয়ানত অর্থাৎ চাঁদা সংগ্রহ ও ক্যাডারদের মধ্যে বিতরণ।
চতুর্থত এ বছরের মুনাফা থেকে ৭০ কোটি টাকা ট্রান্সফার করা হয় ইসলামী ব্যাংকের বিতর্কিত যাকাত ফান্ডে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সকলে আমাকে প্রশ্ন করেন ইসলামী ব্যাংক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের নিট মুনাফা থেকে কেন যাকাত কর্তন করে? মুসলমান আমানতকারীরা প্রশ্ন করেন “আমার যাকাত আমি দেব যাকে ইচ্ছা তাকে দেব। কেন আমার যাকাত বিতর্কিত জায়গায় বিতরণ করা হচ্ছে”।
এমতাবস্থায় সর্বসাধারণ রাষ্টের সর্বোচ্চ স্তরের কাছে দাবি করছে ব্যাংকটি যেন স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয় এবং পুনরায় যেন ব্যাংকটির ম্যানেজম্যান্ট যেন রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির হাতে ফিরে না যায়।
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের এত বিরাট প্রত্যাশা আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব কি?
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ,
ইসলামী ব্যাংক বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ব্যাংকও বটে। শত কল্পনা-জল্পনার মাঝে আমার স্থান থেকে আমি ব্যাংকটিকে বদনামের বাইরে আনতে চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি ব্যাংকটিকে যেন কেউ রাষ্ট্র-বিরোধী কাজে ব্যবহার করতে না পারে। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্ভিকভাবে কাজ করেছি।
সফলতা-বিফলতার বিচার ইতিহাসের কাধে ছেড়ে দিলাম। এখন একদিকে অশুভ শক্তি ইশারায় আমার শত চেষ্টার পরেও রাষ্ট্র-বিরোধী শক্তি পুনর্বাসিত হয়েছে এবং জাতির পিতার খুনিদের সাথে সংশ্লিষ্টরা ফিরে আসছেন নেতৃত্বে। আগামী বৎসর এই ব্যাংকটিকে রাষ্ট্র-বিরোধী কাজে ব্যবহার করার নীলনকশা সম্পাদন হচ্ছে।
অপরপক্ষে আমার উপর সরে দাঁড়ানোর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে নিয়ে প্লাস-মাইনাসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাই পরিচালনা পর্ষদ ও ভাইস চেয়ারম্যানের পদে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সরে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সব সময় আপনাদের দোয়া ও প্রত্যাশা মাথায় রেখে কাজ করেছি। নিজেকে আপনাদের একজন মনে করি। কখনো আপনাদের না জানিয়ে গোপনে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। কারণ আমি জনতার মানুষ। নিজেকে জনতার সেবায় নিয়োজিত রেখেছি।
এখন আপনাদের সমর্থন প্রয়োজন। যাতে অন্য কোথাও আপনাদের ও জনগণের পুনরায় সেবার সুযোগ পাই।’’ (স্ট্যাটাস কিছুটা পরিমার্জিত)
উল্লেখ্য, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটিতে বড় পরিবর্তন করা হয়। ওইদিন বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সভায় ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার পদত্যাগ করায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
এ ছাড়াও ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক পদত্যাগ করায় নতুন ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ইউসিফ আবদুল্লাহ্ আল-রাজীকে পুনঃনির্বাচিত ও অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমকে নির্বাচিত করা হয় এবং এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে নতুন এমডি হিসেবে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞাকে নিযুক্ত করা হয়।
ইসলাম ও শরীয়া সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে ইসলামী ব্যাংকারদের: নুরুল ইসলাম খলিফা